Inqilab Logo

সোমবার ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৮ আশ্বিন ১৪৩১, ১৯ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরী

করোনাকালের সংকট ও সমাধান প্রফেসর ড. মোহা. হাছানাত আলী

আইবিএ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় | প্রকাশের সময় : ২৪ মে, ২০২০, ১২:০১ পিএম

কোনো মহামারী মাত্র মাস কয়েকের ব্যবধানে দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছে ইতিহাসে এমনটি দেখা যায়নি। বরং আঘাতটা করেছে বারবার। এই ধরুন প্লেগ, রাজত্ব করেছে বহুবছর দাপটের সাথে। তারপর পৃথিবী থেকে একসময় হারিয়ে গিয়েছে। গুটিবসন্তের রাজত্বকাল টাও কম নয়। ইতিহাস জুড়ে তার ক্ষতচিহ্ন আজও দৃশ্যমান। মৃত্যু ছিলো ভীষণ কঠিন আর যন্ত্রণাময়। টিকা আবিস্কারের ফলে গুটিবসন্তের যন্ত্রনাদায়ক স্মৃতি আজ অনেকটাই ধূসর। 

বিভিন্ন ধরনের ফ্লু মহামারীর রূপ ধরে পৃথিবীতে এসেছে বারবার। আঘাত হেনেছে মানব সভ্যতার উপর। কেড়ে নিয়েছে কোটিপ্রাণ। নিকট অতিতেও ইনফ্লুয়েনজা জাতীয় অসুস্থতাই মানুষের মৃত্যুর প্রধানতম কারণরূপে পরিচিত ছিলো। করোনাঘটিত মহামারী দ্রুততম সময়ের মধ্যে বিদায় নিবে তা এই মুহুর্তে আর বলা যাচ্ছে না। আবার হয়ত দ্রুত বিদায় নিতে পারে অথবা ঘুরেফিরে তান্ডব চালিয়ে যেতে পারে যতক্ষন না আবিস্কৃত হয় কোন প্রতিষেধক টিকা। আগেও মানুষ সকল প্রকার মহামারীকে পাশ কাটিয়ে অথবা এর সাথে সহাবস্থান করেই টিকে থেকেছে। টিকে থাকতে বাধ্য হয়েছে। অথবা নিজেদেরকে মহামরির কাছে অসহায় আতœসমর্পণ করে টিকে থেকেছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে আমাদেরকেও টিকে থাকতে হবে করোনার সাথে সহ-অবস্হান করেই।

দুই
করোনা আমাদের অর্থ-ব্যবস্হাকে ইতোমধ্যেই ঝুকির মধ্যে ফেলে দিয়েছে। রপ্তানি আয় উলে­খযোগ্য হারে কমে গেছে। যা এপ্রিল মাসে ছিলো ইতিহাসের সর্বনিম্ন। রাজস্ব ব্যয় বেড়েছে কিন্তু কমেছে রাজস্ব আয়। এমনিতেই দেশের ব্যাংকিং সেক্টর বিগত বছরগুলোতে বিভিন্ন আর্থিক কেলেংকারীতে জড়িয়ে গ্রাহকের কাছে অনেকটাই আস্থা হারিয়ে ফেলেছে। ব্যাংকে তারল্য সংকট প্রকট। এদিকে সরকার ১লক্ষ কোটি টাকার প্রণোদনা ঘোষনা করেছে। যা সরকারকে ব্যাংক থেকে ধার করেই বাস্তবায়ন করতে হবে। এতে ব্যাংকিং খাতের উপর সরকারী ঋনের চাপ আরো বাড়বে। বিগত একদশকে খেলাপি ঋনের পরিমান দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। যার পরিমান টাকার অংকে একলক্ষ কোটি টাকার উপরে। করোনা পরবর্তীতে যা আরো বৃদ্ধি যাবে। ঋনখেলাপিদের বিভিন্ন ধরনের প্রণোনদা দিয়েও সুফল পাওয়া যায়নি। আগামী বাজেটের আকার গতবারের চেয়ে যে বড় হবে তা মোটামুটি নিশ্চিত। বাজেটে ঘাটতির পরিমান বৃদ্ধি পাবে। আর এই বিশাল অংকের ঘাটতি মেটাতে দেশি ও বিদেশী ব্যাংক থেকে সরকারকে ঋন করতে হবে। সংগতকারণে সরকারের ঋনেরসুদ খাতে ব্যয় বাড়বে। ফলে ব্যাংক সমুহে তারল্যসংকট আরো প্রকট হবে। দেশীয় বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হবে। সার্বিকভাবে দেশের অর্থনীতির উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। অনেক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান টিকে থাকার লড়াইয়ে ছিটকে পড়বে নয়ত একিভূত হয়ে বেচেঁ থাকার চেষ্টা করবে। অনেক ব্যাংক আবার সামনের দিনগুলোতে বাধ্য হয়ে তাদের ব্যয় কমিয়ে দিবে। এদিকে সরকার ইতোমধ্যেই ব্যাংকের ব্যয় সংকোচনের জন্য নির্দেশনা জারি করেছে। ফলে অনেক কর্মকর্তা কর্মচারী চাকরি হারাবে। মুলত করোনা পরবর্তীতে দেশের আর্থিক সেক্টরের প্রতিষ্ঠান সমুহে বড় ধরণের বিপর্যয় নেমে আসতে পারে। যার আলামত ইতোমধ্যেই দৃশ্যমান হতে শুরু করেছে। বাংলাদেশে বর্তমানে সরকারি বেসরকারি মিলিয়ে ৬৪টি ব্যাংক ও ৩৪টি ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। যা দক্ষিন এশিয়ার যে কোন দেশের চেয়ে বেশী। এমনকি ভারতের মত একটি বিশাল দেশে এসংখ্যা মাত্র ৩৪টি। আমাদের দেশের অর্থনীতির আকার অনুযায়ী এত অধিক সংখ্যক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কোন যৌক্তিকতা নেই। শুধু মাত্র রাজনৈতিক বিবেচনায় এতগুলো প্রতিষ্ঠানের সৃষ্টি হয়েছে। যা দেশের সামগ্রীক অর্থনৈতিক বিবেচনায় সুখকর নয়।

তিন
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) এর আশঙ্কা অনুযায়ী পৃথিবীর প্রায় ৩৩০কোটি মানুষ বেকার হয়ে যাবে। বিশ্বব্যাংকের ধারনা যে বিশ্বের অর্ধেক মানুষ বেকার হয়ে যাবে। বাংলাদেেেশর প্রেক্ষাপটে গার্মেন্স ও টেক্সটাইল খাতে সবচেয়ে বেশী শ্রমিক চাকুরি হারাবে। ছোট ও মাঝাড়ি কারখানা বন্ধ হয়ে যাবে। টিকে থাকবে শুধু মাত্র বড়বড় কলকারখানা। মধ্যপ্রাচ্যের দেশসমুহে তেলের দাম কমে যাবার কারণে লক্ষলক্ষ শ্রমিক চাকুরি হারিয়ে দেশে ফিরে আসতে বাধ্যহবে। রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে যাবে। তাই সরকারকে পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে সচেতনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। বিলাসীপণ্য ও প্রসাধনি সামগ্রীর আমদানিকে শতভাগ নিরুৎসাহিত করতে হবে। চাকুরি হারানো শ্রমিকদের জন্য দেশে- বিদেশে বিকল্প কর্মসংস্থান করতে না পারলে সমাজিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্ট্রি হতে পারে। এক্ষেত্রে কৃষিই হতে পারে তাদের জন্য বিকল্প কর্মসংস্হানের সর্বোৎকৃষ্ঠ পন্থা। কৃষির নতুন নতুন ক্ষেত্র ও পদ্ধতি উদ্ভাবন করতে হবে। স্বল্পসুদে ও সহজশর্তে কৃষিঋন বিতরণ সময়ের দাবী। কৃষিপণ্যের বাজার ব্যবস্থাকে যুগোপযোগি করে গড়ে তোলা গেলে একদিকে কৃষক যেমন তাদের পণ্যের ন্যায়্য মুল্য পাবে অন্যদিকে কৃষকরা কৃষিকাজে উৎসাহিত হবে। মুলত কৃষিই পারে দেশের অর্থনীতিকে বাচাঁতে।

চার
করোনায় ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ অন্যান্য খাতগুলোর মধ্যে ক্ষুদ্র ও মাঝাড়ি শিল্প, বিমান পরিসেবা, পর্যটন, গণপরিহন ও শিক্ষা ব্যবস্থা অন্যতম। দেশের বিকাশমাণ পর্যটন শিল্প বিপর্যস্ত। এখাতের কয়েক লক্ষ কর্মী পুরোপুরিভাবে বেকার হয়ে গেছে। পর্য়টন শিল্প সহসা ঘুড়ে দাড়াঁবে এমন কোন সম্ভাবনা একেবারেই নেই। এখাতে সরকারের কোন প্রণোদনাও নেই। পর্যটন খাতের বিনিয়োগ হুমকির মুখে। হোটেল মোটেল বন্ধ। কবে এখাত সচল হবে তা কেউ জানেনা। এখাতের উদ্যোক্তারা দেশে বিদেশে তাদের বিনিযোগকৃত অর্থের পুরোটাই হারিয়ে ফেলতে পারে। বহিঃবিশ্বে দেশের ইমেজ বৃদ্ধি ও অর্থনীতির স্বার্থে দেশের পর্যটনশিল্পকে বাচিঁয়ে রাখা জরুরী। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কার্যকরী উদ্যোগ এখাতের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে সহায়ক হতে পারে।

পাচঁ
করোনায় দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা এক সংকটময় সময় পার করছে। গত ১৮মার্চ থেকে দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ। ক্লাসরুমে তালা। প্রতিষ্ঠান খুলে দেবার মত পরিস্থিতি এখনও তৈরী হয়নি। বাংলাদেশ শিক্ষা ও তথ্য পরিসংখ্যানের তথ্যানুযায়ী দেশে প্রাথমিক স্তরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মোট সংখ্যা ১লক্ষ ২৯হাজার ২৫৮টি। যার মধ্যে সরকারী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৬৫হাজার ৬২০টি। মাধ্যমিক প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ২০হাজার ৬৬০টি। এর মধ্যে সরকারী ৬৭৫টি। সরকারী ও বেসরকারী মিলে দেশে কলেজের সংখ্যা ৪হাজার ৫৫১টি। এর মধ্যে বেসরকারী কলেজের সংখ্যা ৩হাজার ৯৯০টি। দেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৫৩টি,আর বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ১০৩টি। দেশে ৩টি সরকারী সহ কয়েক হাজার আলিয়া মাদরাসা রয়েছে। সরকারী প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক কর্মচারীরা রাষ্ট্রিয়কোষাগার থেকে তাদের বেতনভাতাদি পেয়ে থাকেন। এমপিওভুক্ত বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক কর্মচারীরাও সরকারী তহবিল থেকে শতভাগ বেতনভাতা পেয়ে থাকেন। সমস্যায় রয়েছে ছাত্র/ছাত্রীদের টিউশন ফিসের উপর নির্ভরশীল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গুলো। এছাড়া দেশে বহুসংখ্যক কিন্ডারগার্টেন স্কুল, ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল-কলেজ, ক্যাডেট মাদরাসা ছাড়াও স্থাস্থ্য শিক্ষা ও পলেটেকনিক ইন্সটিটিউট রয়েছে। যার অধিকাংশই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বেসরকারী উদ্যোগে। আর এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক কর্মচারিদের বেতনভাতা সম্পুর্ণভাবে শিক্ষার্থীদের টিউশন ফিসের উপর নির্ভরশীল। অথচ করোনাকালীন কালীন সময়ে ক্লাস পরীক্ষা বন্ধ। সরকারী ভাবে টিউশন ফি আদায়ে নিষেধাজ্ঞা না থাকা সত্বেও মানবিক কারণে তা আদায় বন্ধ রয়েছে। ফলে এসব প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শিক্ষক কর্মচারীর বেতনভাতা প্রাপ্তি অনেকটা অনিশ্চত হয়ে পরেছে। দেশের সিংহভাগ প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় চরম অর্থসংকটে পরেছে। এথেকে পরিত্রাণের জন্য দেশের সকল বেসরকারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গার্মেন্টস শিল্পের ন্যায় ২% সুদে ঋন পাবার হকদার। একথা ভুলে গেলে চলবে না যে দেশের শিক্ষাবিস্তারে বেসরকারী উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠনের অবদান অনষিকার্য।

ছয়
করোনায় দেশে আক্রান্ত ও মৃত্যর সংখ্যা প্রতিদিন লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। করোনায় মানুষের আক্রান্ত হওয়া ও মৃত্যু কবে,কখন বা কিভাবে বন্ধ হবে তা কেউ জানেনা। করোনা নির্মুলে টিকা বা ভ্যাকসিন যে সহজে মানুষের হাতের নাগালে আসছে না তাও প্রায় নিশ্চিত। এদিকে ভাইরাস প্রতিরোধে মানুষকে ঘরবন্দী করেও রাখা যাচ্ছে না। আর কতদিনই বা ঘরবন্দী থাকা যাবে। আমাদেরকে তো জীবন ও জীবিকার সন্ধানে বাড়ী থেকে বের হতেই হবে। করোনাকে সঙ্গী করেই পথে পা বাড়িয়ে দিতে হবে। কলকারখানায় উৎপাদনের চাকাকে সচল করতে হবে। স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দিতে হবে। অফিস আদালতে স্বাভাবিক কাজকর্ম শুরু করতে হবে। মৃত্যু বা সংক্রমণের ভয় আছে জেনেও করোনার সাথে লড়াই করেই বেচেঁ থাকার চেষ্টাটা অন্তত করতে হবে। করোনায় মৃত্যুর একটা পরিসংখ্যান হয়তঃ দ্রুতই মানুষের আয়ত্বে আসবে ইনশা আল্লাহ।একদিন সকল পরিসংখ্যান ফাঁকি দিয়ে দিব্যি বেঁচে যাবে মানুষ, টিকে যাবে মানব সভ্যতা।



 

Show all comments
  • Abdur Rafi ২৪ মে, ২০২০, ৫:৪৯ পিএম says : 0
    লেখকে বলব করোনা রুগির সাথে কোলাকুলি করে কাজে নেমে পড়ুন।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: করোনাভাইরাস

৪ জানুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ