Inqilab Logo

শনিবার ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৬ আশ্বিন ১৪৩১, ১৭ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরী

মেরুন উৎসব আর নীলের বিষাক্ত রোদন

প্রকাশের সময় : ১২ জুলাই, ২০১৬, ১২:০০ এএম

ইমামুল হাবীব বাপ্পি : ম্যাচের বয়স মাত্র ২৪ মিনিট। দলের প্রধান সেনাপতি আহত হয়ে মাঠ ছাড়ছেন কান্নাভেজা বদনে! পর্তুগিজদের সামনে তখন হয়ত উঁকি দিচ্ছিল এক যুগ আগের ফাইনালের সেই বিষাদময় স্মৃতি। যেদিন ফেভারিট হয়েও অখ্যাত গ্রিসের কাছে হেরে প্রথম কোন বৈশ্বিক ফুটবল শিরোপা জয়ের স্বপ্ন চুরমার হয়েছিল ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোদের। সেদিন অঝোরে কেঁদেছিলেন ১৯ বছর বয়সী রোনালদো। সেই রোনালদো আজও কাঁদলেন। একবার নয়, দুইবার। প্রথমবার কেঁদেছেন আবারো এত কাছে এসেও ব্যর্থ হওয়ার শঙ্কায়। স্ট্রেচারে করে তখন মাঠ ছাড়ছেন আহত পর্তুগিজ যুবরাজ! আর দ্বিতীয়বার কাঁদলেন ম্যাচ শেষে। কিন্তু এই দুই কান্নায় কত ফারাক! সেই কান্না দলেকে এক অনিশ্চয়তার সাগরে ভাসিয়ে দেয়ার। আর এই কান্না আনন্দের সীমানা পেরিয়ে গর্বিত উন্নত শীরের, প্রিয় লাল জার্সি গায়ে দেশকে প্রথম কোন শিরোপা উপহার দেয়ার। ফ্রান্সকে হারিয়ে ইউরোর নতুন চ্যাম্পিয়ন তারা।
পরশু সেন্ট ডেনিসে উয়েফা ইউরোর ফাইনালটি ছিল লাল আর নীলের লড়াই। নির্ধারিত সময়ে লড়াইটা ছিল সমানে সমানে। গোলশূন্য ড্র হওয়ার পর অতিরিক্ত সময়ে লাল দুর্গের বদলি সেনা এদেরের নীল দংশনে আরো নীল হয়ে গেল স্বাগতিক শিবির। লিলি স্ট্রাইকারের ২৫ গজ দূরের আচমকা শটে নতুন চ্যাম্পিয়নকে খুঁজে পায় উয়েফা ইউরো। দশম কোন জাতি হিসিবে ইউরো কাপের শিরোপা দখলে নিলো পর্তুগাল।
কে ভেবেছিল এই পর্তুগাল এবার ইউরোপ সেরার খেতাব গায়ে মাখবে? টুর্নামেন্ট শুরুর আগে যা একটু আলোচনায় ছিলেন তা ঐ রোনালদোর কল্যাণে। অথচ পুরো টুর্নামেন্টে রোনালদো যেমন ছিলেন নিজের ছায়ায়, তেমনি তাদের পথ চলাও ছিল খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। গ্রæপ পর্বে একটা ম্যাচও না জিতে নক-আউট পর্বে পা দেয়া। এরপর নক-আউট পর্বের ৩টি ম্যাচে ভাগ্য তাদের পক্ষে গেল অতিরিক্ত সময়ের গোলে। ইউরোর ইতিহাসে যা একটি রেকর্ড। দলের ব্রাজিলিয়ান কোচ ফার্নান্ডো সান্তোসের এই রক্ষণাত্মক ফুটবলকে অনেকে ‘অসুন্দর ফুটবলের প্রদর্শনী’ও বলেছেন। এতে অবশ্য পর্তুগিজরা মোটেও অখুশি নন। তাদের যে দরকার একটি শিরোপা। তাছাড়া নিজের সামর্থ বুঝেই তো রণকৌশল আঁটবেন সান্তোস! এদিনও তাঁর দলের খেলায় ছিল যেন গোল না খাওয়ার চোয়ালবদ্ধ প্রতিজ্ঞা। যে কারণে ম্যাচের ৮০ মিনিট পর্যন্ত তারা গোলমুখে একটা শটও নিতে পারল না, শুধু ঠেকিয়েই গেল।
প্রথমার্ধে অবশ্য কোন দলই দর্শকদের ভালো ফুটবল উপহার দিতে পারেননি। ২৪তম মিনিটে আসে পর্তুগিজদের সেই শঙ্কটময় ক্ষণ। অষ্টম মিনিটে বলের দখল নিতে গেলে ফ্রান্সের দিমিত্রি পায়েতের সঙ্গে ধাক্কা খান রোনালদো। পড়ে গিয়ে কাতরাতে থাকেন। এরপরও শুশ্রæষা নিয়ে মনের জোরেই হয়তো মাঠে ফিরেছিলেন ‘সিআর-সেভেন’, পায়ে তখন স্কচটেপ লাগানো। কিন্তু ২৪তম মিনিটে মনের জোরের কাছেও হার মানলেন রিয়াল তারকা। স্ট্রেচারে করে কান্নাভেজা বদনে মাঠ ছাড়েন তিনবারের বর্ষসেরা।
আশ্চর্যের ব্যাপার হল রোনালদোর মাঠ ছাড়ার পরই ফরাসিদের আক্রমণেও কেমন যেন ঝিমুনি ভাব চলে আসে। এর আগে একের পর এক আক্রমণে পর্তুগিজ রক্ষণ তটস্থ করে রাখছিলেন গ্রিজম্যান-সিসকোরা। এই ধারা আবার ফিরে আসে ম্যাচের শেষ চতুর্ধাংশে। তবে এসময় স্বাগতিকদের হতাশ করেন গ্রিজম্যান-জিরুদ। খুব কাছ থেকে হেড নিয়েও জালে বল পাঠাতে ব্যর্থ হন আসরের সর্বোচ্চ (৬টি) গোলদাতা গ্রিজম্যান। এর ৬মিনিট পর দূরহ কোন থেকে জালের বাইরে শট নেন জিরুদ। ম্যাচজুড়ে আলো ছড়ানো সিসকোকেও হতাশ করেন পর্তুগিজ গোলরক্ষক। অপরদিকে দলের সেরা তারকার বিয়োগান্তক বিদায়ের সুরই হয়তো আরো দৃঢ়প্রতিজ্ঞ করেছিল পেপে-সানচেসদের। মনে হল, সেই প্রতিজ্ঞা গোল না খাওয়ার। ৮০তম মিনিটে প্রথম লক্ষ্যে শট নেয় তারা। এরপরও নির্ধারিত সময়েই হয়তো চ্যাম্পিয়নের দেখা পেত এবারের ইউরো। কিন্তু নির্ধারিত সময়ের অন্তিম মুহূর্তে বদলি ফরাসি স্ট্রাইকার আন্দ্রে পিয়েরে জিনিয়াকের শট পর্তুগাল ডিফেন্ডার ও গোলকিপারকে ফাঁকি দিয়ে আঘাত হানে বার পেস্টে। প্রথমবারের মত ইউরোর ফাইনাল নির্ধারিত সময়ে গোল থেকেও হয় বঞ্চিত।
অতিরিক্ত সময়ে ডাক আউটে রোনালদোকে দেখা গেল ‘কোচের’ ভূমিকায়। খেলোয়াড়দের উদ্বুদ্ধ করতে থাকেন সাইড লাইনে দাঁডিয়ে। ফার্নান্ডো সান্তোসও খেলোয়াড়দের উদ্বুদ্ধ করেন এই বলেÑ “চলো রোনালদোর জন্য শিরোপাপাটা জিতি।” তাতেই যেন বাড়তি শক্তি ফিরে পান দলের সদস্যরা এদের। ১০৭তম মিনিটে বার পোস্ট তাদের ভাগ্য বঞ্চিত করলেও খানিক বাদে ২৫ গজ দূর থেকে নেয়া এদের আচমকা শটে বুক ভাঙে ফরাসিদের। গ্যালারিতে তখন লাল উৎসব আর নীলের বিষাক্ত রোদন। সংখ্যায় ইউরো ২০১৬ ফাইনাল

৩৫ ম্যাচ খেলার পর ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়ন্সশিপের প্রধম শিরোপা জিতল পর্তুগাল।
১০ ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়ন্সশিপের দশম দেশ পর্তুগাল।
৬ ষষ্ঠ বদলি খেলোয়াড় হিসেবে ফাইনালে গোল করলেন এদের। এর আগে এই কীর্তি গড়েনÑ অলিভার বেয়ারহফ (জার্মানি), সিলভেইন উইতর (ফ্রান্স), ডেভিড ত্রেজেগুয়েত (ফ্রান্স), হুয়ান মাতা (স্পেন) এবং ফার্নান্ডে তোরেস (স্পেন)।
৩ পর্তুগাল একমাত্র দল, যারা একই আসরে তিনটি অতিরিক্ত সময়ে গড়ানো ম্যাচে খেলেছে।
৮০ মিনিট পর্যন্ত লক্ষ্যে কোন শটই নিতে পারেনি পর্তুগাল। ইউরোর ফাইনালে যা দীর্ঘতম সময়ের রেকর্ড।
ইউরোর শেষ ১০ চ্যাম্পিয়ন

সাল স্বাগতিক চ্যাম্পিয়ন রানার্স-আপ
১৯৮৪ ফ্রান্স ফ্রান্স স্পেন
১৯৮৮ পশ্চিম জার্মানি নেদারল্যান্ডস সোভিয়েত ইউনিয়ন
১৯৯২ সুইডেন ডেনমার্ক জার্মানি
১৯৯৬ ইংল্যান্ড জার্মানি চেক প্রজাতন্ত্র
২০০০ বেলজিয়াম ও নেদারল্যান্ডস ফ্রান্স ইতালি
২০০৪ পর্তুগাল গ্রিস পর্তুগাল
২০০৮ অস্ট্রিয়া ও সুইজারল্যান্ড স্পেন জার্মানি
২০১২ পোল্যান্ড ও ইউক্রেন স্পেন ইতালি
২০১৬ ফ্রান্স পর্তুগাল ফ্রান্স



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: মেরুন উৎসব আর নীলের বিষাক্ত রোদন
আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ