Inqilab Logo

বুধবার, ০৩ জুলাই ২০২৪, ১৯ আষাঢ় ১৪৩১, ২৬ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

নারায়ণগঞ্জে করোনার নমুনা সংগ্রহের নামে চলছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রহসন-ভোগান্তি

নমুনা দিতে এসে এ রোগের প্রাদুর্ভাব আরও ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা, কিছুই জানে না সিভিল সার্জন অফিস

স্টাফ রিপোর্টার, নারায়ণগঞ্জ থেকে | প্রকাশের সময় : ১৮ এপ্রিল, ২০২০, ৬:০৯ পিএম

রোগ নির্ণয়ে দীর্ঘসূত্রিতার কারণে নারায়ণগঞ্জে করোনার প্রাদুর্ভাব বেড়ে চলেছে বলে মনে করা হচ্ছে। নারায়ণগঞ্জ করোনা ভাইরাসের অন্যতম কেন্দ্রস্থল হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার পর এ জেলার জনপ্রতিনিধি থেকে শুরু করে রাজনৈতিক ব্যক্তি এবং সুশীল সমাজের পক্ষ থেকে নারায়ণগঞ্জে করোনা পরীক্ষা ল্যাব স্থাপনের দাবি উঠে। কিন্তু সেই দাবি উপেক্ষিতই থেকে যায়। তবে গত কিছুদিন যাবৎ নারায়ণগঞ্জ থেকেই করোনা উপসর্গ রয়েছে এমন রোগিদের বাড়িতে গিয়ে নমুনা সংগ্রহ করে ঢাকায় আইইডিসিআর-এ পাঠিয়ে আসছিল সিভিল সার্জন অফিস। এক্ষেত্রে সিভিল সার্জন অফিসের পাশাপাশি নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের স্বাস্থ্য বিভাগ থেকেও নমুনা সংগ্রহ করে সিভিল সার্জন অফিসের মাধ্যমে ঢাকায় নমুনা পাঠানো হচ্ছিল।
কিন্তু গত ১৪ এপ্রিল থেকে নারায়ণগঞ্জ হাই স্কুলে কেন্দ্র খুলে জোবেদা খাতুন সার্বজনীন স্বাস্থ্য সেবা (জেকেজি) নামে একটি প্রতিষ্ঠান করোনা উপসর্গ রয়েছে এমন রোগিদের নমুনা সংগ্রহ শুরু করে। হট লাইনে ফোন করে যখন রোগাক্রান্ত মানুষ কাঙ্খিত সেবা বঞ্চিত হচ্ছিল তখন এ ধরণের একটি প্রতিষ্ঠান নমুনা সংগ্রহ করছে জেনে হাফ ছেড়ে বাঁচে নগরবাসী। কিন্তু কার্যক্রম শুরুর মাত্র ৪ দিনের মাথায় এ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বিস্তর অভিযোগ উঠতে শুরু করেছে। সেই সঙ্গে যে প্রক্রিয়ায় এ প্রতিষ্ঠানটি নমুনা সংগ্রহের কাজ করছে তাতে নারায়ণগঞ্জ শহরে করোনা ভাইরাস আরও ভয়াবহ ভাবে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। আর এ প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রমের বিষয়ে কিছুই জানেন না নারায়ণগঞ্জের সিভিল সার্জন। এমন কি ওই প্রতিষ্ঠানের সংগৃহিত নমুনা সিভিল সার্জন অফিসের মাধ্যমে ঢাকায় না পাঠিয়ে তারাই সরাসরি পাঠিয়ে থাকেন। ফলে সংগ্রহিত নমুনা কোথায় কার কাছে কিভাবে পাঠানো হচ্ছে তার কিছুই জানে না সিভিল সার্জন অফিস। এসব বিষয়ে হাইস্কুল কেন্দ্রে গিয়ে প্রতিষ্ঠানটির কর্মরতদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করলে তারা কথা বলতে রাজি হননি। প্রতিষ্ঠানের উর্ধ্বতনদের কারও ফোন নম্বর চাইলেও তারা তা দেননি। উল্টো সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে এ প্রতিবেদকের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন। ওই সময় নমুনা দিতে আসা কয়েকজন রোগি প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদের দুর্ব্যবহারের প্রতিবাদ করেন এবং নমুনা দিতে এসে কী ভোগান্তির শিকার হয়েছেন তা স্বেচ্ছায় এ প্রতিবেদকের কাছে তুলে ধরেন।
গতকাল শনিবার সরেজমিনে নারায়ণগঞ্জ হাইস্কুলে গিয়ে দেখা গেছে স্কুলটির বাইরে ৩/৪শ’ জনের জটলা। সবাই স্কুলের ভেতরে প্রবেশ করতে চাচ্ছেন। সবাই করোনা রোগের উপসর্গ নিয়ে এখানে নমুনা দিতে এসেছেন। কিন্তু তাদের বেশির ভাগই হতাশ হয়ে ফিরছেন। আর যারা নমুনা দেওয়ার জন্য স্লিপ হাতে পেয়েছেন তারাও ২/৩ দিন আগে এই স্লিপ পেয়েছেন। স্কুলের বাইরে প্রতিষ্ঠানটির টানানো ব্যানারে লেখা রয়েছে সকাল ১১টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত নমুনা সংগ্রহ করা হয়। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটিতে কর্মরতরা শুরুর দিন থেকে গতকাল পর্যন্ত সঠিক সময়ে নমুনা সংগ্রহের কাজ শুরু করতে পারেনি।
শনিবার দুপুর ১টায় এ প্রতিবেদক হাইস্কুলের ভেতরে প্রবেশ করে দেখতে পান সেখানে স্লিপ হাতে নমুনা দেওয়ার জন্য অপেক্ষা করছেন ১০-১২ জন। প্রতিষ্ঠানটি তাদের কাজ শুরুর আগে নমুনা সংগ্রহের জন্য এ স্কুলে ৮টি বুথ খোলার ঘোষণা দিলেও বুথ খোলা হয়েছে মাত্র ২টি। প্রতিষ্ঠানের যারা নমুনা সংগ্রহের কাজ করেন তাদের বেশির ভাগকেই দেখা গেছে ভেতরে নিজেদের মধ্যে গল্প করে সময় কাটাতে। অথচ বাইরে অপেক্ষমান অসুস্থ রোগি। যাদের সবারই রয়েছে করোনার উপসর্গ।
নগরের জালকুঁড়ি থেকে করোনা উপসর্গ নিয়ে আসা গার্মেন্ট শ্রমিক ইসমাইল হোসেন বলেন, ৩ দিন পর তিনি গতকাল নমুনা প্রদাণের জন্য সিরিয়াল পেয়েছেন। গত ১৪/১৫ দিন যাবৎ তার জ¦র, কাশি, গলাব্যাথা। লোকমুখে জানতে পেরে এখানে এসেছেন করোনার পরীক্ষা করাতে। কিন্তু গত ৩দিন যাবৎ ঘুরে তারপর গতকাল নমুনা প্রদানের জন্য স্লিপ পেয়েছেন। তার অভিযোগ সকাল ১১টায় নমুনা সংগ্রহের কাজ শুরুর কথা থাকলেও ১ ঘন্টা দেরীতে তারা দুপুর ১২টায় কাজ শুরু করেন। সকাল সাড়ে ১০টায় এসে দুপুর সোয়া ১টা পর্যন্ত নমুনা দিতে পারেননি।
একই অভিযোগ করেন ফতুল্লার শিবু মার্কেট থেকে আসা সিরাজ মিয়া (৫০), ফতুল্লার মাসদাইর থেকে আসা শরীফ (২০) এবং ভোলাইল এলাকা থেকে আসা ফিরোজ (৪০)।
নমুনা দিতে আসা প্রত্যেকের অভিযোগ, নমুনা সংগ্রহকারীরা সঠিক সময়ে কাজ শুরু করেন না। একজন রোগির নমুনা সংগ্রহের পর তারা নিজেদের মধ্যে খোশ গল্প করে সময় কাটান। এতে দিনে ১৫-২০ জনের বেশি রোগির নমুনা সংগ্রহ করা যায় না। অথচ মানুষ আশা নিয়ে এখানে আসেন।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে এ প্রতিবেদক নিজের পরিচয় দিয়ে দায়িত্বরত কারও সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করলে প্রতিষ্ঠানের এক নারী কর্মী ভেতর থেকে একজন পুরুষকে পাঠান। পুরুষ সদস্যটি এসেই বলেন তিনি কোন প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবেন না। প্রতিষ্ঠানের উর্দ্ধতন কারও নাম ও ফোন নম্বর চাইলেও ওই ব্যক্তি তা দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন। এক পর্যায়ে বলে উঠেন, আপনি কেন এখানে প্রবেশ করেছেন? এখানে সাংবাদিকদের প্রবেশ নিষেধ। এরপর ওই পুরুষ ব্যক্তিটি এ প্রতিবেদকের সঙ্গে দুর্ব্যবহার শুরু করেন।
তখন কয়েকজন রোগি এর প্রতিবাদ করে এ প্রতিবেদককে বলেন, ভাই আপনারা একটু লিখেন। এরা মানুষকে সেবা দিতে এসে প্রহসন শুরু করেছে।
এদিকে বিষয়টি জানিয়ে যোগাযোগ করা হলে নারায়ণগঞ্জের সিভিল সার্জন ডা. ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, এরা কাদের অনুমতি নিয়ে কাজ শুরু করেছে, কিভাবে কাজ করছে তার কিছুই আমরা জানি না। এমনকি তারা তাদের সংগৃহিত নমুনা আমাদের মাধ্যমে (সিভিল সার্জন অফিস) ঢাকায় পাঠায় না। ফলে তারা তাদের সংগৃহিত নমুনা কোথায় পাঠায় আমরা সেটি বলতে পারবো না।
সিভিল সার্জন অফিসের নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি সূত্র জানায়, এ প্রতিষ্ঠানটি নিজেদের ডিজি হেলথ আবার কখনও সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে নিজেদের সংশ্লিষ্টতার কথা বলে বেড়ায়। এরা এদের কাজের কোন তথ্য সিভিল সার্জন অফিসকে অবহিত করে না। ফলে এদের বিষয়ে আমাদের কোন আগ্রহ নেই। তাছাড়া এদের কর্মকান্ডের ব্যাপারে বিস্তর অভিযোগ সিভিল সার্জন অফিসেও এসেছে। যোগাযোগ করা হলে নারায়ণগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোঃ জসিম উদ্দিন বলেন, তাদের ব্যাপারে শুনেছি। কিন্তু কাদের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে তারা কাজ শুরু করেছে তা জানি না। এ বিষয়টি আমি উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করবো।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: করোনাভাইরাস

৪ জানুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ