Inqilab Logo

শুক্রবার, ০৩ মে ২০২৪, ২০ বৈশাখ ১৪৩১, ২৩ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

খলিফা হাফতার কী লিবিয়ার নতুন গাদ্দাফি!

ইনকিলাব ডেস্ক | প্রকাশের সময় : ১৯ নভেম্বর, ২০১৯, ১২:৪৯ পিএম
খালিফা হাফতার গত চার দশক ধরেই লিবিয়ার রাজনীতিতে এক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। এ সময়ে তার অনেক উত্থান-পতন হয়েছে। তিনি সাহচর্য পেয়েছেন গাদ্দাফির মতো নেতার। আবার খলিফা হাফতারকে কখনো সরে যেতে হয়েছে দূরে। যুদ্ধবন্দি হিসেবে তাকে জেলে কাটাতে হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ এবং বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার আশীর্বাদ ছিল বা আছে তার ওপর। তাই তিনি আবার আলোচনায় ফিরেছেন। তার অধীনে থাকা বাহিনী এখন লিবিয়ার বড় বড় তেল টার্মিনালগুলো দখল করেছে। ফলে লিবিয়ার পূর্বাঞ্চলীয় শহর তবরুকের পার্লামেন্টের হাতে দেশটির গুরুত্বপূর্ণ তেল সম্পদের নিয়ন্ত্রণ। এত আলোচিত ব্যক্তিকে তুলনা করা হয় লিবিয়ার প্রয়াত নেতা মুয়াম্মার গাদ্দাফির সঙ্গে। তাকে বলা হচ্ছে লিবিয়ার সবচেয়ে বড় যুদ্ধবাজ নেতা।
লিবিয়ান-আমেরিকান দ্বৈত নাগরিক খলিফা হাফতার। জন্ম ১৯৪৩ সালের ৭ই নভেম্বর। তিনি লিবিয়ান ন্যাশনাল আর্মির (এলএনএ) প্রধান। খলিফা হাফতারের নেতৃত্বে সেনাবাহিনীর এই অংশটি নয়টি মিউনিসিপাল কাউন্সিলের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের উৎখাত করেছে। এসব কাউন্সিল তারা নিয়ে এসেছে সামরিক শাসনের অধীনে। ২০১৯ সালের মে মাসে যখন লিবিয়ায় ‘সেকেন্ড লিবিয়ান সিভিল ওয়ার’ হয় তাতে যুক্ত তার বাহিনী। নির্বাচিত আইনি পরিষদ লিবিয়ান হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভ-এর প্রতি অনুগত সেনাবাহিনীর কমান্ডার নিয়োগ করা হয় তাকে ২০১৫ সালের মার্চে।
খলিফা হাফতারের জন্ম লিবিয়ার আজদাবিয়া এলাকায়। প্রয়াত নেতা মুয়াম্মার গাদ্দাফির অধীনে লিবিয়ার সেনাবাহিনীতে তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৬৯ সালে যে সামরিক অভ্যুত্থানে গাদ্দাফি ক্ষমতায় এসেছিলেন, তাতে অংশ নিয়েছিলেন খলিফা হাফতার। ১৯৭৩ সালে ইসরাইলের বিরুদ্ধে ইয়োম কিপ্পুর যুদ্ধে তিনি লিবিয়ার পক্ষে যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। চাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সময় তিনি ফাঁদে পা দিয়ে ধরা পড়েন এবং যুদ্ধবন্দি হন। এটা তখনকার প্রচণ্ড ক্ষমতাধর গাদ্দাফির কাছে ছিল মারাত্মক এক বিব্রতকর অবস্থা। গাদ্দাফি চাদ নিয়ে যে উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা করেছিলেন এতে তার সেই পরিকল্পনায় বড় আঘাত লাগে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এক চুক্তির মধ্য দিয়ে ১৯৯০ সালে মুক্তি দেয়া হয় খলিফা হাফতারকে। এরপর তিনি প্রায় দু’দশক ভার্জিনিয়ার ল্যাংলিতে কাটান। এ সময়েই তিনি যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব পান। যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকালীন তার অনুপস্থিতিতে ১৯৯৩ সালে জামাহিরিয়ায় অপরাধের দায়ে তাকে অভিযুক্ত করে শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়।
খালিফা হাফতারের অধীনে থাকা বাহিনী এখন লিবিয়ার প্রধান তেল টার্মিনালগুলোর দখল নিয়েছে। এর ফলে লিবিয়ার পূর্বাঞ্চলীয় শহর টবরুকের পার্লামেন্টের হাতে (এই পার্লামেন্টকে স্বীকৃতি দেয়নি আন্তর্জাতিক সমাজ) দেশটির গুরুত্বপূর্ণ তেল সম্পদের নিয়ন্ত্রণ।
১৯৪৩ সালে লিবিয়ার পূর্বাঞ্চলীয় শহর আজডাবিয়ায় খালিফা হাফতারের জন্ম। ১৯৬৯ সালে কর্নেল মুয়াম্মার গাদ্দাফির নেতৃত্বে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে যে সেনা কর্মকর্তারা রাজা ইদ্রিসকে ক্ষমতাচ্যুত করে ক্ষমতা দখল করেন, তিনি ছিলেন তাদের একজন।

পতন এবং নির্বাসন
গাদ্দাফির শাসনামলে খালিফা হাফতার বেশ দ্রæত উপরে দিকে উঠে যান। ১৯৮০ দশকে লিবিয়ার বাহিনী যখন প্রতিবেশী দেশ চাদ-এর সাথে সংঘাতে লিপ্ত, তখন তাকে সেই লড়াইয়ের দায়িত্ব দেয়া হয়। তবে এটিই খালিফা হাফতারের পতনের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কারণ ফ্রান্সের সমর্থনপুষ্ট বাহিনীর হাতে তার বাহিনী পরাজিত হয়। খালিফা হাফতার এবং তার বাহিনীর ৩০০ জন সৈন্য ১৯৮৭ সালে চাদ বাহিনীর হাতে ধরা পড়েন।
লিবিয়া যে চাদে যুদ্ধ করতে বাহিনী পাঠিয়েছে, গাদ্দাফি বরাবরই তা অস্বীকার করছিলেন। কাজেই যখন খালিফা হাফতার এবং তার বাহিনী চাদের সেনাবাহিনীর হাতে ধরা পড়লেন, গাদ্দাফি তাদের দায়িত্ব নিতে অস্বীকৃতি জানালেন। এটি খালিফা হাফতারকে সাংঘাতিক বিক্ষুব্ধ করলো। পরবর্তী দুই দশক ধরে তার প্রধান কাজ হয়ে দাঁড়ালো কিভাবে গাদ্দাফিকে ক্ষমতাচ্যুত করা যায়, সেই চেষ্টা করা।
সেসময় খালিফা হাফতার যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়ায় নির্বাসিত জীবন কাটাচ্ছিলেন। সেখান থেকেই চলছিল তার গাদ্দাফি-বিরোধী তৎপরতা। তিনি থাকতেন সিআইএ’র সদর দফতরের খুব কাছে। তার সঙ্গে সিআইএ’র বেশ ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল বলেই মনে করা হয়। গাদ্দাফিকে হত্যার বেশ কয়েকটি চেষ্টায় সিআইএ তাকে সমর্থন দেয়।

নির্বাসন থেকে দেশে ফেরা
২০১১ সালে লিবিয়ায় গাদ্দাফির বিরুদ্ধে গণ-অভ্যুত্থান শুরু হয়। খালিফা হাফতার এসময় দেশে ফিরে আসেন। লিবিয়ার পূর্বাঞ্চলে বিদ্রোহী বাহিনীর অন্যতম অধিনায়ক ছিলেন তিনি। তবে গাদ্দাফির পতনের পর ২০১৪ সালের ফেব্রæয়ারি পর্যন্ত হাফতারের কথা আর তেমন শোনা যায়নি।
২০১৪ সালে হঠাৎ আবার খালিফা হাফতারকে দেখা গেল টেলিভিশনে। সেখানে তিনি তার ভাষায়, জাতিকে রক্ষার এক পরিকল্পনা হাজির করলেন এবং নির্বাচিত পার্লামেন্টের বিরুদ্ধে জনগণকে রাস্তায় নামার আহ্বান জানালেন। তখনও পর্যন্ত জেনারেল ন্যাশনাল কংগ্রেস (জিএনসি) নামে পরিচিত লিবিয়ার পার্লামেন্ট আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত।
খালিফা হাফতার এমন এক সময় এই নাটকীয় ঘোষণা দেন, যখন কিনা লিবিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর বেনগাজি এবং পূর্বাঞ্চলের অন্যান্য শহর কার্যত আল কায়েদার সহযোগী একটি সংগঠন ‘আনসার আল শরিয়া’ এবং অন্যান্য জঙ্গি ইসলামী সংগঠনের নিয়ন্ত্রণে। তারা লিবিয়ার পূর্বাঞ্চল জুড়ে তখন সামরিক বাহিনী, পুলিশ এবং সরকারি কর্মকর্তাদের ওপর হামলা চালিয়ে তাদের হত্যা করছে, বোমা হামলা চালাচ্ছে।
খালিফা হাফতার যে পরিকল্পনা নিয়ে আগাচ্ছিলেন, সেটি কাজে পরিণত করার মতো যথেষ্ট সমর্থন তার ছিল না। তিনি আসলে তখন লিবিয়ায় যে ব্যাপক জন-অসন্তোষ সেটিরই প্রতিধ্বনি করার চেষ্টা করছিলেন। বিশেষ করে বেনগাজিতে, যেখানে জেনারেল ন্যাশনাল কাউন্সিলের বিরুদ্ধে অসন্তোষ বাড়ছিল। কারণ তারা জঙ্গি ইসলামী গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে কিছুই করতে পারছিল না।
খালিফা হাফতার নিজের এলাকায় জনপ্রিয় হলেও, লিবিয়ার অন্য অঞ্চলে তার তেমন সমর্থন ছিল না। বরং গাদ্দাফির সঙ্গে যে তার একসময় ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল এবং তিনি যে আসলে যুক্তরাষ্ট্রের লোক, সেটাই লোকে মনে রেখেছিল।
অন্যদিকে, ইসলামী জঙ্গি গোষ্ঠীগুলোও খালিফা হাফতারকে পছন্দ করতো না। কারণ তিনি এদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন।

অপারেশন ডিগনিটি
২০১৪ সালের মে মাসে খালিফা হাফতার বেনগাজি এবং লিবিয়ার অন্যান্য অঞ্চলে ইসলামী জঙ্গিদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করেন। তার এই অভিযানের নাম দেয়া হয় অপারেশন ডিগনিটি।
২০১৫ সালের মার্চ মাসে লিবিয়ার নির্বাচিত পার্লামেন্ট হাউজ অব রিপ্রেজেনটেটিভ, যা কিনা জেনারেল ন্যাশনাল কাউন্সিলের জায়গা নিয়েছিল, তারা খালিফা হাফতারকে লিবিয়ান ন্যাশনাল আর্মির অধিনায়ক নিযুক্ত করে। প্রায় এক বছর ধরে লিবিয়ান ন্যাশনাল আর্মির সঙ্গে বেনগাজির ইসলামী জঙ্গিদের লড়াই চলে। শুরুতে লড়াইয়ে তারা তেমন সুবিধা করতে পারেনি। তবে ২০১৬ সালের ফেব্রæয়ারিতে তারা বেনগাজির বেশিরভাগ এলাকা থেকে জঙ্গিদের হটিয়ে দেয়।
২০১৬ সালের মে মাসে তারা আরও সাফল্য পায়। ইসলামী জঙ্গিদের তারা এবার শুধু বেনগাজির উপকন্ঠ নয়, ২৫০ কিলোমিটার পূর্বের ডারনা শহর পর্যন্ত হটিয়ে দেয়।

অপারেশন সুইফট থান্ডার
২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে অপারেশন সুইফট থান্ডার শুরু করে লিবিয়ান ন্যাশনাল আর্মি। উদ্দেশ্য ছিল লিবিয়ার গুরুত্বপূর্ণ তেল স্থাপনাগুলোর দখল নেয়া। তখন পর্যন্ত এগুলো নিয়ন্ত্রণ করতো ‘পেট্রোলিয়াম ফ্যাসিলিটিজ গার্ড’ নামের একটি বাহিনী। এই সশস্ত্র বাহিনী ছিল জাতিসংঘের সালিশে গঠিত ‘গভর্নমেন্ট অব ন্যাশনাল একর্ড’ বা জিএনএ’র অনুগত। লিবিয়ার গুরুত্বপূর্ণ সব তেল টার্মিনাল এদের কাছ থেকে কেড়ে নেয় হাফতারের নেতৃত্বে লিবিয়ান ন্যাশনাল আর্মি।
এর স্বীকৃতি হিসেবে খালিফা হাফতারকে লেফটেন্যান্ট জেনারেল থেকে পদোন্নতি দিয়ে ফিল্ড মার্শাল করা হয়। তবে খালিফা হাফতার নাকি জিএনএ’র কাজ-কর্মে অখুশি ছিলেন। কারণ এই সরকার প্রতিরক্ষার দায়িত্ব দিয়েছিল ইব্রাহিম আল বারগাতি বলে এক অফিসারকে।
মিসরাতা ভিত্তিক যে মিলিশিয়া বাহিনী, তাদের ওপর খুব বেশি নির্ভর করতো জিএনএ। এই মিলিশিয়াদের সঙ্গে নাকি আবার ইসলামী জঙ্গিদের সম্পর্ক ছিল। এ নিয়েও অখুশি ছিলেন খালিফা হাফতার।
২০১৫ সালের ডিসেম্বরে লিবিয়ায় একটি জাতীয় ঐক্যের সরকার গঠনের জন্য চুক্তি হয়। তাতে বলা হয়েছিল, হাউজ অব রিপ্রেজেনটেটিভ বা পার্লামেন্ট নতুন সরকার গঠিত হওয়ার এক মাসের মধ্যে এটিকে অনুমোদন দেবে। কিন্তু কয়েকবার চেষ্টা করেও কোরামের অভাবে এই পার্লামেন্টের কোন অধিবেশন শুরু করা যায়নি।
গণমাধ্যমের খবরে তখন এজন্যে দোষারোপ করা হচ্ছিল খালিফা হাফতারকে। তিনি নাকি তার অনুগত পার্লামেন্ট সদস্যদের নির্দেশ দিয়েছিলেন পার্লামেন্টে না যেতে, যাতে করে নতুন মন্ত্রিসভা এই পার্লামেন্টের অনুমোদন না পায়।
খালিফা হাফতার অবশ্য বলছিলেন, তিনি পার্লামেন্টের যে কোন সিদ্ধান্ত মেনে চলবেন। কিন্তু নিজের রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্খা নিয়ে খালিফা হাফতার খুব খোলামেলাভাবে কখনো কিছু বলেননি। তবে ধারণা করা হয়, তিনি নতুন জাতীয় ঐক্যের সেনাবাহিনীতে নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় দেখতে চান।

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ