Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সন্তানদের মাঝে হেবাসূত্রে সম্পদ বণ্টনের শরয়ী বিধান

মুহাম্মাদুল্লাহ আরমান | প্রকাশের সময় : ৪ অক্টোবর, ২০১৯, ১২:০২ এএম

ইসলামের উত্তরাধিকার আইন অনুযায়ী যদিও ছেলে-মেয়ের প্রাপ্ত সম্পদে বৈষম্যের বিষয়টি স্বীকৃত এবং এই বিধান মহান রব্বুল আলামীনের পক্ষ থেকেই প্রদত্ত, কিন্তু হেবাসূত্রে সম্পদ বণ্টনের মাসআলা এর থেকে ভিন্ন। এখানে বৈষম্যের সুযোগ নেই। অর্থাৎ কোনো ব্যক্তি যদি তার জীবদ্দশায় নিজ সন্তানদের মাঝে সম্পদ বণ্টন করে তাহলে তার জন্য সব ছেলে-মেয়ের মাঝে সমানহারে সম্পদ বণ্টন করা মুস্তাহাব। মেয়েকেও ছেলের সমান সম্পদ দিবে। জুমহুর উলামায়ে কেরাম বলেছেন, সম্পদ বণ্টনে ছেলে-মেয়ের মাঝে বৈষম্য না করার বিষয়টি শরয়ী দলীলের আলোকে অধিক শক্তিশালী এবং অগ্রগণ্য এবং এর ওপরই ফতোয়া।Ñ(ফাতাওয়া আলমগীরী ৪/৩০১; আলবাহরুর রায়েক ৭/৪৯০; তাকমেলায়ে ফাতহুল মুলহিম ২/৭৫; কিতাবুন নাওয়াযেল ১২/১৮৫, ১৮৭) 

অবশ্য মুফতী তাকী উসমানী দা.বা. বলেছেন, যদি জীবিত অবস্থায় সম্পদ বণ্টনের উদ্দেশ্য হয়Ñ পিতার ইন্তেকালের পর যেন সন্তানদের মাঝে ঝগড়া না হয় সে জন্য মিরাছসূত্রে অগ্রিম সম্পদ বণ্টন করে দেয়া, তাহলে সেখানে শরীয়তের ফারায়েয নীতি অনুসারে ছেলেকে মেয়ের দ্বিগুণ দেয়া যাবে। তিনি বলেন, এই মাসআলাটি যদিও আমি স্পষ্টভাবে ফুকাহায়ে কেরামের বক্তব্যে পাইনি তবুও আশা করি মাসআলাটি তাঁদের মূলনীতির বাইরে যাবে না।Ñ(তাকমেলায়ে ফাতহুল মুলহিম ২/৭৫)
এখানে একটি বিষয় মনে রাখতে হবে, হেবা এবং মিরাছ এক জিনিস নয়। হেবা হলো, কেউ তার জীবদ্দশায় সন্তুষ্টচিত্তে কাউকে কোনো সম্পদ দান করে দেয়া। আর মিরাছ হলো, কারও ইন্তেকালের পর অবধারিতভাবে তার থেকে ওয়ারিসের প্রাপ্ত সম্পদ। দু’টোর মাঝে বিস্তর পার্থক্য আছে। হেবার ক্ষেত্রে ব্যক্তির কিছুটা স্বাধীনতা থাকলেও মিরাছ বণ্টনের ক্ষেত্রে ব্যক্তি শরীয়তের সীমার বাইরে যেতে পারে না। কমবেশি করতে পারে না। সে হিসেবে কোনো ব্যক্তি হেবাসূত্রে তার সম্পদ সন্তানদের মাঝে বণ্টন করার ক্ষেত্রে তার স্বাধীনতা থাকার দরকার ছিল, কমবেশি করার অধিকার পাওয়া উচিৎ ছিল, যেমনিভাবে তৃতীয় কোনো ব্যক্তিকে দান করার সময় তিনি স্বাধীনভাবে কমবেশি করে দিতে পারেন; কিন্তু সন্তানের বেলায় শরীয়ত পরিপূর্ণভাবে এই স্বাধীনতা দেয়নি। সান্তানদের হেবাসূত্রে সম্পদ দান করলে বৈষম্য করা অনুচিৎ। কারণ সন্তানের মাঝে বৈষম্যের মাধ্যমে ভবিষ্যতে তাদের পরস্পরে ঝগড়া লাগার সম্ভাবনা আছে। পিতার প্রতি অশ্রদ্ধা এবং অভক্তি তৈরি হওয়ার আশঙ্কা আছে কিংবা হেবার মধ্য দিয়ে কোনো সন্তানকে সম্পদ থেকে বঞ্চিত করার সুযোগ খোঁজা হতে পারে। এ জন্যই সহাবী হযরত নোমান ইবনে বশীর রাযি. যখন তার ২য় স্ত্রীর প্ররোচণায় পরের ঘরের এক ছেলেকে কিছু দিতে চাইলেন, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তুমি তোমার সব সন্তানকে এভাবে দিয়েছো?’ নোমান রাযি.-এর ‘না’ উত্তর শুনে নবীজি তাকে বলেন, ‘আল্লাহকে ভয় করো এবং সন্তানদের মাঝে ইনসাফ করো।’Ñ(সহীহ বুখারী : ২৫১৫; ইলাউস সুনান : ৫২৭৭)
অন্য বর্ণনায় এসেছেÑ হযরত নোমান ইবনে বশীর (রাযি.) বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘তোমরা (সম্পদ বণ্টনের ক্ষেত্রে) তোমাদের সন্তানদের মাঝে ইনসাফ করো। তোমাদের সন্তানদের মাঝে ইনসাফ করো।’Ñ(সহীহ বুখারী : ১/৩৫২; সুনানে আবুদাউদ : ৩৫৪৪)
তাই হেবাসূত্রে সন্তানদের মাঝে সম্পদ বণ্টন করার ক্ষেত্রে ইনসাফ এবং সমতার প্রতি লক্ষ্য রাখা খুবই জরুরী। এ জন্যই ইমাম আবু ইউসুফ রহ. বলেছেন, স্বাভাবিকভাবে সন্তানদের মাঝে সমানভাবে সম্পদ বণ্টন করা মুস্তাহাব হলেও যদি পিতার পক্ষ থেকে কোনো সন্তানের ক্ষতিসাধনের ইচ্ছা থাকে তখন সমানভাবে সম্পদ বণ্টন করা ওয়াজিব।Ñ(ফাতাওয়া আলমগীরী ৪/৩৯১; উমদাতুল কারী ৬/১৪৬ বৈরুত)
বৈষম্য করা মাকরুহ
স্বাভাবিক অবস্থায় হেবাসূত্রে সন্তানকে সম্পদ দেয়ার ক্ষেত্রে বৈষম্য না করা মুস্তাহাব হলেও কেউ যদি বৈষম্য করে তবে তা মাকরুহ হবে, হারাম হবে না। তবে হ্যাঁ, কেউ যদি কোনো সন্তানের দীনী বিষয়ে অগ্রগণ্যতার কারণে অথবা মাতা-পিতার অধিক খেদমতের কারণে তাকে সামান্য সম্পদ বাড়িয়ে দেয় তবে তা মাকরুহ হবে না। তবুও ফুকাহায়ে কেরাম বলেছেন, এ ক্ষেত্রেও বৈষম্য না করাই উত্তম। উল্লেখ্য, এ ধরনের বৈষম্য যদি অন্য সন্তানরা সন্তুষ্টচিত্তে মেনে নেয় তাহলে তা সর্বাবস্থায় জায়েয।Ñ(আলবাহরুর রায়েক ৭/৪৯০; কিতাবুন নাওয়াযেল ১২/২০১৮)
আর কেউ যদি অন্য সন্তানকে বঞ্চিত করে হেবাসূত্রে এক সন্তানকে সব সম্পদ দিয়ে দেয় এবং ওই সন্তানও তা দখল (কবয) করে নেয় তাহলে বিষয়টি নাজায়েয এবং গুনাহের কাজ হলেও হেবানামা কার্যকর হয়ে যাবে। অর্থাৎ অন্য সন্তানরা আইনীভাবে পিতার সম্পদ তাদের এই ভাই অথবা বোনের কাছ থেকে নিতে পারবে না। ফুকাহায়ে কেরাম লিখেছেনÑ ‘কিছু সন্তানকে হেবাসূত্রে সম্পদ বাড়িয়ে দেয়া মাকরুহ। তবে কোনো সন্তানের ধর্মীয় ক্ষেত্রে অগ্রগণ্যতা থাকলে ভিন্ন কথা। কেউ যদি তার সমস্ত সম্পদ একজনকে দিয়ে দেয় তাহলে তা বিচারিক দৃষ্টিকোণ থেকে বৈধ হলেও ওই ব্যক্তি গুনাহগার হবে।’Ñ(আলবাহরুর রায়েক ৭/২৮৮; ফাতাওয়া আলমগীরী ৪/৩৯১; উমদাতুল কারী ৬/১৪৬)
হেবার একটি মূলনীতি হলো, কেউ কোনো সম্পদ কাউকে হেবা করার পর যদি ওই ব্যক্তি তা নিজের দখলে নিয়ে নেয় তাহলে অন্য কারও জন্য ওই সম্পদে আর হস্তক্ষেপ করার সুযোগ থাকে না। এতে তার মালিকানা তৈরি হয়ে যায়। দানকারী যদি তার জীবিত অবস্থায় দানকৃত সম্পদ ফিরিয়ে না নেয় তাহলে তার অন্য ওয়ারিসদের এতে হস্তক্ষেপ করার সুযোগ থাকে না। সে হিসেবে দাতা গুনাহে লিপ্ত হয়ে এক সন্তানকে সব সম্পত্তি দিয়ে দিলেও অন্য সন্তানরা এতে হস্তক্ষেপ করতে পারবে না; যদিও অভিবাবকের জন্য এমন কাজ করা মোটেই ন্যায়সঙ্গত ও উচিৎ নয়।Ñ(মাসাইলুল জমহুর ২/৫৯৮; আদ্দুররুল মুখতার ৮/৪৯০; ফাতাওয়া আলমগীরী ৪/৩৭৪)
জীবিত অবস্থায় হেবা গ্রহণ না করলে
কেউ তার কোনো এক সন্তানকে মৌখিকভাবে হেবা করে মারা গেল। তার জীবদ্দশায় ওই সন্তান কাগজে-কলমে হেবাকৃত সম্পদ গ্রহণ করেনি বা নিজের মালিকানায় নেয়নি, তাহলে এই হেবা কার্যকর হবে না। শরয়ী নিয়মানুযায়ী সব ওয়ারিসদের মাঝে তা বণ্টন করতে হবে।Ñ(আসসুনানুল কুবরা, বায়হাকী : ১২১৮৬; মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক : ৯/১০২; কিতাবুন নাওয়াযেল ১২/২১১; হেদায়া ৩/২৮৫)

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ