Inqilab Logo

রোববার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১, ১৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

কুরবানি নিছক কোনো প্রথা নয়

মুফতি মোয্যাম্মিল হক মাছুমী | প্রকাশের সময় : ২৬ ডিসেম্বর, ২০১৯, ১২:০১ এএম

পবিত্র কুরবানি নিছক কোন প্রথা বা পার্বণ নয় কিংবা গোস্ত খাওয়ার মোহরা নয়। কার থেকে কে বড় পশু জবাই করবে সেই প্রতিযোগিতা নয় বরং কুরবানি হচ্ছে নিরঙ্কুশ ভাবে মহান আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ করার এক অবিস্মরণীয় ইতিহাস। প্রতি বছর কুরবানী করার মাধ্যমে আল্লাহর বিধানের সামনে আত্মসমর্পণের প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য বছরে একবার ধনীদের জন্য কুরবানীকে ওয়াজিব করেছেন এবং পবিত্র হজ্জেরও একটি বিশেষ অংশ। যা হাজার হাজার বছর ধরে ধারাবাহিক ভাবে চলে আসছে। যার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপনের মাধ্যমে ইসলামের ইতিহাসে চির অম্লান হয়ে গোটা মুসলিম উম্মাহর হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছেন জাতির পিতা হযরত ইব্রাহীম খলিল ও তাঁর পুত্র হযরত ইসমাইল আঃ। সূরা আস-সাফফাতের ১০২ নং আয়াতে আল্লাহ তায়া’লা বলেন ‘অতঃপর সে (ইসমাইল আঃ) যখন তাঁর পিতার সাথে চলা-ফেরা করার বয়সে উপনীত হলো তখন ইব্রাহীম আঃ বলল, হে বৎস! আমি স্বপ্নে দেখেছি যে, আমি তোমাকে যবেহ করছি, এখন বল, তোমার অভিমত কী? সে বলল, হে পিতা! আপনাকে যা আদেশ করা হয়েছে আপনি তাই করুন, আল্লাহ চাইলে আপনি আমাকে ধৈর্যশীলরূপে পাবেন”। উল্লেখ্য পয়গম্বরগণের স্বপ্নও প্রত্যাদেশ আল্লাহর আদেশই হয়। ফলে তাঁদের জন্য তা পালন করা জরুরী। পুত্র আল্লাহর আদেশ পালনে কতটা প্রস্তুত আছে, তা জানার উদ্দেশ্যে তিনি পুত্রের সাথে পরামর্শ করেন। কারণ কোন পয়গম্বরকেই শয়তান মিথ্যা স্বপ্ন দেখাতে পারতোনা যা সাধারণ মানুষের বেলায় সম্ভব। কুরবানির ইতিহাস, ঘটনাবলী ও পটভূমি কুরআন হাদিসের সুস্পষ্ট প্রমাণে ব্যপক আলোচনার দাবি রাখে। আল্লাহর পক্ষ থেকে স্বপ্নের ওহীকে বাস্তবে পরিণত করতে মহান এই কুরবানির পরিক্ষা দেওয়ার জন্য হযরত ইব্রাহীম আঃ পুত্র ইসমাইল আঃ কে সুসজ্জিত পোশাকে প্রস্তুত করে হযরত হাজেরার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রওয়ানা হলেন মিনার দিকে। বাপ বেটা চলতে লাগলেন মিনা অভিমুখে। ইতোমধ্যে জামারাতুল আক্বাবায় পৌঁছার পর শয়তান ওয়াছওয়াছা দিল তখন হযরত ইব্রাহীম আঃ শয়তানকে সাতটি পাথর নিক্ষেপ করলেন, এভাবে জামারা ওসতা, জামারা কুবরাতেও শয়তানকে সাতটি পাথর নিক্ষেপ করলেন। সেই ঐতিহাসিক স্মৃতিকে মহান আল্লাহ আবহমান কাল চির স্বরণীয় করতে শয়তানকে পাথর নিক্ষেপ করা হাজীদের জন্য হজ্জের জন্য বিশেষ একটি অংশ করে দিলেন। তারপর হযরত ইব্রাহীম আঃ পুত্রকে নিয়ে চলে গেলেন মিনার জাবালে সুবায়ের নামক পাহাড়ের কাছে, যেখানে হযরত ইসমাইল আঃ কে যবেহ করার জন্য প্রস্তুত করলেন। ইমাম আহমাদ বিন হাম্বর রহঃ বর্ণনা করেন হযরত ইসমাইল আঃ যবেহ করার আগে তার বাবাকে কয়েকটি আবদার করলেন। এবং বললেন বাবা আমার প্রথম অনুরোধ ্রজবেহ করার সময় আমার চেহারাটা মাটির দিকে রাখবেন এবং পিছন থেকে জবেহ করবেন কারণ আমাকে অধিক মহব্বতের কারণে জবেহ করতে আল্লাহর হুকুম পালনে বিলম্ব হতে পারে। দ্বিতীয় অনুরোধ ্রআমার হাত-পা গুলো বেঁধে দিবেন কারণ জবেহ করার সময় যদি আমি নড়াচড়া করি তবে আল্লাহর হুকুম পালন করতে আপনার বিলম্ব হবে। তৃতীয় অনুরোধ-বাবা আমার এই সাদা পোশাক ছাড়াত আর কোন পোশাক নাই,তাই বাবা কাপড়টা খোলে জবেহ করেন যাতে এই কাপড় দিয়ে গোসলের পর কাফন দিতে পারেন। সর্বোপরি বাপ-বেটা প্রস্তুত, আকাশ ও জমিনে সীমাহীন নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে, দুই আত্মসমর্পণকারী আল্লাহর কাছে, একজন পিতা ও অপরজন পুত্র। আদম সৃষ্টিতে যেই ফেরেস্তারা বাধা দিতে চেয়েছিল ঐসব ফেরেস্তাদের লজ্জায় দৃষ্টি অবনমিত হয়ে মস্তক নত হয়ে গেল। ইবলিশ শয়তান হতাশ! মানবজাতিকে পথভ্রষ্ট করার সমস্ত অপচেষ্টাই তার নস্যাৎ হয়ে গেল। হযরত ইব্রাহীম আঃ মহান আত্নত্যাগের পরিক্ষায় অবতীর্ণ হয়েছেন। পুত্র ইসমাইলের হাত-পা বাঁধা, পাথরের ওপরে গর্দান রাখা, পিতার হাতে নাঙ্গা তরবারি চকচক করছে। আল্লাহ রহমতের নজরে সেই দৃশ্য অবলোকন করছেন। এবার হযরত ইব্রাহীম আঃ তরবারি চালালেন, কিন্তু গর্দান কাটেনা। এভাবে একবার, দু›বার, তিনবার তাতেও কাটছেনা। তাফসীর গ্রন্থে এসেছে রাগান্বিত হয়ে হযরত ইব্রাহীম আঃ তরবারি পাথরে নিক্ষেপ করলেন, পাথর দুই টুকরো হয়ে গেল। এদিকে সন্তান হাত-পা বাঁধা অবস্থায় প্রস্তুত কতক্ষণে আল্লাহর জন্য জবেহ হবেন এবং পিতা রাগে অস্থির কতক্ষণে তিনি জবেহ করবেন। সন্তানের গর্দান কাটেনা কিন্তু পাথর দুই টুকরো হয়ে গেছে। এবার মহান পরীক্ষক আল্লাহ তায়ালা ডাক দিলেন- সূরা সাফফাতের ১০৩,১০৪,এবং ১০৫ নং আয়াতে ্রযখন পিতা-পুত্র উভয়েই আনুগত্য প্রকাশ করল এবং ইব্রাহীম তাকে জবেহ করার জন্য শায়িত করল, তখন আমি তাকে ডাক দিলাম, হে ইব্রাহীম! স্বপ্নে দেয়া আদেশ তুমি সত্যে পরিনত করেই ছাড়লে। নিশ্চয়ই এভাবেই আমি সৎকর্মশালীদের প্রতিদান দিয়ে থাকিগ্ধ। ইব্রাহীম তুমার কুরবানী কবুল হয়ে গেছে, ইসমাঈলের হাত-পা খোলে দাও। সাথে সাথে জিবরাইল আকাশ থেকে দুম্বা নিয়ে আসলেন এবং সেই দুম্বা হযরত ইব্রাহীম আঃ জবেহ করলেন। অর্থাৎ, মনের পরিপূর্ণ ইচ্ছার সাথে সন্তানকে জবেহ করার উদ্দেশ্য মাটির উপর শুইয়ে দেওয়াতেই তুমি নিজ স্বপ্নকে বাস্তব করে দেখালে। কারণ এতে স্পষ্ট হয়ে গেল যে, আল্লাহর আদেশের তুলনায় কোন বস্তুই তোমার নিকট প্রিয়তর নয়; এমনকি একমাত্র নিজের কলিজার টুকরো পুত্রও নয়। অতএব বুঝা যায় মূলত কুরবানী নিছক কোন প্রথা বা পার্বণ নয় কিংবা গোস্ত খাওয়ার মোহরা নয়। এমনকি নিছক ধর্মীয় কোন কাজ নয়। ইসলাম কুরবানীর প্রচলন করে নূর নবী হযরত মোহাম্মদ সাঃ উম্মতের ধনীদের ওপর কুরবানীকে ওয়াজিব করেছেন কেবল নিরঙ্কুশ ভাবে আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণের এক জীবন্ত ইতিহাসকে প্রতি বছর স্বরণ করে খাঁটি মুসলিম হওয়ার হাতে কলমের এক প্রশিক্ষণের গ্রহণ করার জন্য। এজন্যই আল্লাহ তায়ালা বলেন ্র আল্লাহর কাছে তোমাদের রক্ত কিংবা গোস্ত কিছুই যাবেনা বরং আল্লাহর কাছে যাবে তোমাদের তাকওয়া’। রাসূল সাঃ বলেছেন- আল্লাহ তোমাদের বাহ্যিক চেহারা কিংবা সৌন্দর্য দেখেন না কিন্তু তোমাদের অন্তর এবং আমল কি সেটাই দেখেন। অপর আরেকটি হাদিসে রাসুল সাঃ বলেছেন- ‘কোন ভিক্ষুক যখন ভিক্ষা চায় আর কোন মুমিন যখন দান করে, সেই দান ভিক্ষুকের হাতে আসার আগে আল্লাহর হাত হয়ে ভিক্ষুকের হাতে যায়, এবং কুরবনীর পশু জবাই করার রক্তের প্রথম ফোঁটাও তদ্রূপ আল্লাহর কাছে নির্ধারিত জায়গায় পৌছার পর মাটিতে পরে। সেই কুরবানী যেন আমরা হালাল উপার্জনের মাধ্যমে আদায় করে একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করে খাঁটি মুসলমান হতে পারি। আল্লাহর কাছে সেই ফরিয়াদ কামনা করছি।

 

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: কুরবানি


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ