নজরুলের ঈদ-ভাবনা
শেখ দরবার আলম॥ এক ॥দৈনিক ইনকিলাবের তরফ থেকে আমাকে নজরুলের ঈদ-ভাবনা ওপর লিখতে বলা হয়েছে। এই বিষয়টিতে সরাসরি যাওয়ার আগে দু’একটা কথা উল্লেখ করতে চাই।কবি
এমাজউদ্দীন আহমদ
অতীতের স্মৃতি সব সময় অত্যন্ত মধুর। হাজারো অনিশ্চয়তায় ভরা বর্তমানের জন্য অনেক সময় মনটা ফিরে যেতে চায় অতীতে। অতীতের সবকিছু যেন আনন্দময়, সুখকর, কাক্সিক্ষত হয়ে ভেসে ওঠে স্মৃতিতে। সবটাই যেন নির্মল। সবটাই আকর্ষণীয়।
ছেলেবেলার সবকথা স্মৃতিতে আসে না। তখনো দুঃখবোধ ছিল। ছিল চাওয়া-পাওয়ার ক্ষেত্রে অপূর্ণতা। গালমন্দ যে ছিল না তা নয়। কিন্তু দীর্ঘদিন পরে অতীতের অন্ধকারের স্মৃতিতে ভেসে ওঠে এক ঝিলিক উজ্জ্বল আলো হয়ে। সাত/আট বছর বয়স থেকে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো এখনো আমার স্মৃতিতে প্রায় স্পষ্ট, কোনো কোনোটা কিছুটা ঝাপসা হলেও অধিকাংশই মনে পড়ে, বিশেষ করে ঈদের দিনের ঘটনাবলি ভুলি কীভাবে? বাবা-মা এবং বেশ ক’জন ভাই-বোনের সমন্বয়ে ছিল আমাদের বড় পরিবার। দাদি বেঁচেছিলেন সবার মুরুব্বি হয়ে। কথা কম বলতেন, কিন্তু যা বলতেন তা হুকুম যেন, অবশ্য পালনীয়। কৈফিয়ত তিনি তলব করতেন। স্কুল থেকে ফিরতে দেরি হলে তার নিকটই জবাবদিহি করতে হতো। স্কুল থেকে ফিরে কে কী খেলো তাও তার দৃষ্টিতে থাকত।
একটা কথা আজকের তরুণ-তরুণীদের জন্য বলা প্রয়োজন এবং তা হলোÑ তখন জীবন ছিল খুব সহজ-সরল। লোকজনের চাহিদা ছিল অত্যন্ত সীমিত। গ্রাম্য জীবনের চাহিদা ছিল সীমিত। গ্রামে জন্মগ্রহণ করি। উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত লেখাপড়াও গ্রামীণ পরিবেশে সমাপ্ত হয়। উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের পরবর্তী পর্যায়ে রাজশাহী কলেজের ছাত্র হই। রাজশাহী কলেজের পরে সোজাসুজি ঢাকায়। রাজশাহী শহরেও তখন ছিল গ্রামীণ ছাপ। বিদ্যুৎ ছিল বটে। কিন্তু বিদ্যুৎচালিত কলকব্জা ছিল না বললেই চলে।
গ্রামের বাড়িতে সন্ধ্যায় দুটো-তিনটে বারান্দায় হ্যারিকেন জ্বলে উঠত। পড়াশোনা, বাড়ির কাজ (যড়সব ড়িৎশ) হ্যারিকেনের আলোয় করতে হতো। কোনো কোনো দিন হ্যারিকেন জ্বালাতে হতো আমাকে, কোনো দিন আমার বড় বোন জ্বালাত। ঈদের রাত্রিতে শুধু বারান্দায় নয়, ঘরে ঘরে আলো জ্বলে উঠত। এই ঘটনা ঘটত ঈদের ক’দিন আগে থেকেই। ওই ক’দিন পড়াশোনা না করলেও কেউ খবরদারি করতেন না। ঈদের দিনের জন্যে মোটামুটি এক ধরনের রুটিন অনুসরণ করা হতো। ছেলেদের জন্যে নতুন পায়জামা, পাঞ্জাবি অথবা শার্ট, একজোড়া জুতা বাবা কিনে আনতেন মালদহ শহর থেকে। মেয়েদের জন্যে শাড়ি এবং স্যান্ডেল, কারো কারো দাবি অনুযায়ী এক গোছা রঙিন চুড়ি, বিভিন্ন রং-এর ফিতা এবং তখনকার দিনে পাওয়া যেত এমন কিছু আবদার করা জিনিসপত্র।
গ্রামে প্রাত্যহিক বাজার ছিল না। মাইল তিনেক দূরে শনি এবং মঙ্গলবারে হাট বসত। সেই হাট থেকে সপ্তাহের জন্যে মাছ এবং গোশত কেনা হতো। সবজি আমাদের শরঃপযবহ মধৎফবহ-এ প্রচুর হতো। আমাদের বাড়িটা ছিল ছয় বিঘা জমির উপর। পেছনে সবজির ক্ষেত এবং তার পরেই আম ও লিচুর বাগান। বাড়ির পূর্বদিকে ছিল ছোট্ট একটা পুকুর। আমাদের বৈঠকখানা ছিল দুটি। একটি ছিল বাড়ি-লাগোয়া। আব্বা তার ঘনিষ্ঠজনদের নিয়ে বসতেন। আর একটা ছিল রাস্তার পাশে অর্থাৎ বাড়ির উত্তরে। আব্বা শিক্ষকতা করতেন। এই সুবাদে স্থানীয় পর্যায়ে কোনো গোলমাল হলে মীমাংসার ভার পড়ত তার উপর। এজন্য সেই বৈঠকখানা ছিল বড় এবং বাড়ির শেষ প্রান্তে।
আমার মনে আছে, যেহেতু ঈদগাহ ছিল আমাদের বাড়ি থেকে মাইল দেড়/দুই দূরে, তাই গরুর গাড়িতে আমাদের যেতে হতো। আমি তো যেতামই, আমার ছোট ভাইও যেত। আগে-ভাগে গিয়ে জামায়াতে শামিল হতাম। নামাজের পরে বাবা-মা এবং দাদিকে কদমবুসি করে সালাম করতাম। ঈদের দিনে যেসব বন্ধু-বান্ধব আশপাশের তারা ছুটে আসত। মা অতি আদরে তাদের খাবার ব্যবস্থা করতেন।
ঈদের জন্য আব্বা যা কিনে এনেছেন, তা যে যার মতো লুকিয়ে রাখত এজন্যে যে, অন্যরা দেখে ওগুলোকে যেন পুরনো না করে দেয়। জুতা পায়ে ঠিকমত লাগছে কীনা তা পরখ করার জন্যে বিছানায় এক-দুবার হেঁটে দেখতাম।
আমাদের গ্রামের মধ্যখানে জুমা মসজিদ। কোরবানির ঈদের দিনে মসজিদের উঠানেই হতো খাসি এবং গরু জবাই। তখনকার দিনে এসব অনুষ্ঠানে গ্রামের সবাই মিলিতভাবে অংশগ্রহণ করতেন। গোশত তৈরি হলে নিয়মমাফিক দরিদ্র মিসকিনদের জন্যে তিন ভাগের একভাগ সুনির্দিষ্ট করা হতো। গ্রামে ওই সময় দেখেছি (১৯৪০-৪২ সময়কালে) মিসকিনদের সংখ্যা ছিল অত্যন্ত কম। ফলে প্রত্যেকের ভাগে পড়ত বেশ পরিমাণ গোশত। চামড়া বিক্রির অর্থ মসজিদের জন্য ব্যয় হতো। মাঝে মাঝে গ্রামে ধর্ম সংক্রান্ত জলসা বসলে সেই খাত থেকে ব্যয় হতো। গ্রামের সর্দার যিনি তিনি এসব দেখাশোনা করতেন। আমাদের গ্রামের শেষপ্রান্তে ছোট্ট এক পাড়ায় কিছুসংখ্যক হিন্দু ধর্মাবলম্বী বাস করতেন। মুসলমানের ঈদেও তাদের অনেকেই আমাদের বাড়িতে আসতেন। আব্বা-আম্মা যতেœর সাথে তাদের জন্যে প্রস্তুত খাবার পরিবেশন করতেন। আমারও কয়েকজন বন্ধু ছিল। তারাও আসত। সবাই মিলে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করে আমরা উপভোগ করতাম। স্কুল কয়েকদিন বন্ধ থাকায় আরো সুবিধা হতো। আমাদের গ্রামের পশ্চিম মাথায় ছিল একটা মাঠ। এখন তা নেই। ওই মাঠে ঈদের দিন বিকেলে কোনো কোনো সময় ফুটবল খেলার ব্যবস্থা হতো। গ্রামের লোকজনের ভিড় সেই খেলাকে জীবন্ত করে তুলত।
সংক্ষেপে আমার ছেলেবেলার ঈদের স্মৃতি অত্যন্ত আনন্দঘন। সবাইকে ঈদ মোবারক বলা, সমবয়সীদের সাথে কোলাকুলি করা, বন্ধু-বান্ধবের সাথে মিলিত হবার সুযোগ সবকিছু মিলিয়ে ঈদ হয়ে উঠত মহা আনন্দের উৎসব। কোনো কোনো সময় খেলাধুলার আয়োজন করে সবাই মিলে মেতে ওঠা ছিল ভয়ঙ্কর সুখকর। আধুনিক কালের টেলিভিশন বা রেডিওর মাতামাতি ছিল না বটে, ছিল না নতুন নতুন মোবাইল বা অন্যান্য চিত্তাকর্ষক আধুনিক সাজসরঞ্জাম, কিন্তু ছিল আদি অকৃত্রিম আনন্দের ঘন আস্তরণ।
ঈদের দিনকয়েক আগে থেকেই শুরু হয়ে যেত ঈদের আনন্দ। গ্রামের এখানে ওখানে ছিল খেলার মাঠ। শুরু হতো নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা। এখনকার মতো নগর জীবনের ইট-পাথরের জঙ্গল তখন গ্রামে ছিল না। ছিল না দয়া-মায়াহীন রুক্ষ পরিবেশ। সুন্দর সবুজের মেলায় গ্রাম্য জীবনের প্রবাহ সবাইকে কাছে টানত। সবাই মিলে যে হৈ-চৈ করতাম তা স্মরণ করলে আজও অতীতে ফিরে যাই। সব পরিচিত মুখ মনে করে মুগ্ধ হই।
লেখক : সাবেক ভিসি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।