Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

মুসলিম বিশ্বে উগ্রবাদের মূলে পাশ্চাত্য শক্তি

প্রকাশের সময় : ৪ জুলাই, ২০১৬, ১২:০০ এএম

ড. মুহাম্মদ সিদ্দিক
মুসলিম বিশ্বের বর্তমান ফোকাল পয়েন্টে (কেন্দ্রীয় বিন্দু) পরিণত হয়েছে সিরিয়া প্রশ্ন। সরকার ও সরকার বিরোধী যুদ্ধ ও সন্ত্রাসে এর ভিতরেই জান দিয়েছে তিন লাখের কাছাকাছি মানুষ। হানাহানি থামার লক্ষণ নেই। দুইয়ের অধিক গোষ্ঠী বা দল সেখানে একে অন্যের গলা কাটতে তৎপর। যদি হানাহানি বন্ধ না হয় সমস্যার সমাধানে সিরিয়াকে আরও কয়েক টুকরা করে শান্তি ফেরাতে হবে। উল্লেখ্য, সিরিয়া এর আগেই ফিলিস্তিন, লেবানন ও গোলান হাইটস খুইয়েছে ইউরোপীয় ষড়যন্ত্রে। মুসলমানদের বর্তমান অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে মার্কিন সাবেক জেনারেল পেট্রাউস (সাবেক প্রধান গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ) বেজায় খুশি। তার ধারণা, ‘ক্লাস অব সিভিলাইজেশন’ (সভ্যতার সংঘাত) এর পূর্বে একটা সভ্যতা নিজেদের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে দুর্বল হয়ে পড়লে দ্বিতীয় পর্বের সভ্যতার সংঘাত জেতা তাদের জন্য সহজতর হবে। মুসলমানদের নিয়ে হাল্টিংটনের সভ্যতার সংঘাত এর পর এখন জেনারেল পেট্রাউসের “অভ্যন্তরীণ সংঘাত” এলো। একটার পিঠে আর একটা দুই স্তরে বাস্তবায়নের জন্য।
মুসলিম বিশ্বে যে এই উগ্রতা তার জন্য কি মুসলমানরা একা দায়ী না অন্যরাও? ১১ মে উত্তর বাগদাদে শিয়া-অধ্যুষিত সদর সিটি এলাকায় সকাল ১০টায় গাড়িবোমা হামলায় ৬৪ জন নিহত হন আর কমপক্ষে ৮৭ জন আহত। এর ভিতরে ছিল বহু নারী ও শিশু। একই দিন ইরাকের কাদিমিয়া ও জামিয়া শিয়া এলাকায় আরও অন্তত ১৭ ও ১৩ জন নিহত হন। আইএস দায় স্বীকার করেছে। আইএস খিলাফত চায়। তবে এই হত্যাকা- কি শরিয়তসম্মত? এটা কি জিহাদ হলো? আইএস ও তার বিরোধীরা সমানে মুসলমান মারলেও কিন্তু ইসরাইলিদের গায়ে হাত দেয়নি। এদিকে অভিযোগ রয়েছে, আইএস ইসরাইলি ব্রেন চাইল্ড মুসলমানদের ভিতর ‘অভ্যন্তরীণ সংঘাত তত্ত্ব’ বাস্তবায়নে। অতীতেও ইহুদি অধ্যুষিত নিউইয়র্কের কেন্দ্রস্থলে টুইন টাওয়ার ধ্বংসে খ্রিস্টান মুসলমান সবাই নিহত হলেও একজন ইহুদিও সেদিন নিহত হলো না। কারণ তারা কেউই সেদিন সেই ভবনগুলোতে ডিউটিতে যায়নি। এটা কি কারও ‘মাস্টার প্লানিং’ নয়? আসলে ইসরাইলি মোসাদ হলো সুপার ইন্টেলিজেন্স। এরা মুসলমান দিয়েই তাদের কাজ হাসিল করে। কিন্তু তা ঘুণাক্ষরে বোঝার উপায় নেই। তথাকথিত মুসলিম উগ্রবাদীরা মুসলিম হত্যা করলেও ইসরাইল কোনো টার্গেট নয় তাদের। আসলে এসব বিপ্লবী সংগঠনে সব ধরনের যুবক সংগঠিত হয়েছে, কেউ সত্যিই ইসলাম-পন্থি, কেউ ইসলামী সমাজতন্ত্রী, কেউ সমাজতন্ত্রী-সেক্যুলারপন্থি, আর কেউ পাশ্চাত্য ও ইসরাইলের গোয়েন্দা সংস্থার কর্মীÑ এ যুগের শত শত লরেন্স অর আরাবিয়া। ব্রিটিশ গোয়েন্দা কর্মকর্তা লরেন্সকে নিযুক্ত করা হয়েছিল আরব মুলুককে তুর্কি খিলাফত থেকে বিচ্ছিন্ন করতে।
এই মুসলিম ‘এংরি ইয়ং ম্যান’ ক্রুদ্ধ যুবকদের ভিতর উগ্রবাদ এলো এর একটা সুন্দর ব্যাখ্যা দিয়েছেন বিশিষ্ট নিরাপত্তা বিশ্লেষক অবসরপাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এস সাখাওয়াত হোসেন ‘আল-কায়েদা ও আইএস : কতখানি ঝুঁকিতে আমরা?’ শীর্ষক নিবন্ধে ৯ মে ২০১৬-এর ‘প্রথম আলো’ দৈনিকে। আমি চিন্তাবিদদের পুরো নিবন্ধটি গভীরভাবে পাঠ করতে সুপারিশ করছি। সাবেক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল লেখেন, “সাদ্দাম হোসেনের সাবেক সামরিক বাহিনীর সুন্নি সদস্যরা যোগ দেয় (আইএসে)। বর্তমানে আইএসের কৌশল আল-কায়েদা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। এসব বিষয়ে যারা গবেষণা করছেন তাদের মতে, আইএস এবং আল-কায়েদা উভয়ের লক্ষ্য এক হলেও তারা দুই ধারার গেরিলা যুদ্ধের কৌশল ধারণ করেছে। আল-কায়েদা মাও সে তুংয়ের গেরিলা কৌশল ধারণ করে বিস্তার করছে। অপরদিকে অস্ত্র-অর্থ আর সিরিয়া ও ইরাকের কিছু ভূখ-ের দখলে থাকা আইএস চেগুয়েভার ‘ফকোইস্ট’ (ঋঙঈঙওঝঞ) কৌশল ধারণ করেছে। আর এই আগ্রাসী গেরিলা তত্ত্বের তাত্ত্বিক উদ্ভাবক ছিলেন ফ্রান্সের বিপ্লবী চিন্তাবিদ রেগিস ডেবরে (জঊএওঝ উঊইজঅণ)। এই তত্ত্বকে শাণিত করেন গুয়েভারা কিউবার বিপ্লবে। ফকোইস্ট তত্ত্বের মূলমন্ত্র হলো সুযোগ বা পরিবেশ তৈরির অপেক্ষায় নয়, শক্তি সঞ্চয় করে টার্গেটের ওপর পূর্ণ শক্তি দিয়ে আক্রমণ রচনা করতে হবে এবং বিভিন্ন আগ্রাসী কর্মকা-ের মাধ্যমে প্রতিপক্ষের মধ্যে ভীতি পরিবেশ তৈরি করে লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যাওয়া। অপরদিকে মাও সেতুং জনযুদ্ধের যে তত্ত্ব দিয়েছিলেন তাতে প্রথমে জনগণকে সঙ্গে নেওয়ার এবং জনসমর্থনের, তা যত গৌণই হোক প্রয়াস নিয়ে অনুকূল পরিবেশ তৈরি করার পর চূড়ান্ত লক্ষ্যে যাওয়ার জন্য শক্তি প্রয়োগ করা। আল-কায়েদা বর্তমানে মাও সেতুংয়ের গেরিলা কৌশল ধারণ করেছে বলে একাধিক গবেষণায় প্রতীয়মান।”
অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আরও লেখেনÑ “অবশ্য আইএস আল-কায়েদার (মাও সেতুংভিত্তিক) এ তত্ত্বকে অতি পুরনো আর ধীরগতির মনে করে। গবেষকরা মনে করেন, আইএসের ফকোইস্ট তত্ত্বের বেশ কিছুটা স্বার্থকতার কারণ সিরিয়া ও ইরাকের পরিস্থিতি। সিরিয়া আর ইরাকের অবস্থার উন্নতি বিশেষ করে সিরিয়া সমস্যা সমাদানের ওপর নির্ভর করছে আইএসের ফকোইস্ট তত্ত্ব এবং অন্যতম জিহাদি গ্রুপ হিসেবে আইএসের টিকে থাকার বিষয়টি। সিরিয়া পরিস্থিতির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে আইএস দুর্বল হতে থাকলে আল-কায়েদার শক্তি বাড়বে। আল-কায়েদার তত্ত্ব ধীরে অগ্রসর হওয়া এবং জনগণের একাংশের সহানুভূতি অন্তত কিছুটা অর্জিত হলেই লক্ষ্য পূরণে বিভিন্ন টার্গেট অঞ্চলে চূড়ান্ত সংঘাতের সূচনার পথ ধরা।” অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেলের মূল্যবান সমীক্ষার অংশবিশেষের উদ্ধৃতি উপরে শেষ হলো।
আসলে আইএস বা আল-কায়েদা চেগুয়েভারা তথা রেগিস ডেবরে বা মাও সেতুং যারই গেরিলা কৌশল গ্রহণ করুক শরিয়তপন্থি না হলে তা বৃহত্তম মুসলিম সমর্থন পাবে না। শরিয়ত নির্মমতা তথা বেসামরিক ব্যক্তির হত্যা একেবারেই সমর্থন করে না। কথা হলো খিলাফতের নামে এই নৃশংসতা কেন? তবে ন্যাটো বাহিনী, রুশ বাহিনী ও আসাদ বাহিনীর নৃশংসতাও কম নহে। খামাখা বলা হয় যে, মাদ্রাসায় পড়ে এরা এমন হয়েছে। সোভিয়েতবিরোধী তালেবানরা বেশির ভাগ মাদ্রাসা পড়–য়া ছিল, কারণ তখন পাশ্চাত্য শিক্ষিত তরুণরা সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরোধিতা করতে চায়নি। তাই সিআইএ মাদ্রাসার তালবে এলেমদের রিক্রুট করে। যাই হোক পরবর্তীতে তালেবান আফগান স্বাধীন চেতা বৈশিষ্ট্যের কারণে সিআইএর নিকট নতজানু না হওয়াতে মার্কিন আগ্রাসনের শিকার হয়। তালেবানরা সামরিকভাবে উৎখাত হওয়ার পর পাক প্রেসিডেন্ট জেনারেল মোশাররফ যুক্তরাষ্ট্রকে পরামর্শ দিয়েছিলেন, সামরিক জয়ের পরপরই রাজনৈতিক সমাধান করার। অহঙ্কারী যুক্তরাষ্ট্র তা না করাতে এখন ‘এনড্লেস’ অনন্তকালীন বিরতিহীন ‘ওয়ার অন টেরর’ চলছে। তখন ওটা সীমাবদ্ধ ছিল আফগানিস্তানে মাদ্রাসার ছাত্রদের নিয়ে। এখন এটা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে, যাতে শ্বেতাঙ্গ-শ্বেতাঙ্গিনী নব্য মুসলিমসহ পাশ্চাত্যের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পড়া ছেলেমেয়েরা পর্যন্ত রোমান্টিক আবেগে জড়িয়ে পড়েছে মধ্যপ্রাচ্যে। এরা স্পেনের ডিক্টেটর জেনারেল ফ্রাঙ্কোর আমলের সিভিল ওয়ারে (১৯৩৬-৩৯) সমগ্র বিশ্ব থেকে সমাজতন্ত্রীদের স্পেনে এসে অস্ত্র হাতে নেওয়ার মতো। সামজতন্ত্রী রিপাবলিকানরা অবশ্য হিটলার মুসোলিনীর বন্ধু, জেনারেল ফ্রাঙ্কোর সঙ্গে যুদ্ধে পেরে ওঠেনি শেষ পর্যন্ত।
মাদ্রাসা তো সেই ৬২২ খ্রিস্টাব্দ থেকেই আছে মদিনার মসজিদ তথা আসহাবে সুফফার হোস্টেল বা ‘ইন’-এর মাধ্যমে (তা তো লন্ডনের লিংকনস ইনের ও পুরনো)। তবে ড. মোঃ আবদুস সাত্তারের মতে, ৬১০ খ্রিস্টাব্দের তিন বছরের মধ্যে মক্কার ‘দারুল আরকান’ই ছিল প্রথম মাদ্রাসা নবী (সা.)-এর জামানায়। (‘বাংলাদেশে মাদ্রাসা শিক্ষা ও সমাজ জীবনে তার প্রভাব’, পৃষ্ঠা : আট-নয়)। মাদ্রাসা শব্দের শাব্দিক অর্থ দারুস বা বক্তৃতা দেয়া ও শোনা। ইহুদিরাও মাদ্রাসা শব্দ ব্যবহার করত। ইংরেজ গভর্র্নর লর্ডওয়ারেন হেস্টিংস ১৭৮০ সালে কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করলেন। ১৭৯৩ সালে শিক্ষার উদ্দেশ্যে দানকৃত নিস্কর লাখেলাজ সম্পত্তি সরকারি ডিক্রির মাধ্যমে সরকারি সম্পত্তিতে পরিণত হওয়ায় সমগ্র বাংলার এক লাখ প্রাথমিক মাদরাসা বন্ধ হয়ে যায়। ১৮৩০ সালের এক ফরমানে বলা হয়, অফিস-আদালতে ক্রমান্বয়ে ইংরেজি ভাষা ফার্সির স্থলাভিষিক্ত হবে। এদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় ভাষাগত ও কাঠামোগত শিক্ষাক্রমে পরিবর্তনের মাধ্যমে শিক্ষা খ্রিস্টকরণের এক চক্রান্ত প্রতিফলিত হয় ১৮৩১ সালের শিক্ষা কমিটির রিপোর্টে। উক্ত রিপোর্টের মাধ্যমে তারা এদেশে নব প্রতিষ্ঠিত কলেজসমূহে তাদের খ্রিস্ট ধর্মীয় প্রচার এবং প্রক্রিয়াগত সাফল্য তুলে ধরেন। এতে তারা আরও আশাবাদ ব্যক্ত করেন যে, এ প্রজন্মে যাই হোক পরবর্তী প্রজন্মে এদেশের মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি খ্রিস্টধর্মের প্রতি আরও আকৃষ্ট হবে। (ড. সাত্তার, পৃষ্ঠা : ১৩০; সৈয়দ মোহাম্মদ, হিস্টরি অব ইংরিজ এডুকেশন, পৃষ্ঠা ৩৫) ১৮৩০ সালের এক ফরমানে বলা হয়, অফিস-আদালতে ক্রমান্বয়ে ইংরেজি ভাষা ফার্সির স্থলাভিষিক্ত হবে। ১৮৩৫ সালে আরও এক ফরমানে বলা হয়, একমাত্র ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে ইউরোপীয় জ্ঞান-বিজ্ঞান, সাহিত্য ও সংস্কৃতি শিক্ষা দেয়া হবে। ১৮৩৭ সালের ফরমানে বলা হয়, অফিস-আদালতে ফার্সি লেখা চলবে না। মোট কথা ১৮৩০ সাল পর্যন্ত মাদ্রাসাই ছিল এ দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এর পর থেকেই পশ্চিমি স্কুল-কলেজের দাপট শুরু। আর সেই যুগে তো ইউরোপেও মাদ্রাসা ছিল। স্পেনের গ্রানাডা শহরে আমার স্ত্রী ও আমি দেখেছি কর্ডোভা মাদ্রাসা ভবন, যার ব্রাকেটের নাম হলো ইউনিভারসিটি অব গ্রানাডা। স্পেনীয় কর্তৃপক্ষ বলতে চায় যে, তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্বতন নাম ছিল মাদ্রাসা।
এই যে উগ্রবাদ আধুনিক মুসলিম যুবকদের ভিতর, এর জন্য পাশ্চাত্য সম্পূর্ণ দায়ী। মুসলিম সমাজে উগ্রবাদ ছিল না, যেহেতু ‘ফিতনা’ হারাম। পাশ্চাত্য শিক্ষা সংস্কৃতির মাধ্যমে এটা এসেছে মুসলিম এলাকায়। পাশ্চাত্যই যে উগ্রবাদেও সূতিকাগার এটার প্রকৃষ্ট উদাহরণ তাদের জেরুজালেম তথা ফিলিস্তিন নীতি সেই অতীত থেকে। সেই সঙ্গে এ প্রশ্নে মুসলিম নীতি মিলিয়ে দেখুন। ৭০ খ্রিস্টাব্দে রোমান সেনাপতি টাইটাস জেরুজালেম অবরোধ করে ধ্বংস করেন। তিনি কমপক্ষে দশ লক্ষ ইহুদি হত্যা করেন ও জীবিত ইহুদিদের যুদ্ধবন্দী হিসেবে রোম তথা ইউরোপে নিয়ে যান। এ ঘটনার নয় বছর পর ৭৯ খ্রিস্টাব্দে ইতালির ভিসুবিয়াস আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণে পম্পে ও হার কুলানিয়াম শহর সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়। অনেকেই মনে করেন যে, এটা ইহুদিদের ও নব্য খ্রিস্টানদের ওপর রোমান জুলুমের খোদায়ী শাস্তি। আমার স্ত্রী ও আমি ধ্বংসপ্রাপ্ত দুটো শহর ও ভিসুবিয়াসের পাদদেশ দেখেছি। আমারও ধারণা, ৭৯-এর আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণ খোদায়ী শাস্তিই ছিল। উল্লেখ্য, রোমান স¤্রাট নিরেন (৫৪-৬৮ খ্রিস্টাব্দ) ছিলেন মা ও গর্ভবতী স্ত্রী হন্তা, নব্য খ্রিস্টানদের রঙ্গমঞ্চে সিংহভাগ দিয়ে ভক্ষণ করার হুকুম দাতা। ভিসুবিয়াসের বিস্ফোরণ এই জুলুমশাহীর বিরুদ্ধে ছিল খোদায়ী শাস্তি। জোসেফাইন বেকন সম্পাদিত ‘দি লামট্রেটেড আটলাস অব জুয়িস সিভিলাইজেশন’।
(কোয়ান্টাম বুকস লন্ডন) গ্রন্থে লেখা আছে, (রোম সেনাপতি) টাইটাস জুডিয়ার শতকরা পঁচিশ ভাগ ইহুদিকে নিশ্চিহ্ন করেন এবং বাকি দশ ভাগকে দাস করে (পৃষ্ঠা-৪৭)
এর সঙ্গে তুলনা করুন খলিফা হযরত ওমর উটের লাগাম ধরে জেরুজালেমের দখল নিলেন ৬৩৮ সালে আত্মসমপর্ণের পর একটা মানুষকে হত্যা করেনি মুসলমান সেনাবাহিনী। স্যার উইলিয়াম ফিটজজেরাল্ড মন্তব্য করেন, “সেই সময় পর্যন্ত কখনই নয় কোনো বিজয়ের দুঃখজনক কাহিনীতে এবং তার পরে ক্রমেই এমন মহান ও উদার অনুভূতি প্রকাশ করেন কোনো বিজয়ী যা করেন ওমর জেরুজালেমে।” (ওয়ালিদ খালিদির ‘ইন দেয়ার ডায়াসপোরা’ গ্রন্থে উদ্ধৃত সৈয়দ ইকবাল জহির, এই সর্ট হিস্টরি অব্্ ইসরাইল ইকরা ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট বাঙ্গালোর পৃ.-২১)। পিকে হিট্টি লেখেন যে, আত্মসমর্পণের পর জেরুজালেমের প্রধান প্রাদ্রী সফ্রোনিয়াস ওমরের সাধারণ চালচলন ও সাদাসিদা পোশাক দেখে বলেন যে, এরূপ বর্ণনা তো প্রফেট দানিয়েল দিয়ে গেছেন (হিস্টরি অব দি এরাবস, পৃষ্ঠা-১৫৪)। এই মহান ব্যক্তিকে নিয়ে কবি নজরুলের লেখা কবিতা উমর ফারুককে পর্যন্ত পাঠ্যপুস্তক থেকে সম্প্রতি বাদ দেওয়া হয়েছে।
ক্রুসেডাররা নৃশংস হত্যাকা- চালায় আরব ভূমিতে। এতে যারা অংশ নেয় প্রায়ই জার্মান উপজাতি, যারা তখন ফ্রাঙ্ক নামে পরিচিত। ১০৯৯ সালে জেরুজালেমে ঢুকে তারা চালায় ‘সব বয়সের ও লিঙ্গের মানুষের ওপর লাগামহীন হত্যাকা-’ (পিকেহিট্টি পৃষ্ঠা-৬৩৯)। প্রত্যক্ষদর্শী রেমন্ড ভি এজাইলেস বর্ণনা করেন, ওমরের মসজিদের দর-দালানে রক্ত জমা হয় হাঁটু পর্যন্ত আর রক্ত ঘোড়ার জিন পর্যন্ত পৌঁছে। (মিকড, হিস্টরি অব ক্রুসেডস) সব বন্দীকে যারা মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়া যেতে চেয়েছিল, নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। (মিলস, হিসটরি অব দি ক্রুসেডস)। সত্তর হাজার জেরুজালেমবাসীকে হত্যা করা হয় (সৈয়দ আমীর আলীর হিস্টরি অব দি সারাসেনস, পৃষ্ঠা-৩২৮)। অথচ এই শহরে কোনো বন্দীকে হত্যা করেন নাই খলিফা ওমর ও সালাউদ্দিন আইয়ুবী।
১১৮৭ সালে সালাউদ্দিন আইয়ুবী ফ্রাঙ্ক জার্মানদের হাত থেকে জেরুজারেম উদ্ধার করেন। এর পরে আক্কা শহর দুই বছরে ধরে (১১৮৯-১১৯১) ক্রুসেডররা অবরোধ করে রাখে। আক্কার পতন হয় ক্রুসেডরদের নিকট। আত্মসমর্পণের একটা শর্ত ছিলÑ দুই লাখ স্বর্ণ মুদ্রা মুক্তিপণ হিসেবে শোধ করলে মুসলিম বন্দীদের ছেড়ে দেয়া হবে। যখন এক মাসের ভিতর অর্থ পরিশোধ করতে দেরি হলো, ইংরেজ রাজা রিচার্ড সাতাইশ হাজার মুসলিম বন্দীকে হত্যা করলেন। পিকে হিট্টি লেখেনÑ ‘এই কার্যক্রম সালাউদ্দিন কর্তৃক জেরুজালেম দখলের পর স্বাধীন বন্দীদের সঙ্গে তার ব্যবহারের স্পষ্ট বিপরীত। সালাউদ্দিনও তখন খ্রিস্টান বন্দীদের মুক্তির জন্য মুক্তিপণ নির্ধারণ করেন। তবে কয়েক হাজার গরিব খ্রিস্টান বন্দী মুক্তিপণ দিতে অসমর্থ ছিল। সালাউদ্দিন তার ভাইয়ের অনুরোধে এক হাজার গরিব খ্রিস্টান বন্দীকে বিনা মুক্তিপণে ছেড়ে দেন; খ্রিস্টান পাদরির অনুরোধে আর একদল খ্রিস্টানকে ছাড়া হয় বিনা মুক্তিপণে। যখন সালাউদ্দিন দেখলেন যে, তার ভাই ও খ্রিস্টার পাদ্রি সওয়ার অর্জন করেছেন, আর তার নিজের সময় এসেছে এখন, তখন সালাউদ্দিন বহু নারী ও শিশুসহ বাকি খ্রিস্টান বন্দীদের অনেককে বিনা মুক্তিপণে ছেড়ে দেন।’ (পৃষ্ঠা-৬৫১)। জেরুজালেমে খ্রিস্টান, মুসলমান এমনকি ইহুদিদের কার্যক্রম স্পষ্ট প্রমাণ দেয় যে, মুসলমানরা উগ্রবাদী নয়। এদোষে দোষী অন্যরা। ইউরোপে দ্বিতীয় তথাকথিত শতবর্ষব্যাপী যুদ্ধ, যা আসলে ১১৬ বছর ধরে চলে ১৩৩৭ থেকে ১৪৫৩ সাল পর্যন্ত। জন ভ্যান ডুন সাউথ ওয়ার্থ লেখেন, “ইংল্যান্ডের পাঁচ রাজা, ফ্রান্সের পাঁচ রাজা এবং কমপক্ষে ফরাসি ও ইংরেজ জাতির তিন প্রজন্ম সত্যিকারের শান্তির স্বাদ থেকে বঞ্চিত ছিল।” (দি হিস্টরি অব দি ওয়ার্ল্ড, পৃষ্ঠা-১৭৮)
ত্রিশ বর্ষব্যাপী যুদ্ধ (১৬১৮-১৬৪৮) যা পশ্চিম ইউউরোপে দ্বিতীয় রোমান ক্যাথলিক ও এটেসটান্টদের ভিতর। তাতে হলি রোমান সা¤্রাজ্যের প্রায় অর্ধেক মানুষ নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় (সাউথ ও ওয়ার্থ, পৃষ্ঠা-২১৬)। হলি রোমান সা¤্রাজ্যের ভিতর ছিল জার্মানি, অস্ট্রিয়া, সুইজারল্যান্ড, লাইকটেনস্টেন, লুকসেমবাগ, চেক রিপাবলিক, স্লোভেনিয়া বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ডস এবং আধুনিক পোল্যান্ড, ফ্রান্স ও ইতালির বৃহত্তর এলাকা। মনে করুন এই বিশাল এলাকা ইতালি থেকে নেদারল্যান্ডস পর্যন্তÑ তার অর্ধেক লোক খ্রিস্টানরা হানাহানি করে হত্যা করেছে। কীভাবে ইউরোপীদের উদার বলা যেতে পারে।
ফরাসি বিপ্লবেও (১৭৮৯) চলে নৃশংসতা। বিপ্লবীদের ‘রেন অব টেরর’ (সন্ত্রাসী শাসন), গিলোটিনে কলা কাটা চলে নির্মমভাবে বিরোধী রাজনৈতিক পক্ষকে খতম করছে। সাউথওয়ার্থ লেখেছন : ‘হাজার হাজার মানুষকে মৃত্যুদ- দেওয়া হয় কোনো রকম সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ বিচার ছাড়াই’ (পৃষ্ঠা-২৯০)। প্রথম এই বিশ্বযুদ্ধ, জার্মানির হিটলারের নাৎসিবাদ, ইতালির মুসোলিনির ফ্যাসিবাদ, রুশ বিপ্লব, মাও বিপ্লব, আরবদের উৎখাত করে ইসরাইল প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি নানা ঘটনা ছিল সহিংস ও রোমহর্ষক। এসবের প্রভূত প্রভাব মুসলিম তরুণদের ওপর এসেছে। এ ছাড়া রয়েছে খ্রিস্টান মিশনারিদের এক তত্ত্ব। তারা অন্যান্য জাতি ও বর্ণের ধর্মপ্রচারের সফর হলো, কিন্তু যখন মুসলমানদের ধর্মান্তরে ব্যর্থ হলো তারা ভাবল যে, একবারে মুসলমানদের খ্রিস্টান করা যাবে না। ধাপে ধাপে করতে হবে। প্রথমে তাদেরকে পশ্চিমি শিক্ষা দিতে হবে। এর ফলে তারা পশ্চিমের দার্শনিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক প্রভৃতি তত্ত্ব শিখবে। শিখবে জাতীয়তাবাদ, সেক্যুলারিজম, কমিউনিজম, সমাজতত্ত্ব বিবর্তনাবাদ ও আরও সব পশ্চিমা ‘বাদ’ ও পশ্চিমা সংস্কৃতি। এতে মুসলমানদের নিজস্ব চিন্তা চেতনা দুর্বল হবে। মুসলমানরা নিজেদের বৈশিষ্ট্যকে অবহেলা, ঘৃণা করবে। দ্বিতীয় ধাপে তাদের এজেন্ডা বাস্তবায়ন হবে। ঠিক এরকম কথাই ব্রিটিশ বুদ্ধিজীবী লড ম্যাকলে বলেছিলেন ব্রিটিশ ইন্ডিয়া দখলের রাখতে। তিনি এমন শিক্ষাব্যবস্থার সুপারিশ করলেন যাতে ন্যাটিভদের একটি অংশ চেহারায় ইন্ডিয়ান কিন্তু মগজে হবে ব্রিটিশ। মিশনারিদের এজেন্ডা নিয়ে তথ্য পেতে দেখুন অধ্যাপক উইলিয়াম মন্ট গোমারির লেখা ‘হোয়ার্ট ইজ ইসলাম?’ (প্রকাশক লং ম্যানস লন্ডন, পৃষ্ঠা-১৪৫-১৪৮)।
উগ্রবাদ মুসলিম ধর্ম শরিয়ত ও সমাজে ছিল না। এটা পাশ্চাত্যের সৃষ্টি। আর এটার অন্যতম কেন্দ্র ছিল জার্মানি। বহু ধরনের উগ্রতার সূতিকাগার জার্মানি। বর্তমানে জার্মানি কিছুটা নমনীয় হলেও তাদের পূর্বতন নেতা ও বুদ্ধিজীবীদের ধ্যান-ধারণা ও কর্মকা- পৃথিবীতে অনিষ্ট সৃষ্টি করেছে। যে মানসিকতা তারা শুরু করেছিলেন, তা এখন সমগ্র পৃথিবীতে ছড়িয়েছ। মুসলমানরা এর বড় শিকার এই সময়ে। অনেক শিক্ষিত মুসলমান এখন নিজধর্ম আদর্শ সংস্কৃতির প্রতি বিরূপ। তাদের সহজেই ব্যবহার করছে পাশ্চাত্য ও অন্যান্যরা। বহির্বিশ্বের গোয়েন্দা পদ্ধতি ও চালাকি ধরতে তার অক্ষম। আমাদের পুলিশের আইজি এ কে এম শহীদুল হক বলেন, এসব হত্যাকা-ের পরপরই আইএস দায় স্বীকার করে বিবৃতি দিয়েছে বলে ইন্টারনেটে প্রচার করা হয়। ইসরায়েলের এক নারী একটি ওয়েবসাইট খুলে এই বিবৃতি দিয়ে থাকেন। ইসরাইলের বিরুদ্ধে কিন্তু আইএস কোনো কথা বলে না। (প্রথম আলো, ১৪ মে ২০১৬)। সম্ভবত সে ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের মেয়ে। সে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগোর ঠিকানা দিয়ে এই গোয়েন্দা কার্যক্রম চালায়। এ ধরনের মিথ্যা প্রচারণাকে বলা হয় ডিসইনফরমেশন (মিথ্যাচার)। অবস্থা দৃষ্টে মনে হয়, মুসলিমদের নামে যেসব উগ্রবাদী ঘটনা, হত্যাকা- ও বোমাবাজি হচ্ছে তার বেশির ভাগ মোসাদসহ বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা করে মুসলমানদের নাম দিচ্ছে। পাশ্চাত্য কিছু মুসলমানকে ক্রয় করেছে আর কিছুকে বোকা বানিয়েছেÑ এভাবেই তারা মুসলিম সমাজে উগ্রবাদের জন্ম দিয়েছে।
লেখক : ইতিহাসবিদ, গবেষক ও গ্রন্থকার।



 

Show all comments
  • মুসা ৪ জুলাই, ২০১৬, ৩:৪৩ এএম says : 0
    সারা বিশ্বে চলছে এখন মুসলমান এবং ইসলামের বিরুদ্ধে প্রচারনা, এমনকি এক মুসলমানকে লেলিয়ে দেয়া হচ্ছে আরেক মুসলমানের বিরুদ্ধে, তার পিছনে রয়েছে জায়নীসটরা, তারা false flag আক্রমণ চালিয়ে দোষ দিচ্ছে মুসলমানদের, যার ফলে অন্য সব ধর্মের বিশ্বাসীরা মুসলমানদের ঘৃনা করছে, নির্বিচারে হত্যা করছে, পবিএ কোরান পোড়াচ্ছে, মসজিদ ভাঙ্কচুর করছে, অথচ অনেক মুসলিম দেশ এবং তাদের দুশ্চরিত্র নেতারা ইসলামের ঐ শএুদের সাথে দুস্তির হাত মিলিয়ে চলছে
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: মুসলিম বিশ্বে উগ্রবাদের মূলে পাশ্চাত্য শক্তি
আরও পড়ুন