চরিত্র মানুষের শ্রেষ্ঠতম অলঙ্কার
সৃষ্টির সেরা জীব আশরাফুল মাখলুকাত- মানবজাতি। এ শ্রেষ্ঠত্ব মানুষ তার চরিত্র দিয়ে অর্জন করে নেয়।
“কোন কালে একা হয়নি’ক জয়ী পুরুষের তরবারী, শক্তি জুগিয়েছে প্রেরণা দিয়েছে বিজয়ী লক্ষী নারী” জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের এ উক্তিটি সবারই জানা। সৃষ্টিগতভাবে নারী ও পুরুষের সংখ্যা ও সম্পর্ক অত্যন্ত কাছাকাছি। পৃথিবীতে মানুষের আগমন ও জীবন প্রবাহের বাকে বাকে রয়েছে নারী ও পুরুষ কেন্দ্রীক এক অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক। নারী ও পুরুষ অখন্ড মানব সমাজের দুইটি অপরিহার্য অঙ্গ যারা সব সময়ই একে অপরের পরিপুরক। এর একটিকে বাদ দিয়ে অন্যটির কল্পনা করা যায় না। নারীর অধিকার নিয়ে প্রচুর চর্চা হলেও সামাজিক ও ধর্মীয় ভাবে নারীকে এখনও দেখা হয় নিচু মানসিকতার চোখ দিয়ে। শুধু অর্থনৈতিক ভাবে স্বাবলম্বী হলেই যে নারীরা তাদের অধিকার ফিরে পাবে একথা মোটেই যৌক্তিক নয়। বরং পরিবার, সমাজ, রাষ্ট ও ধর্মীয় জীবনেও নারীর জন্য রয়েছে স্বাধীনতা ও মৌলিক অধিকার। কেননা পুরুষ সমাজের একাংশের প্রতিনিধিত্ব করে আর অন্য অংশের প্রতিনিধিত্ব করে নারী। নারী যেমন পুরুষ ছাড়া চলতে পারে না তেমনি পুরুষরাও পারে না নারীবিহীন কোন সমাজ কল্পনা করতে। পরস্পর এই মুখোপেক্ষিতা সামাজিক, জৈবিক, মনস্তাত্তিক সকল দিক দিয়ে।
হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রীষ্টান সহ নানা ধর্মের মানুষের একসাথে বসবাস আমাদের এই ছোট্র দেশটিতে। সকল ধর্মেই নারীর জন্য রয়েছে আলাদা আলাদা নিয়ম রীতি ও জীবনাচার পদ্ধতি। ইসলাম ধর্মীয়ভাবে নারীকে সবচেয়ে বেশি মযাদা দিয়েছে। মা, বোন, স্ত্রী হিসাবে ধর্মীয়ভাবে নারীকে সম্মানীত করেছে। আমাদের দেশে নারীর পারিবারিক ও সামাজিক অধিকারে আদায়ে আমরা যতটা তৎপর তারচেয়ে অনেক গুণে পিছিয়ে আছি নারীর ধমীয় স্বাধীনতা ও অধিকার আদায়ে। আমাদের দেশের নারীদের ধর্ম পালন ও ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলতে না পারার পেছনে নানাবিধ কারণ বিদ্যমান রয়েছে।
পারিবারিক বাধার কারনে আমাদের দেশের নারীরা অধিকাংশ সময় অগ্রসর হতে পারে না। নারী শুধুমাত্র ঘর সামলাবে, ঘরের কাজকর্ম করবে এই অনুভুতি পুরুষ বা বাড়ির কর্তা ব্যক্তিদের থাকার কারনে তারা মহিলাদেরকে ধর্মীয় সভা সমাবেশ, মাহফিল, দ্বীনি তালিম ইত্যাদি কাজে বাধা প্রদান করে থাকে। যার কারনে নারীরা ধর্ম সম্পর্কে জ্ঞানার্জন এবং ভাল কোন চর্চা করতে পারছে না। গতানুগতিক চিন্তার বাইরেও যে বিশাল জ্ঞানের জগৎ রয়েছে সে সম্পর্কে নারীরা এখনো অনেক পিছিয়ে।
মানসিকতার পরিবর্তন না হওয়া। আমাদের সমাজের অধিকাংশ নারী এখনো মনে করে যে ধর্ম এবং কর্ম এগুলো পুরুষ মানুষের কাজ। তারা নারী এজন্য তারা বাবার বাড়িতে কিছুদিন এবং স্বামী বা শ্বশুর বাড়িতে কাজ করে জীবন অতিবাহিত করবে। ধর্ম সম্পর্কে জানা বোঝা এগুলো তাদের কাজ নয়। এজাতীয় প্রাচীন ধ্যান ধারনা বিশেষ করে আমাদের গ্রামাঞ্চলের মহিলাদের মধ্য এখনো বিদ্যমান থাকার কারনে তারা এখনো ধমীয় নানা বিষয়ে কুসংস্কার মেনে চলেন। আবার শিক্ষিত, জ্ঞানবান প্রগতিশীল অনেক নারী মনে করেন ধমীয় অনুশাসন তাদের চলার ক্ষেত্রে বড় একটি প্রতিবন্ধকতা বা ব্যক্তি স্বাধীনতার হস্তক্ষেপ। এমন অযৌক্তিক ও অবাস্তব ধারনা বা মানসিকতার দরুন তারা ধর্ম পালনে অনেকটা পিছিয়ে থাকেন এবং সন্তানাদি ও আদর্শ পরিবার গঠনে ধমীয় উদাসীনতার পরিচয় দিয়ে থাকেন।
আমাদের দেশের নারীদের মধ্যে এখনো অন্ধ বিশ্বাস রয়েছে চরম আকারে। কোন কোন ক্ষেত্রে দেখা যায় পিতা বা স্বামী অজ্ঞতার কারনে মেয়েদের লেখাপড়া করাকে অহতেুক বা অপ্রয়োজনীয় বলে থাকেন আর মেয়েরাও ধমীয় ও সামাজিক অন্ধতার কারনে লেখাপড়া থেকে নিজেদের পিছিয়ে রাখেন। যদিও এগুলো তাদের সামাজিক ও ধমীয় অধিকার। নিজেদের এই ধর্মান্ধতার আদলে শুধু তারা নিজেরা ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে না, সন্তানাদি সহ পরবর্তী প্রজন্মকে এই অন্ধ বিশ্বাসে বিশ্বাসী করে গড়ে তুলছেন।
যুগ যুগ ধরে চলে আসা ধমীয় গোড়ামী থেকে মুক্তি পায়নি আমাদের দেশের নারী সমাজ। বিশ্ব যখন এগিয়ে চলেছে নারী পুরুষের সম্মিলিত অগ্রযাত্রার মাধ্যমে তখন আমাদের দেশের নারীরা বসে আছে ধমীয় গোড়ামী নিয়ে। মাদ্রাসায় যাওয়া যাবে না, স্কুলে পড়া যাবে না, চাকরী করা যাবে না, ব্যবসা করা যাবে না এ রকম নানাবিধ গোড়ামী পায়ে শিকল পড়িয়ে দিয়েছে আমাদের অগ্রযাত্রাকে। অথচ কোন ধর্মই মেয়ের উপরোক্ত কাজকে বাধা দেয় না বরং উৎসাহিত করে। ধর্মীয় অনুশাসন মেনে নারীরা সকল কাজই করতে পারে। শুধুমাত্র নারীদের গোড়ামী তাদেরকে সকল কাজ থেকে পিছিয়ে রাখছে।
জ্ঞানার্জনে অনীহা। আমাদের দেশের নারীরা সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বাবলম্বী হলেও জ্ঞানার্জনে তাদের এখনো ব্যাপক অনীহা রয়েছে। বিশেষ করে ধমীয় জ্ঞানের ব্যাপারে এখনো উদাসীনতার শেষ নেই। ইবাদত বন্দেগী, অর্চনা পদ্ধতি সহ ধমীয় অনুশাসন মেনে চলার জন্য যে জ্ঞান দরকার তা অর্জন করার ব্যাপারে অধিকাংশ নারীদের মধ্যে সচেতনতা কম। নারীদের জ্ঞান অর্জনের পথকে আরো সহজ ও নিরাপদ করা করা দরকার। সেই সাথে এক্ষেত্রে নারীদের অনীহা দুর করতে নানামূখী পদক্ষেপ গ্রহণ করাও জরুরী।
সভ্যতার নামে দেউলিয়াপনাকে গ্রহণ করা। বাঙ্গালী জাতি হিসাবে আমাদের সভ্যতা ও সংস্কৃতি অনেক সমৃদ্ধ। বিশেষ করে ধর্ম ও সমাজ উভয়ের সমন্বয়ে আমাদের কালচার অন্যান্য জাতির চেয়ে অত্যন্ত শালীন। কালের ব্যভধানে ও বিদেশী সংস্কৃতির আগ্রাসনে আমাদের দেশের নারীরা নিজেদের বিলীন করে দিচ্ছে অপসাংস্কৃতির আগ্রাসনে। যার ফলে তারা সভ্যতার নামে দেউলিয়াপনাকে গ্রহণ করে চলেছে। যেখানে নেই কোন নিজেস্ব সংস্কৃতি, শিক্ষা, ধর্মীয় কোন আচরণ। আস্তে আস্তে তারা নিজেদের নিয়ে যাচ্ছে সমাজ ধর্ম থেকে অনেক দুরে।
সর্ব পর্যায়ে নারীর প্রতি ঋনাত্বক দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের দেশের নারীদের পিছিয়ে দিচ্ছে সামাজিক ও ধমীয় ভাবে। জ্ঞানার্জনে নারীকে হেয় করা, চাকরী ব্যবসা সব কিছুতে নারীকে এই বিরূপ ও ঋনাত্বক মনোভাব থেকে মুক্ত না করলে তাদের নারীর প্রকৃত স্বাধীনতা ফিওে পাবে না।
উপরোক্ত কারণগুলোতে আমাদের দেশের নারীরা ধমীয় দিক দিয়ে দুরে থাকলেও নারীদের ধর্ম পালনে সকল অসুবিধার জন্য পুরুষ সমাজও কম দায়ী নয়। পুরুষদের জন্য ধর্ম পালনের যাবতীয় সুব্যবস্থা থাকলেও নারীদের জন্য নেই কোন ব্যবস্থাপনা। যার কারনে অনেক সময় ইচ্ছা থাকলেও অনেক নারী ধর্ম ও ধমীয় অনুশাসন মেনে চলতে পারে না।
যেমন
সমস্যা সমুহ: সব জায়গায় মসজিদ না থাকা। ইসলাম নারী ও পুরুষ উভয়ের জন্য ইবাদত পালন আবশ্যকীয় করেছে। এমনকি মহিলাদের জামাতে নামাজ আদায় করার ব্যাপারেও বলা হয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশে মহিলাদের ঘরের বাইরে নামাজ আদায় করার কোন ব্যবস্থা নেই। পারিবারিক ও অন্যান্য কাজে এখন প্রায়ই নারীরা ঘরের বাইরে থাকেন। অফিস, মার্কেট, ব্যবসা ইত্যাদি কাজে মহিলাদের বাইরে যেতে হয় কিন্তু সেখানে নামাজ আদায় করার কোন ব্যবস্থা না থাকার কারনে তারা বাসায় গিয়ে নির্দিষ্ট সময়ের পরে কেউ কেউ নামাজ পড়ছেন আবার অনেকেই পড়তে পারছেন না। প্রায় সময়ই দেখা যায় স্বামী বা পিতা মসজিদে নামাজ আদায় করছেন আর মেয়ে বা স্ত্রী বাইরে দাড়িয়ে থাকছেন। যদিও তার উক্ত ইবাদত করার ইচ্ছা ও সময় দুইটাই থাকে। শুধু মাত্র সুযোগ না থাকার কারনে হয়ে উঠছে না।
অনুরুপ ভাবে স্কুল কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, মাদ্রাসায় আলাদা কোন নামাজঘর না থাকায় অনেক শিক্ষিকা, ছাত্রী কেউই যথা সময়ে নামাজ আদায় করছেন না।
এছাড়া শিক্ষা প্রতিষ্টানসহ সকল জায়গায় মহিলাদের জন্য আলাদা কোন ক্যান্টিন না থাকায় পর্দানশীল নারীরা ধর্মীয় অনুশাসন মেনে খাবার গ্রহণ করতে পারছেন না।
চাকরীর ক্ষেত্রে দেখা যায় অফিস স্টাফদের জন্য আলাদা খাবার ব্যবস্থা প্রায়ই থাকে না। যার কারনে একদিকে যেমন ধর্মীয় অনুশাসন মানতে ব্যর্থ হচ্ছেন অন্য দিকে নারীদের নিরাপত্তা বিগ্নিত হচ্ছে।
নারীদের ধর্ম পালনে এসকল প্রতিবন্ধকতা দুর করে তাদের নিরাপত্তাসহ যাবতীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা এখন সময়ের দাবী। এ ক্ষেত্রে শহর অঞ্চলে যেখানে পুরুষদের জন্য নামাজের ব্যবস্থা আছে সেখানে নারীদের জন্য আলাদা কোন ব্যবস্থা করা। প্রয়োজনে শহরে বিভিন্ন পয়েন্টে নারীদের জন্য পৃথক মসজিদ নির্মাণ করার দাবী এখন অনেকেরই। আমার কাছের একজন আন্টি বলেন আমরা বাড়ির বাইরে বের হলে নামাজ পড়তে পারি না। কারণ আমাদের জন্য না আছে কোন সুব্যবস্থা আর না আছে পৃথক কোন মসজিদ। যদি আমাদের জন্য আলাদা কোন ব্যবস্থা থাকতো!!!! (মুলত তার এই অভিব্যক্তির পরই লেখা শুরু করা।)
নামাজের ব্যবস্থার পাশাপাশি স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা সহ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও কর্মসংস্থানে নারীর জন্য ধর্মীয় অনুশাসন সহজ করত: তাদের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য সংশ্লিষ্ট সকলের কার্যকরী ভুমিকা সময়ের দাবী।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।