Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সউদীর সকল ফ্লাইট বাতিল, বন্ধ মধ্যপ্রাচ্যের শ্রমবাজার

# দু’লক্ষাধিক কর্মী আটকা পড়েছে # রেমিট্যান্স খাতে বড় ধাক্কা আসতে পারে

শামসুল ইসলাম | প্রকাশের সময় : ১৪ মার্চ, ২০২০, ৮:২৮ পিএম

প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের কারণে সউদীসহ মধ্যপ্রাচ্যের শ্রমবাজার বন্ধ। করোনাভাইরাস ঠেকাতে সউদী সরকার আজ রোববার থেকে দু’সপ্তাহের জন্য সকল আন্তর্জাতিক ফ্লাইট বাতিল করেছে। সউদীসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে ফ্লাইট চলাচল বন্ধ হওয়ায় বিদেশ গমনেচ্ছু ও ছুটিতে আসা কর্মীরা বিপাকে পড়েছে। ফ্লাইট বন্ধ হওয়ায় দু’লক্ষাধিক বিদেশগামী কর্মী দেশে আটকা পড়েছে। বৈধ রিক্রুটিং এজেন্সি ও ট্রাভেলস এজেন্সিগুলো বন্ধ হবার উপক্রম হয়েছে।
সউদী আরবে একজন বাংলাদেশি কর্মীসহ দেশটিতে করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৮৬ জনে। সউদীসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে কর্মী প্রেরণ বন্ধ হওয়ায় আগামীতে রেমিট্যান্স খাতে বড় ধরনের ধাক্কা আসতে পারে। জনশক্তি রফতানির বৃহৎ শ্রমবাজার সউদীতে বর্তমানে ২০ লক্ষাধিক নারী পুরুষ কর্মী কঠোর পরিশ্রম করে সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স দেশে পাঠাচ্ছে। বায়রার একজন শীর্ষ নেতা এ অভিমত ব্যক্ত করেছেন।
করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে অতিসম্প্রতি কুয়েত, কাতার ও মালদ্বীপ বাংলাদেশিসহ সকল দেশের ফ্লাইট বন্ধ করে দিয়েছে। এতে নতুন ভিসাপ্রাপ্ত কর্মী ও ছুটিতে দেশে আসার বিপুল সংখ্যক কর্মী আটকা পড়েছে। শুধু ওমানে কিছু কর্মী যাচ্ছে। করোনাভাইরাস সংক্রান্ত পরিস্থিতিতে গামকার ৬০টি মেডিক্যাল সেন্টারে বিদেশগামী কর্মীর স্বাস্থ্য পরীক্ষাও ৩০% কমেছে। গামকার জেনারেল ম্যানেজার লাহুয়ার হোসেন গতকাল শনিবার এ বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
সউদীসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে জনশক্তি রফতানি বন্ধ হওয়ায় বায়রার ইসির অন্যতম সদস্য মোহাম্মদ আলী গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, করোনাভাইরাস আল্লাহপাকের একটি গজব। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের দরুণ মধ্যপ্রাচ্যে একের পর এক দেশে জনশক্তি রফতানি বন্ধ হচ্ছে। তিনি বলেন, এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে আগামীতে রেমিট্যান্স খাতে বড় ধরনের ধাক্কা আসতে পারে। বায়রা নেতা বলেন, জনশক্তি রফতানিতে অশনি সঙ্কেত শুরু হওয়ায় রিক্রুটিং এজেন্সি ও ট্রাভেল এজেন্সিগুলোতে কাজ কর্ম নেই বললেই চলে। কর্মচারিদের বসিয়ে বসিয়ে বেতন ভাতা পরিশোধ করতে হিমসিম খাচ্ছে এজেন্সিগুলো। বহু এজেন্সির কর্মচারিদের ছুটিতে পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে।
তার মতে, ভ্রাতৃ প্রতীম সউদী আরবের সাথে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সর্ম্পক অত্যান্ত চমৎকার। আল্লাহপাক যেহেতু করোনাভাইরাস থেকে বাংলাদেশকে রক্ষা করছেন সেক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সউদী বাদশার সাথে আলোচনা করে একাধিক বিশেষ ফ্লাইট চালুর উদ্যোগ নিলে সউদীগামী কর্মীরা দ্রুত দেশটি যেতে পারবে। এতে জনশক্তি রফতানির এ খাত বিপর্যয়ের হাত থেকে রেহাই পাবে।
করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে দুই সপ্তাহের জন্য আন্তর্জাতিক সকল ফ্লাইট বাতিল করেছে সউদী আরব সরকার। দেশটির সরকারি সংবাদ সংস্থা এসপিএ গতকাল শনিবার এ তথ্য জানিয়েছে। দেশটির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, আজ রোববার থেকে পরবর্তী দুই সপ্তাহ ফ্লাইট বাতিল থাকবে। খবর রয়টার্সের। এতে সউদীর সর্ববৃহৎ শ্রমবাজার সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে গেলো। সউদী আরবে আগেই ৯টি এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট দেশটিতে চলাচল বন্ধ রাখা হয়েছে। সউদীগামী টিকিট সোনার হরিণে পরিনত হয়েছিল। বিমানের টিকিট না পাওয়ায় অনেক কর্মীর ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে।
বায়রার যুগ্ম মহাসচিব মিজানুর রহমান সউদীর সকল ফ্লাইট বাতিল প্রসঙ্গে বলেন, দেশটিতে জনশক্তি রফতানির দ্বার পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেলো। ফ্লাইট বাতিল হওয়ায় ছুটিতে আসা কর্মীসহ ভিসাপ্রাপ্ত প্রায় দু’লাখ বাংলাদেশি কর্মী আটকা পড়েছেন। এই মুহুর্তে ধৈর্য্য ধারণ করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। তিনি জনশক্তি রফতানির এ খাতের প্রতি সরকারের সতর্ক দৃষ্টি রাখার ওপরগুরুত্বারোপ করেন। তিনি সউদীর বৃহৎ শ্রমবাজার ধরে রাখার স্বার্থে অনতিবিলম্বে সউদীগামী অতিরিক্ত বিশেষ ফ্লাইট চালুর জন্য প্রধানমন্ত্রীর আশু হস্তক্ষেপ কামনা করেন।
এদিকে, সউদীর দায়িত্বশীল সরকারি কর্মকর্তার বরাত দিয়ে জানানো হয়, ফ্লাইট বাতিল হওয়ার কারণে সউদী আরবের যেসব নাগরিক বা দেশটির বাসিন্দারা ফিরতে পারবেন না, তাঁদের জন্য সে সময়টা বিশেষ সরকারি ছুটি হিসেবে গণ্য করা হবে। সউদী আরবে ফেরার পরে যাঁদের কোয়ারেন্টিনে রাখা হবে, তাঁরাও এ রকম বিশেষ ছুটি পাবেন।
বায়রার একাধিক সূত্র জানায়, সাউদিয়া এরাবিয়ান এয়ারলাইন্সের টপ টেন নামের টিকিট সিন্ডিকেট চক্র সউদীগামী কর্মীদের টিকিটের দাম আকাশচুম্বি বাড়িয়ে লাখ লাখ ডলার হাতিয়ে নিয়েছে। রাজশাহী ট্রাভেলসের স্বত্বাধিকারী মুফতী মোস্তাফিজুর রহমান জানান, একজন সউদীদামী যাত্রীর কাছ থেকে ঢাকা টু রিয়াদের টিকিটের দাম ৮০ হাজার টাকা হাতিয়ে নিয়েছে সিন্ডিকেট চক্র। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, করোনাভাইরাসের কারণে একে একে শ্রমবাজারের দ্বার বন্ধ হচ্ছে। আর সিন্ডিকেট চক্রের কাছে মানবতা বলতে কিছু নেই। এরা বিদেশগামী কর্মীদের রক্ত চুষে খাচ্ছে।
এদিকে, সউদী আরবে প্রথমবারের মতো এক বাংলাদেশি প্রবাসী কর্মী প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে বলে জানিয়েছে দেশটির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। তবে তার নাম ঠিকানা এখনও গোপন রাখা হয়েছে। এ ভাইরাসে নতুন করে দেশটিতে একজন বাংলাদেশিসহ মোট ২৪ জন আক্রান্ত হয়েছে। এ নিয়ে মোট আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়াল ৮৬ জনে। শুক্রবার দেশটির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এ সব তথ্য নিশ্চিত করেছে। সউদীসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে বর্তমানে প্রায় ৪০ লাখ বাংলাদেশি বিভিন্ন পেশায় কাজ করছে। করোনাভাইরাসের প্রভাবে অভ্যন্তরীণ চলাচল সীমিত করে দেয়ার কারণে ব্যাঘাত ঘটছে তাদের পেশাগত জীবনযাত্রায়ও।
বিএমইটির তথ্য অনুযায়ী, গত বছরও সবচেয়ে বেশি কর্মী গিয়েছিলেন সউদী আরবে প্রায় ৫৭ শতাংশ। তালিকার দ্বিতীয় ও তৃতীয় অবস্থানের রয়েছে যথাক্রমে ওমান (১০ দশমিক ৩৮ শতাংশ) ও কাতার (৭ দশমিক ১৮ শতাংশ)।
গত মাসের শেষের দিকে সউদী আরব করোনাভাইরাস আতঙ্কে সব ওমরাহ ও পর্যটন ভিসা বাতিল করেছে। সউদী সরকারের কড়াকড়িতে শত শত অবৈধ বাংলাদেশি কর্মী দেশটিতে বৈধ হওয়ার জন্য দূতাবাসে কাগজপত্র জমা দিয়েছে। কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুরোধে সম্প্রতি বিভিন্ন শহরে কনস্যুলেট সেবা বন্ধ করে দিয়েছে রিয়াদস্থ বাংলাদেশ দূতাবাস। ফলে বন্ধ হয়ে গেছে প্রবাসী বাংলাদেশিদের ভিসা, পাসপোর্ট, ইকামা নবায়নসহ নানা ধরনের কার্যক্রম। এতে নির্ধারিত সময়ে নিজ নিজ কাগজপত্র বৈধ করতে না পারা এবং এর ধারাবাহিকতায় আটক হওয়ার আতঙ্ক কাজ করছে প্রবাসীদের মধ্যে। সউদীতে একাধিক সূত্র এসব তথ্য জানিয়েছে।
সম্প্রতি গালফ এয়ারের একটি ফ্লাইটে ঢাকা থেকে ৬৮ জন বাংলাদেশি কর্মী সউদী আরব যাচ্ছিলেন। ট্রানজিট ছিল বাহরাইনে। বিপত্তির সূত্রপাত সেখানেই। কারণ চলমান করোনাভাইরাসের সঙ্কটে বাহরাইনের সঙ্গে আকাশপথে যোগাযোগ বন্ধ করে রেখেছে সউদী আরব। দীর্ঘ সময় বিমানবন্দরে আটকা থাকেন কর্মীরা। পরে বাহরাইনে নিযুক্ত বাংলাদেশ দূতাবাসের সহায়তায় দেশে ফেরত পাঠানো হয় তাদের।
সউদী আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে ছুটি কাটাতে বাংলাদেশে এসেছে, তারাও ফিরতে পারছে না। তবে এক্ষেত্রে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই জানিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন বলেছেন, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে বাংলাদেশি কর্মীরা যারা দেশে এসেছেন, তারা আবার ওইসব দেশে যেতে পারবেন। তাদের ভিসার মেয়াদ বাড়ানো হবে। সম্প্রতি ঢাকায় রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত ও দূতাবাসের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠকের পর সাংবাদিকদের এসব কথা জানান তিনি।
সউদীসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হওয়ায় ধস নেমেছে দেশগুলোর ওমরাহ, পর্যটন ও এয়ারলাইনস ব্যবসায়। এর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে অন্যান্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠানেও। এছাড়া পুঁজি হারানোর ভয় করছেন বিভিন্ন ছোট ও মাঝারি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত বাংলাদেশীরা।
কুয়েতে জনশক্তি রফতানিকারক দিদারুল আলম রাতে ইনকিলাবকে বলেন, কুয়েতে প্রায় আড়াই লাখ বাংলাদেশি কাজ করছে। করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবে কুয়েতে কর্মরত কর্মীরা চরম আতঙ্কে রয়েছে। দেশটিতে ফ্লাইট বন্ধ হয়ে যাওয়ায় প্রায় ত্রিশ হাজার কুয়েতগামী কর্মী আটকা পড়ছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সকল দিকে জনশক্তি রফতানি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আমি নিজেও সরকারকে প্রতি মাসে লাখ লাখ টাকার কর দিতাম তা’এখন দিতে পারছি না। দিদার বলেন, ইনশাআল্লাহ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে ভিসা টিকিটের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়া সবাই পুনরায় কুয়েত যাওয়ার সুযোগ পাবে। এ নিয়ে আতঙ্কিত হবার কিছু নেই বলেও তিনি উল্লেখ করেন।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: করোনাভাইরাস

৪ জানুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ