দেশে দেশে রোজার উৎসব
মাহে রমজান আরবী নবম মাসের নাম। চাঁদের আবর্তন দ্বারা যে এক বৎসর গণনা করা হয়,
কুরবানি হলো মুসলিমদের একটি ইবাদত যা প্রতি বছর বিত্তববানদের উপর আরোপিত হয় নিদিষ্ট সময়ে। এবং এ ইবাদাতের মাধ্যমে মুসলিম মহান আল্লাহ তায়ালার নৈকট্য লাভ করে থাকে। সুতরাং গুরত্বপূর্ণ এই ইবাদতটি করতে হবে মহান আল্লাহ তায়ালার নির্দেশ ও রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নাহ অনুযায়ি তবেই তা আল্লাহ তায়ালার নিকটে গ্রহনযোগ্য হবে। আর যেকোন কাজ করতে হলে সে ব্যাপারে জ্ঞান লাভ করা অতিব জরুরি। যথেষ্ট পরিমান জ্ঞান ছাড়া কাজ করলে তা যথাযথ হবেনা । তাই এতবড় ইবাদাত করতেও বেশ জ্ঞানের প্রয়োজন এখানে সংক্ষিপ্ত তবে খুব বেমি গুরত্ববহ কিছু বিষয়ে আলোকপাত করা হলো। প্রথমেই জানা দরকার। কোন ধরনের মুসলমানদের উপর কুরবানি ওয়াজিব? সেই বিষয়কেই শুরুতে আলোচনা করছি।
কুরবানী যাদের উপর ওয়াজিব :
প্রাপ্তবয়স্ক, সুস্থ মস্তিষ্ক সম্পন্ন প্রত্যেক মুসলিম নর-নারী, যে ১০ জিলহজ্জ ফজর থেকে ১২ জিলহজ্জ সূর্যাস্ত পর্যন্ত সময়ের মধ্যে (সংসারের নিত্য প্রয়োজনীযয় আসবাবপত্রের অতিরিক্ত) নেসাব পরিমাণ সম্পদের (সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণ বা সাডয়ে ৫২ তোলা রুপা কিংবা তার সমমূল্যের কোন জিনিসের বা নগদ অর্থের) মালিক হবে, আর তার এ পরিমাণ ঋণ না থাকে, যা পরিশোধ করলে নিসাব পরিমাণ সম্পদ থেকে কমে যাবে, এমন ব্যক্তির ওপর কোরবানী ওয়াজিব।যাকাত ও কোরবানির নেসাব এর মধ্যে একটু পার্থক্য আছে। যাকাতের নেসাবের সারাবছর মালিক থাকতে হয় কিন্তু কোরবানির নেসাবের কোরবানির এই তিন দিনের মধ্যে মালিক হলেই তার উপর কুরবানী ওয়াজিব হয়। কুরবানীর নেসাব এর মধ্যে কিকি জিনিসকে প্রযয়োজনের অতিরিক্ত গণ্য করা হবে তা উল্লেখ করা হলো: প্রয়োজনের অতিরিক্ত বলতে, যে সমস্ত বস্তু ইজ্জত-সম্মান ও জীবন রক্ষার্থে অপরিহার্য পরিমাণ সম্পদের অতিরিক্ত, তাকেই প্রয়োজনের অতিরিক্ত বলা হয়। টাকা-পয়সা, সোনা-রুপা, অলঙ্কার। বসবাস ও খোরাকির প্রয়োজন আসে না, এমন জমি, অতিরিক্ত বাড়ি, ব্যবসায়িক পণ্য, অপ্রয়োজনীয় সকল আসবাবপত্র, যেমন বড় বড় ডেগ, উন্নত মানের বিছানা, গদী, শামিয়ানা ইত্যাদি। এসবের মূল্য কুরবানীর নেসাবের ক্ষেত্রে হিসাবযোগ্য। (ফতোয়ায়ে হিন্দিয়া, ৫/২৯২)
কোরবানী ওয়াজিব হওয়ার দলিল:
বিশ^নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পবিত্র হাদিস থেকে কুরবানি ওয়াজিব হওয়ার স্পষ্ট দলিল পাওয়া যায়। যেমনটি হযরত আনাস ইব্নে মালিক রাদিযয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, সালাতের পূর্বে যে যবেহ্ করবে তাকে পুনরায় যবেহ্ করতে হবে। ঈদের নামাযের পূর্বে কুরবানী করলে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওযয়াসাল্লাম পুণরায় তাকে কুরবানীর আদেশ দিয়েছেন। সুতরাং বুঝা যায় যে, কুরবানী ওয়াজিব। না হলে পুণরায় করতেই হবে, এমন আদেশ দেওয়া হতো না। সহিহুল বুখারী, হাদিস নং ৯৫৪
কোরবানী ওয়াজিব হওয়ার জন্য সামর্থ্যবান হওয়া অর্থাৎ নিসাবের মালিক হওয়া শর্ত: আবূ হুরায়রাহ রাদিআল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, যে ব্যক্তি সামর্থ্য থাকা সত্তে¡ও কোরবানি করে না, সে যেন আমাদের ঈদের মাঠের কাছেও না আসে। সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস নং ৩১২৩। ইলমে ফিকহের গুরত্ববহ কিতাব বাদায়েউস সানায়েতে উল্লেথ করা হয়েছে, আর ওয়াজিব হওয়ার শর্তাবলীর মধ্য হতে সামর্থ্যবান হওয়া একটি শর্ত। কারণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওযয়াসাল্লাম বলেছেন যে সামর্থ্য রাখে সে যেন কোরবানি করে। বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওযয়াসাল্লাম সামর্থ্য অর্থাৎ সম্পদশালী হওয়া কে কুরবানী ওয়াজিব হওয়ার জন্য শর্ত হিসেবে উল্লেখ করেছেন। (বাদায়েউস সানায়ে,৫/৬৪) অনুরুপ ফতোয়ার অন্যতম কিতাব যেটি উলামাাদের নিকট যা ফতোয়ায়ে শামী নামে পরিচিত সেখানে বণৃনা করা হয়েছে যে, আর কোরবানি ওয়াজিব হবে যদি সে ২০০ দেরহাম অর্থাৎ সাড়ে ৫২ তোলা রুপার মালিক হয় অথবা তার সমমূল্যের কোন আসবাব পত্রের মালিক হয়। তার বসবাস করার ঘর, ব্যবহৃত পোশাক ও আসবাব ব্যতীত। কোরবানি করা পর্যন্ত অর্থাৎ জিলহজের ১০ তারিখ থেকে নিয়ে ১২ তারিখ সূর্য অস্ত যাওয়া পর্যন্ত। (রদ্দূল মুহতার ,৬/৩১২)
জমির মূল্য নেসাবের অন্তর্ভুক্ত কি না ? একটি প্রশ্ন মানুষের মনে ঘুরপাক খায় বিভিন্ন সময় আমরা জিজ্ঞাসার সম্মুখিন হয়ে থাকি যে, জমির মূল্য নেসাবের মধ্যে হিসেবযোগ্য হবে কি না? এর জবাব হলো, জমি থেকে উৎপাদিত ফসল প্রয়োজনের অতিরিক্ত থাকলে, তার মূল্য নেসাবের মধ্যে হিসেবযোগ্য। নিজের প্রয়োজনের অতিরিক্ত জমি থাকলে, তার বর্তমান বাজার মূল্যও নেসাবের মধ্যে হিসেবযোগ্য।(হিন্দিয়া, ৫/২৯২)
কুরবানির পশুতে আক্বিকার হুকুম : নানা আলেমের নানা মতের ভিরে সাধারণ মুসলিম দিশেহারা এমন মন্তব্য বহু মানুষের মুখে শোনা যায়। তেমনই একটি মাসয়ালা অনেকের মনের ধারনা হলো কুরবানির পশুতে অন্য কোন নিয়ত চলেনা। বিষয়টি এমন নয় বরং কোরবানীর সাথে আকীকা নিঃসন্দেহে সহীহ হবে। উভয়টির জন্য হাদীসে একই ধরণের প্রাণীর উল্লেখ রয়েছে। আর কুরবানীর ও আক্বীক্বার জন্য হাদীস শরীফে একই ধরণের শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। যেমন নিম্নে বুখারী শরীফের একটি হাদীস দেখুন সেখানে আক্বীক্বার জন্য ইহরাকুদ্দম শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। মুস্তাদরাকে হাকেম, তিরমিযী বাইহাক্বী সহ অনেক কিতাবে কোরবানির জন্য ঠিক এই ইহরাকুদ্দম শব্দটিই ব্যবহার করা হয়েছে। যেমনটি হাদিস শরীফে বর্ণিত হয়েছে, মুহাম্মদ ইবনু সীরিন থেকে বর্ণিত তিনি বলেন আমাদেরকে হাদীস বর্ণনা করেছেন সালমান বিন আমির রাদিআল্লাহু তা’আলা আনহু, তিনি বলেন, আমি রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে বলতে শুনেছি যে, সস্তানের সঙ্গে ‘আকিকা সম্পর্কিত। তার পক্ষ থেকে রক্ত প্রবাহিত (অর্থাৎ ‘আকিকার জন্তু যবেহ্) কর এবং তার অশুচি (চুল, নখ ইত্যাদি) দূর করে দাও। সহিহ বুখারী, হাদিস নং ৫৪৭১ অন্য হাদিসে বলা হয়েছে, আইশা রাদিআল্লাহু তা’আলা আনহা থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, কুরবানীর দিন মানুষ যে কাজ করে তার মধ্যে আল্লাহ্ তা’আলার নিকট সবচাইতে পছন্দনীয় হচ্ছে রক্ত প্রবাহিত করা (কুরবানী করা)। মুসতাদরাকে হাকেম, হাদীস নম্বর : ৭৫২৩ আবার আবূ দাউদ শরীফের একটি হাদীসে ক্বুরবাণীর জন্য “নাসাক“ শব্দটি ব্যবহার করা হযয়েছে। ঠিক আবূ দাউদ শরীফেরই অন্য একটি হাদীসে আক্বীক্বার জন্য ঐ “নাসাক“ শব্দটিই ব্যবহার করা হয়েছে। এতে কী স্পষ্টভাবে এ কথা প্রমাণিত হয় না যে, কোরবানি ও আকিকা একই ধরনের এবাদত এবং এ দুটি একসঙ্গে একই পশু দ্বারা জায়েয হবে। ফতোয়ায়ে হিন্দিয়ার মধ্যে বিষয়টি স্পষ্ট করে উল্লেখ করা হয়েছে, যদি সবাই কুরবতের নিযয়ত করে কোরবানি বা অন্য কিছু। তাহলে সবার পক্ষ থেকেই যথেষ্ট হযয়ে যাবে। এমনিভাবে কেউ যদি তার অতীতে ভূমিষ্ঠ সন্তানের আকিকা করতে চাযয় তাও সহীহ হবে।
(ফতওয়ায়ে হিন্দিযয়া: ৫/৩০৪)
গরু বা উট অথবা এ ধরনের পশুতে সাত শরিকে কুরবানি করার হুকুম : আমরা অনুসরনের মাপকাঠি হলো সাহাবায়ে কেরাম রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম সুতরাং তাদের আমল যদি এমন থাকে তাহলে তো এর চেয়ে বড় কোন দলিল আর আমাদের প্রয়োজন হয়না সুতরাং দেখে আসি এ ব্যাপারে তাদের আমল কি ছিল ? সাহাবায়ে কেরাম রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওযয়াসাল্লামের সাথে সাত ভাগে কুরবানী করেছেন । ১ম দলীল: হযরত জাবির ইবনু ‘আবদুল্লাহ রাদিআল্লাহু তা’আলা আনহু হতে বর্ণিত তিনি বলেন, আমরা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সাথে হাজ্জ সমাপন করি। আমরা সাত শারীকে একটি করে উট বা গরু কুরবানী করেছি। সহিহ মুসলিম, হাদিস নং ৩০৭৮। ২য় দলীল: হযরত ইব্ন আব্বাস রাদিআল্লাহু তা’আলা আনহু হতে বর্ণিত তিনি বলেন, আমরা রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সঙ্গে সফরে ছিলাম, তখন কুরবানীর সময় উপস্থিত হলে আমরা একটি উটে দশজন শরীক হলাম, আর একটি গাভীতে সাতজন। (তবে উটে দশজনের শরীক হওয়ার বিধানটি অন্য হাদীস দ্বারা মানছূখ তথা রহিত হয়ে গেছে।) সুনানে আন-নাসায়ী, হাদিস নং ৪৩৯২। তৃতীয় দলীল: অনেকে বলেন সাত ভাগে কোরবানি হজের সাথে অথবা সফরের সাথে খাস, যা একান্তই মূর্খতা ও অজ্ঞতা ছাড়া কিছুই নয়। তারপরও আমরা এ পর্যায়ে এমন একটি সহীহ হাদীস উল্লেখ করছি, যা দ্বারা স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে, সাত ভাগে কোরবানির বিষযয়টি হজের অথবা সফরের সাথে খাস নয়।
হযরত আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু তা›আলা আনহু হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওযয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, সকল কোরবানির ক্ষেত্রে গরুতে সাত জনের পক্ষ থেকে এবং উটে সাত জনের পক্ষ থেকে যথেষ্ট হবে। আল মুজামুল আওসাত লিততবারানী,৬/১৮২, হাদিস নম্বর: ৬১২৮ শায়খ আলবানীও সহীহু জামিইস সগীরে উক্ত হাদীসকে সহীহ বলেছেন। (দেখুন সহীহু জামিইস সগীর, হাদীস নম্বর: ২৮৯০)
সাতজনের কম শরীক হওয়ার বিধান : অনেকে আবার মনে করেন, সাত জনের কম হলে বড় পশুতে কোরবানি হয় না। এজন্য তারা যেকোন ভাবে কষ্ট করে সাতটি নামই পূরণ করার চেষ্টা করে। এটি একটি ভুল ধারণা। গরু বা এধরনের বড় পশুতে ১ থেকে নিয়ে সাতজন পর্যন্ত শরিক হতে পারেন। তাতে সাতের কমে যেকোন সংক্যা গ্রহণযোগ্য হবে। জোড় বেজোড় বা কোন নির্দিষ্ট নিতীমালা মানার প্রয়োজন নেই। মালিকুল ওলামা আল্লামা কাসানী রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন: একটি উট বা গরুতে অংশগ্রহণ কারীর সংখ্যা যদি সাতের কম হয়, যেমন- দুজন অথবা তিনজন অথবা চারজন অথবা পাঁচজন কিংবা ছয়জন একটি উট অথবা গরুতে অংশগ্রহণ করে, তবে তা জায়েয হওয়ার ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। বাদায়েউস সানায়ে,৫/৭১ ইতিপূর্বে আমি আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু হতে বর্ণিত আল মুজামুল আওসাত এর একটি হাদীস উল্লেখ করেছি যেখানে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, কোরবানির ক্ষেত্রে গরুতে সাতজনের পক্ষ থেকে এবং উটেও সাতজনের পক্ষ থেকে কুরবানী করলে যথেষ্ট হবে। সুতরাং দুই, তিন,চার, পাঁচ অথবা ছয়জন শরিক হয়ে কুরবানী করলে, তা অবশ্যই বৈধ হবে। অর্থাৎ সর্বচ্চ সংখ্যা সাতজন বুঝানো হয়েছে। সাত জন পর্যন্ত শরিক হওয়া যাবে সাত জনই হতে হবে এমনটি নয়।
অল্প কিছু গুরত্বপুর্ণ বিষয়ে আলোকপাত করা হলো এর চেয়ে ভিন্ন কোন মাসয়ালা জানার প্রয়োজন হলে নিকটতম নির্ভরযোগ্য আলেমের স্বরানাপন্ন হওয়ার অনুরোধ রইল। আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে পূর্ণাঙ্গ রুপে কুরবানি করার তাওফিক দান করুন। আমিন
লেখক : সাংবাদিক, ইসলামি গবেষক ও কলামিষ্ট।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।