ছেলেবেলার ঈদের স্মৃতি
এমাজউদ্দীন আহমদঅতীতের স্মৃতি সব সময় অত্যন্ত মধুর। হাজারো অনিশ্চয়তায় ভরা বর্তমানের জন্য অনেক সময় মনটা
মহসিন আলী রাজু
এখন যাদের বয়স নীচে ৬ থেকে ঊর্ধ্বে ৩৫ তাদের কাছে যদি বলা হয় ৭২ সালে বগুড়ায় ২ টাকায় এক সের (তখন কেজির প্রচলন হয়নি) গরুর এবং আড়াই টাকায় ওই পরিমাণ খাসির (তখন খাসি মানে খাসিই বকরি (ছাগি) বা ভেড়ার মিশ্রণ নয়) তাহলে তারা ভাববে এই লেখকের মাথাই নষ্ট! যদি বলা হয় ৭৫ পর্যন্ত ঈদের দিনে ঘরে ঘরে লাচ্ছা সেমাই রান্না হতো না, দোকানে দোকানে তা পাওয়া যেত না, তাহলে এই প্রজন্ম ভাববে ‘আষাঢ়ে গল্প’ বুঝি একেই বলে।
কিন্তু এই পরিণত বয়সে এসে শৈশবের ঈদ স্মৃতি হাতড়াতে গিয়ে প্রথমেই যে সুখ স্মৃতিটা মনে পড়ল ৭ম কি ৮ম শ্রেণিতে পড়–য়া আমার এক ফুফাতো বোনের বান্ধবীর বাড়িতে ঈদের দাওয়াত খেতে গিয়ে প্রথম লাচ্ছা সেমাই-এর নাম শোনার কথা। বিশ্বাস হয়, এর আগে আমি লাচ্ছার নামই শুনিনি?
যাই হোক ৭২ সালে যখন আমার বয়স ৫ প্লাস মানে ৬। আমি তখন সবে বাড়ির পাশের সিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রথম শ্রেণির ছাত্র। ঈদের দিনে তখন বাড়িতেই হাতে তৈরি বা সেমাই তৈরির মেশিন দিয়ে বানানো সেমাই রান্না হতো। সাধারণত ওই সেমাই দুধ ছাড়াই চিনি বা গুড় দিয়ে ভুনা সেমাই এবং বেশি পরিমাণ দিয়ে রান্না সেমাইকে বলা হতো দুধ সেমাই।
এছাড়াও বাজারে ‘রোলেক্স ব্রান্ড’-এর পাকিস্তানি সেমাই পাওয়া যেত। এছাড়া কোলকাতা থেকে খুবই কম পরিমাণে আসত হালকা সবুজ ও জাফরান রঙ-এর লাচ্ছা সেমাই। বেশি দামের কারণে সব পরিবারে লাচ্ছা রান্না হতো না। লাচ্ছা হলো নবাবী খানা। নবাবী আমলে বিশেষ বিশেষ নবাবের মহলেই কেবল এই লাচ্ছা অতি গোপনে বানানো হতো যারা এর কারিগর ছিল তারা এর নির্মাণ কৌশল কাউকে জানাত না। পরে ব্রিটিশ শাসনামলে নবাবরা যখন গুরুত্বহীন হয়ে গেল তখন লাচ্ছার কারিগররা জীবিকার প্রয়োজনে বাণিজ্যিকভাবে লাচ্ছা তৈরি করে তা বাজারজাত করা শুরু হলো। এখন বগুড়াতো বটেই সারা দেশেই অলিতে-গলিতে সবার চোখের সামনেই বানানো ও ভাজা হয় লাচ্ছা।
যাই হোক রহমান নগরে আমাদের বাড়ির কাছেই সরকারি স্টাফ কোয়ার্টারে গেলাম ফুফাতো বোনের হাত ধরে। বড় বোনের বান্ধবীর বাড়িতে বেশ আদর যতেœই বসতে দেয়া হলো। বোনের বান্ধবীর সম্ভবত মা কাকে যেন বললেন, এই ওদের লাচ্ছা দাও .. লাচ্ছা দাও ।
বোকার মতোই আমি বললাম, আপা লাচ্ছা কি?
প্রশ্ন শুনে আপা কানের কাছে মুখ এনে বললেন, এই চুপ...চুপ ... আস্তে লাচ্ছা মানে ... লাচ্ছা..সেমাই।
আমিও বুঝলাম কি বুঝলাম না... তবে বুঝলাম ... বোদ্ধার মতো চুপ থাকতে হবে।
কিছুক্ষণের মধ্যে ট্রে হাতে কে একজন আসলেন, টেবিলে রাখতে শুরু করলেন একে একে পিরিচ ভর্তি লালচে রং-এর ভুনা সেমাই, দুধসেমাই, সাদা ধবধবে পায়েস/ ফিরনি। আর একেবারে নরম তুলতুলে হালকা সবুজ রং-এর কিছু একটা। আমার বুঝে নিতে অসুবিধা হলো না হ্যাঁ ... এটাই সেই লাচ্ছা ... যার সাথে আমার প্রথম পরিচয় হলো।
এরপর ক্লাস টেনে পড়া পর্যন্ত যে শৈশব ও তারুণ্য... সেখানে ঈদের সময় নতুন জামা, জুতা স্যান্ডেল চেয়ে পেয়ে বা না পেয়ে যে সুখ ও দুঃখের স্মৃতি আছে। ৭২-এর ঈদের দিনের হালকা সবুজ রং-এর লাচ্ছা দর্শনের সুখানুভূতির কাছে তা কিছুই নয় !
লেখক : সাংবাদিক
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।