Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

কাপাসিয়ায় শ্রমিকের অভাবে বিলাতি ধনেপাতার চাষীরা বিপাকে

কাপাসিয়া (গাজীপুর) থেকে শামসুল হুদা লিটন | প্রকাশের সময় : ২৪ এপ্রিল, ২০২০, ৪:৪৮ পিএম

গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলার দুর্গাপুর ও পাশ্ববর্তী কালীগঞ্জ উপজেলার মোক্তারপুর ইউনিয়নের বেশ কয়েকটি গ্রামের চাষীরা দীর্ঘ দিন যাবত বানিজ্যিকভাবে বিলাতি ধনিয়া চাষ করে আসছে। 

কাপাসিয়া উপজেলার দুর্গাপুর ইউনিয়নের নাশেরা, দড়িনাশেরা, খিলগাঁও, লক্ষীপুর, ফেটালিয়া সহ বেশ কয়েকটি গ্রামের অন্তত অর্ধশতাধিক কৃষক ধনেপাতা চাষ করছে। অপরদিকে পাশ্ববর্তী মোক্তারপুর ইউনিয়নের রাথুরা, নামা রাথুরা, বাঘুন, চরবাঘুন, সংকটপুর গ্রামের অনেক কৃষকও বানিজ্যিকভাবে ধনিয়া পাতা চাষাবাদ করছে।
এলাকায় আঞ্চলিক নাম ধনেপাতা। আসলে এ ধনে পাতাই বিলাতি ধনিয়া। বিলাতি ধনিয়ার বৈজ্ঞানিক নাম Eryngium foetidium Ll. এটি Umbeliferae পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। বিলাতি ধনিয়া একটি অর্থকরী ফসল। বিলাতি ধনিয়া পাতা ও কচি পুষ্পদন্ড একাধারে সবজি,সালাদ এবং মসলা হিসাবে ব্যবহার হয়। রান্নার কাজে তরকারিতে, ডাল ভাজি ও নিরামিষে এ পাতা সুগন্ধি বৃদ্ধির জন্য ব্যবহৃত হয়। সালাদ, ভর্তা এবং বড়া, পিয়াজু, সিঙ্গারা তৈরিতে ধনিয়া পাতার জুড়ি নেই।
শীতের শেষ সময়ে চাষিরা পতিত জমির আগাছা পরিষ্কার করে মাটি কর্ষণ ও হালের মাধ্যমে ধনেপাতা চাষ শুরু করেন। চৈত্র মাস থেকে পুরোদমে চলে ক্ষেতের পরিচর্চা। কার্তিক মাসে ফসল তোলা শুরু হয়। এর মধ্যে ৪-৫ বার ফসল বিক্রি করা যায়। প্রায় সারা বছরই ক্ষেতে ধনেপাতা থাকে। ধাপে ধাপে বিক্রি করা হয় পাতা। চলতি বছর আবহাওয়া অনুকুলে থাকায় ফলনও ভালো হয়েছে। গ্রামগুলোয় ৬-৭ বছর ধরে এ ফসল চাষের চাহিদা ব্যাপকভাবে বেড়েছে। এক চাষির মুনাফা দেখে অন্য চাষিরা ধনেপাতা চাষে উৎসাহী হচ্ছেন। ক্ষেতের মধ্য দিয়ে হাঁটলেও ধনেপাতা গাছের কোনো ক্ষতি হয় না। গাছের নিচের ছায়ায়ও এ ফসল ভালো জন্মে। বাজারে প্রতি কেজি পাতা ১৫০ টাকা দরে বিক্রি হয়। পাইকাররা গ্রামের চাষিদের কাছ থেকে ক্রয় করে ট্রাকের মাধ্যমে কয়েকশ মণ ধনেপাতা ঢাকার কাওরান বাজারে নিয়ে যায়। এক বিঘা জমিতে প্রায় ৩০ মণ ধনেপাতা উৎপাদন করা যায় বলে জানান চাষিরা।
কাপাসিয়া ও কালীগঞ্জ উপজেলার পাশাপাশি দুটি ইউনিয়ন হলো দুর্গাপুর ও মোক্তারপুর। এ দুটি ইউনিয়নের বেশ কয়েকটি গ্রামের শতাধিক কৃষক ধনেপাতা চাষ করছে। অল্প খরচে লাভ বেশি হওয়ায় নতুন এ ফসল চাষে উৎসাহী হচ্ছে তারা। কৃষকরা তাদের স্ত্রী, বিদ্যালয়ে পড়ুয়া সন্তান ও শ্রমিক নিয়ে ধনেপাতা ক্ষেতে কাজ করছে। কেউ ক্ষেতের ঘাস তুলছে, কেউ পাতা তুলছে আবার কেউ ঢাকা পাঠানোর জন্য প্যাকেট করছে। সারা দিনের কাজ গুছিয়ে বাড়ির পাশে ধনেপাতা ক্ষেতে সময় দিচ্ছে পরিবারের সবাই। সবার কাজের জন্য চাষিকে দিতে হচ্ছে আলাদা মজুরি। যারা কাজ করেন তারা সবাই স্থানীয় গ্রামের বাসিন্দা। বাড়তি লাভের আশায় ধনেপাতা ক্ষেতে নিড়ানির কাজে ঝুঁকছেন স্থানীয় মহিলারা। দৈনিক তাদের ২০০ টাকা মজুরি দেওয়া হয়।
ফেটালিয়া গ্রামের ধনেপাতা চাষি কেশব চন্দ্র দেবনাথ। তার জমিতে ৩০ জন মহিলা শ্রমিক নিয়মিত কাজ করেন। মহিলা শ্রমিকদের দিনপ্রতি দিতে হয় ২০০ টাকা। এলাকার হতদরিদ্র মহিলাদের আয়ের উৎস ধনে ক্ষেতে কাজ করা। তিনি বলেন, এ বছর ৪ বিঘা জমিতে ধনেপাতা চাষ করেছি। দুই বছরের জন্য জমি লিজ নিয়েছি ৬০ হাজার টাকা দিয়ে। বীজ বপন, সেচ দেওয়া, নিড়ানি, কীটনাশক প্রয়োগ, পাতা তোলাসহ বিক্রির আগ পর্যন্ত প্রায় ৮ লাখ টাকা খরচ হয়। আশা করি ১০-১২ লাখ টাকা বিক্রি করতে পারব। বিনিয়োগ করা টাকা ঋণ করে বা সুদে সংগ্রহ করতে হয়। সুদমুক্ত ঋণ পেলে আরও বেশি লাভবান হতে পারতাম। তাছাড়া করোনার কারণে শ্রমিকই পাওয়া যাচ্ছে না। শ্রমিকরা কাজে আসতে ভয় পাচ্ছেন। বাজারজাত করাও সম্ভব হচ্ছে না। অর্থ ও কৃষি শ্রমিকের অভাবে এ বছর হয়তো লোকসান গুনতে হবে তাকে।
একই গ্রামের চাষি জাবেদ আলী বলেন, দুই বিঘা জমিতে চাষ করেছি। খুব বেকায়দায় আছি। করোনার কারণে শ্রমিকের অভাব দেখা দিয়েছে। তাছাড়া কোনো কৃষি কর্মকর্তাও আমাদের ক্ষেতে আসে না। বীজ বপন করলে মাঝে মাঝে চারা উঠে না। ক্ষেতে অনেক রোগ দেখা দেয়। পরামর্শ দেওয়ার মতো কেউ নেই। গাছের পাতা ও মূলে পচন ধরে, ক্ষেতের আংশিক অংশ সাদা হয়ে যায়, পাতা লালচে হয়ে যাওয়াসহ নানা ধরনের রোগ দেখা দেয়। কৃষি অফিসারকে না পেয়ে তখন ওআমরা নিজেরা বুঝে ওষধ দেই। এলাকাশ প্রায় ১০০ বিঘা জমিতে প অর্ধশতাধিক কৃষক ধনেপাতা চাষ করছেন।
এলাকার আরেক ধনে চাষী লেহাজ উদ্দন। এ বছর ২ বিঘা জমিতে বিলাতি ধনে চাষ করেছেন। ইতোমধ্যে ২ লাখ টাকা খরচ করেছেন। তার জমিতে নিয়মিত মহিলা শ্রমিক কাজ করেন ১২ জন। ব্যাং থেকে লোন নিয়ে চাষ শুরু করেছেন। করোনা পরিস্থিতিতে একজনকেও পাওয়া যাচ্ছে না। নিজে ২ বিঘা জমিতে কাজ করতে করতে হাঁপিয়ে উঠছেন। লোকসানের চিন্তায় দু চোখে যেন সর্ষে ফুল দেখছেন।
ধনে চাষী আব্দুল কাদের। ধনে চাষে খরচ করেছেন প্রায় ২ লাখ টাকা। তার ধনে ক্ষেতে কাজ করতেন ১০ জন কৃষি শ্রমিক। করোনার কারনে তিনিও কোন শ্রমিক পাচ্ছেননা।
পরিতোষ বাবু। আরেক সফল ধনে চাষী। তার অধীনে কাজ করতেন ১০/১২ জন ধনে শ্রমিক। শামসুল আলম, কবির হোসেন, আদু মিয়া, শাহজাহান, ওবায়দুল, ফারুক, ডালিম ও মানিক মিয়া নামক ধনে চাষীদের একই অবস্থা। এত দিন যারা তার ক্ষেতে কাজ করতেন করোনার কারণে তারাও আসেননা।
মোক্তারপুর ইউনিয়নের ডেমরা গ্রামের কবির হোসেন, আল-আমীন, জাকির হোসেন, রাথুরা গ্রামের ইউসুফ, কোমদ, বিধান দুর্গাপর ইউনিয়নের ফেটালিয়া গ্রামের রতন সহ অনেকেই এক বিঘা জমিতে বিলাতি ধনে পাতা চাষাবাদ করছেন।
এসব চাষীরা বলেন, এখন ধনে পাতার শ্রমিক পাওয়া কঠিন হয়ে গেছ
কাপাসিয়া উপজেলা কৃষি অধিদফতরের উদ্ভিদ সংরক্ষণ কর্মকর্তা মোখলেসুর রহমান বলেন, কয়েকজন কৃষক ধনেপাতা চাষ করে। আমাদের কাছে প্রকৃত হিসাব নেই। আমি ওই এলাকার উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তাকে বলছি কৃষকদের ক্ষেতে যাওয়ার জন্য।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সুমন কুমার বসাক বলেন, ধনেপাতা দীর্ঘকাল ধরে আমাদের দেশে মসলা হিসেবে ব্যবহার হয়ে আসছে। তরকারি, আচার, চাটনির স্বাদ ও সুঘ্রাণ বাড়াতে এর বেশ কদর রয়েছে। তবে আমার জানা মতে উপজেলায় এত বৃহৎ আকারে ধনেপাতা চাষ হয় না। তবুও আমি খোঁজ নিয়ে দেখছি।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: করোনাভাইরাস

৪ জানুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ