দেশে দেশে রোজার উৎসব
মাহে রমজান আরবী নবম মাসের নাম। চাঁদের আবর্তন দ্বারা যে এক বৎসর গণনা করা হয়,
যাকাত ইসলামের প্রধান আর্থিক ইবাদাত। সুষম সমাজ গঠনের লক্ষ্যে এটি আল্লাহ প্রদত্ত ইসলামি অর্থব্যবস্থার মূলভিত্তি ও ইসলামের মৌল স্তম্ভের উল্লেখযোগ্য একটি বুনিয়াদ। ঈমানের পর সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ও অপরিহার্য ইবাদাত হল সালাত ও যাকাত। কুরআন মাজীদে বহু স্থানে সালাত ও যাকাতের আদেশ করা হয়েছে এবং আল্লাহর অনুগত বান্দাদের জন্য অশেষ সাওয়াব, রহমত ও মাগফিরাতের পাশাপাশি আত্মশুদ্ধিরও প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, “তোমরা সালাত আদায় কর এবং যাকাত প্রদান কর। তোমরা যে উত্তম কাজ নিজেদের জন্য অগ্রে প্রেরণ করবে তা আল্লাহর নিকটে পাবে। নিশ্চয়ই তোমরা যা কর আল্লাহ তা দেখছেন।” [সূরা বাকারা : ১১০]
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন, “তোমরা সালাত আদায় কর, যাকাত দাও এবং রাসূলের আনুগত্য কর যাতে তোমরা অনুগ্রহভাজন হতে পার।’’ [সূরা নূর : ৫৬]
হাদস শরীফে একে ইসলামের সেতুবন্ধন বলা হয়েছে। কারণ, এটি ধনী ও গরীবের মাঝে অর্থনৈতিক সেতুবন্ধন। মুসলিম সমাজ থেকে দরিদ্রতা দূরীকরণে এবং সমাজে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা আনয়নে যাকাতের ভূমিকা অপরিসীম।
জাকাত আদায়ের গুরুত্ব
পবিত্র কুরআনের বিরাশিটি স্থানে সালাতের পর পরই যাকাতের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এর কারণ প্রসঙ্গে আল্লামা তাবারী বলেন, “যে ব্যক্তি যাকাত আদায়ে সম্মত হবে না তার কোন সালাতই গ্রহণযোগ্য হবে না।” [ তাবারী-১৪/১৫৩]
যাকাত যে কত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, এ থেকে তা সহজে অনুমেয়। এটা দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, আমাদের সমাজে যাকাতের প্রচলন একেবারেই নগন্য। অথচ সালাত এবং যাকাত উভয়েই সমভাবে ফরয। একটি হচ্ছে আল্লাহর হক আর অপরটি বান্দার হক।
সূরা নিসার ১৬২ নং আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা তার বান্দাদের জন্য ‘আজরুন আযীম’-এর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘‘এবং যারা সালাত আদায় করে, যাকাত দেয় এবং আল্লাহ ও পরকালে ঈমান রাখে আমি তাদেরকে মহাপুরস্কার দিব।’’
অন্য আয়াতে যাকাতের গুরুত্বপূর্ণ সুফল বর্ণনা করে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘‘তাদের সম্পদ থেকে সদকা গ্রহণ করুন, যার দ্বারা আপনি তাদেরকে পবিত্র করবেন এবং পরিশোধিত করবেন এবং আপনি তাদের জন্য দু‘আ করবেন। আপনার দু‘আ তো তাদের জন্য চিত্ত স্বস্তিকর। আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।’’ [সূরা তাওবা : ১০৩]
এ কারণেই মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরাম যাকাতের প্রতি অধিক গুরুত্ব প্রদান করতেন।
হযরত আবু বকর রাদিআল্লাহু আনহু যাকাতের বিরূদ্ধচারণকারীদেরকে মুরতাদ হিসেবে গণ্য করেছিলেন। তাদের বিরূদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে বলেছিলেন, “আল্লাহর কসম! তারা যদি আমাকে ( যাকাতের) একটি উটের দড়িও প্রদান করতে অস্বীকার করে, যা তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে প্রদান করত, আমি তাদের বিরূদ্ধে অস্ত্র ধারণ করবো, যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা তা আদায় করে দেয়।” [বুখারী ও মুসলিম]
ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী রাহ.-এর ভাষায়,‘যাকাত শরীয়তের এমন এক অকাট্য বিধান, যে সম্পর্কে দলীল-প্রমাণের আলোচনা নিষ্প্রোজন। যাকাত সংক্রান্ত কিছু কিছু মাসআলায় ইমামদের মধ্যে মতভিন্নতা থাকলেও মূল বিষয়ে অর্থাৎ যাকাত ফরয হওয়া সম্পর্কে কোনো মতভেদ নেই। যাকাতের ফরযিয়াতকে যে অস্বীকার করে সে ইসলাম থেকে খারিজ হয়ে যায়।’’ [ফাতহুল বারী ৩/৩০৯]
যাকাতের উপকারিতা
সম্পদের যাকাত আদায় করা মহান আল্লাহ তা‘আলার নির্দেশ। আল্লাহর সন্তুষ্টির অন্যতম মাধ্যম। পার্থিব কোন উপকারিতা থাকুক আর না থাকুক, আল্লাহর নির্দেশ পালনে মুমিন সর্বদা বাধ্য। তবে আল্লাহর কোন নির্দেশ-ই পার্থিব উপকারিতা মুক্ত নয়। তেমনি যাকাতের মাঝেও রয়েছে ধর্মীয় অনুশাসন পালনের পাশাপাশি পার্থিব অনেক উপকারিতা। আল্লাহ তা‘আলা পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেছেন, “আল্লাহ তা‘আলা সুদকে নিশ্চিহ্ন করেন এবং দান খয়রাতকে বর্ধিত করেন। আল্লাহ পছন্দ করেন না কোন অবিশ্বাসী পাপীকে।” [ সূরা বাকারা : ২৭৬ ]
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, কোন বান্দা যখন যাকাত আদায় করেন, তখন আল্লাহর আদেশে একজন ফিরিশতা তার জন্য এভাবে দু‘আ করতে থাকেন, হে আল্লাহ! আপনার পথে যে দান-সদাকা, যাকাত দেয়, তার সম্পদকে আপনি বৃদ্ধি করে দিন, আর যে ব্যক্তি সম্পদ ধরে রাখে (যাকাত দেয় না) তার সম্পদ আপনি ছিনিয়ে নেন।” [বুখারী]
মূলত যাকাত আদায় করলে বাহ্যিকভাবে সংখ্যায় মনে হয় যেন সম্পদ কমে যাচ্ছে। কিন্তু যাকাত আদায় করলে আল্লাহ তা‘আলা অবশিষ্ট সম্পদে প্রভূত বরকত দান করেন যা যাকাত না দিলে পাওয়া যেত না। আবার যাকাতের মধ্যে যে সম্পদটা খরচ হয়, আল্লাহ তা‘আলা ভিন্ন কোন উপায়ে সেই সম্পদ আবার ফিরিয়ে দেন।
যাকাত আদায় না করার ভয়াবহ পরিণতি
যাকাত প্রদানে যারা কার্পণ্য করবে, তাদের বিরুদ্ধে পবিত্র কুরআন এবং হাদীস শরিফে কঠোর সতর্কবাণী উচ্চারিত হয়েছে।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন, “আর আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে যা তোমাদেরকে দিয়েছেন তাতে যারা কৃপণতা করে তারা যেন কিছুতেই মনে না করে যে, এটা তাদের জন্য মঙ্গল। না, এটা তাদের জন্য অমঙ্গল। যে সম্পদে তারা কৃপণতা করেছে কিয়ামতের দিন তা-ই তাদের গলায় বেড়ি হবে। আসমান ও যমীনের স্বত্ত্বাধিকার একমাত্র আল্লাহরই। তোমরা যা কর আল্লাহ তা বিশেষভাবে অবগত।” [সূরা আল-ইমরান : ১৮০]
হাদীস শরীফে এসেছে, ‘‘যাকে আল্লাহ সম্পদ দিয়েছেন, কিন্তু সে তার যাকাত দেয়নি কিয়ামতের দিন তা বিষধর স্বর্পরূপে উপস্থিত হবে এবং তা তার গলায় পেঁচিয়ে দেওয়া হবে। সাপটি তার উভয় অধরপ্রান্তে দংশন করবে এবং বলবে, আমিই তোমার ঐ ধন, আমিই তোমার পুঞ্জিভূত সম্পদ।’’ [সহীহ বুখারী]
যাকাত ফরয হওয়ার শর্তসমূহ
১. নেসাব পরিমাণ মালের মালিক হওয়া। অর্থাৎ সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণ, বা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রুপা, কিংবা সমপরিমাণ মূল্যের নগদ টাকা বা ব্যবসার মালের মালিক হওয়া। ২. মুসলমান হওয়া। কাফেরের উপর যাকাত ফরয নয়। ৩. বালেগ হওয়া। নাবালেগের উপর যাকাত ফরয নয়। ৪. জ্ঞানী ও বিবেক সম্পন্ন হওয়া। সর্বদা যে পাগল থাকে তার নেসাব পরিমাণ মাল থাকলেও তার উপর যাকাত ফরয নয়। ৫. স্বাধীন বা মুক্ত হওয়া। দাস-দাসীর উপর যাকাত ফরয নয়।
৬. মালের উপর পূর্ণ মালিকানা থাকা। অসম্পূর্ণ মালিকানার উপর যাকাত ফরয হয় না। ৭. নেসাব পরিমাণ মাল নিত্য প্রয়োজনীয় সম্পদের অতিরিক্ত হওয়া। ৮. নেসাব পরিমাণ মালের উপর এক বছর অতিবাহিত হওয়া।
যাকাত যাদের দেওয়া যাবে
আল্লাহ তা‘আলা বলেন, “যাকাত তো কেবল নিঃস্ব, অভাবগ্রস্ত ও যাকাতের কাজে নিযুক্ত ব্যক্তিদের জন্য, যাদের মনোরঞ্জন উদ্দেশ্য তাদের জন্য, দাসমুক্তির জন্য, ঋণগ্রস্তদের জন্য, আল্লাহর পথে জিহাদকারী ও মুসাফিরের জন্য। এ আল্লাহর বিধান। আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।” [সূরা তাওবা : ৬০]
যাকাত আদায়ের সময়
যাকাত আদায়ের জন্য নির্দিষ্ট কোন সময়ের বাধ্যবাদকতা নেই। তবে রমাদান মাসই যাকাত আদায়ের সর্বোত্তম সময়। রমাদানে দান-সদাকাহ করলে অন্য সময়ের চেয়ে ৭০ গুণ বেশি সাওয়াব লাভ হয়। তাই পবিত্র রমাদান মাসে মু’মিন বান্দারা একসঙ্গে গরীবের হক যাকাত ও ফিতরা আদায় করে থাকে।
দারিদ্র্য বিমোচন ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে মাহে রমাদানই অধিক সওয়াব প্রাপ্তির জন্য যাকাত আদায়ের উপযুক্ত মৌসুম ও শ্রেষ্ঠতর সময়। রমাদান মাসে ধনী লোকেরা দরিদ্রদের যাকাত প্রদানের ফলে উভয় শ্রেণির মানুষের মধ্যে পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ববোধ গড়ে উঠে।
অভাবগ্রস্ত, অসহায়, সম্পদহীন, কর্মহীন, এতিম, বিপদ ও দায়গ্রস্ত মানুষকে সহায়তা করা আল্লাহ তা‘আলার সুস্পষ্ট নির্দেশ হলেও অত্যন্ত বিস্ময়কর এই যে, আমাদের অনেকেই এ ব্যাপারে খর্বহস্ত। ধন-সম্পদের প্রাচুর্য থাকলেও মানুষের সহায়তায় এগিয়ে আসতে মন চায় না। বলার অপেক্ষা রাখে না, মানুষকে সহায়তা করার মতো মহৎ কাজ বা সৎকর্ম আর কিছু হতে পারে না। বর্তমান বিশ্বে ‘করোনা ভাইরাস’ মানুষকে সাহায্য ও সহায়তা করার একটা সুযোগ এনে দিয়েছে।
যাকাত, দান ও সদাকার অর্থ গরীব-দুঃখী-অসহায়দের মধ্যে বণ্টন করে দিলে দানের সাওয়াব যেমন পাওয়া যাবে, তেমনি বিপন্ন ও বিপদগ্রস্ত মানুষ উপকার লাভ করবে। সরকার, মিডিয়া ও আলেম সমাজ বেশি বেশি যাকাত, দান-খয়রাত ও সাদাকা করার ব্যাপারে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করার উদ্যোগ ও পদক্ষেপ নেবে। মনে রাখতে হবে, যাকাত আদায় এবং অভাবী অসহায়দের পাশে দাঁড়ানোর এটাই শ্রেষ্ঠ সময়।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।