Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

বিশ্বময় ইসলামের জাগরণ - সারা বিশ্বে একই দিনে রোজা ও ঈদ একটি বিশ্লেষণ

প্রকাশের সময় : ১৬ জুন, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মোহাম্মদ বশির উল্লাহ
সারা বিশ্বে একই দিনে রোজা ও ঈদ পালন নিয়ে বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে একশ্রেণির মানুষের মধ্যে ব্যাপক তোলপাড় লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ইতিপূর্বে ১৯৮৬ সালের ১১-১৬ অক্টোবর ওআইসির অঙ্গ সংগঠন ‘ইসলামী ফিকহ একাডেমি’ জর্ডানের রাজধানী আম্মানে এ ব্যাপারে একটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেও এখন পর্যন্ত ওআইসি কার্যকরী কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারেনি। কারণ এ বিতর্কিত সিদ্ধান্তটি ছিলো কেবলই যুক্তিনির্ভর; শরী’আত কিংবা বাস্তবতার নিরিখে এর কোনো ভিত্তি নেই। তবুও সাধারণ মানুষের মধ্যে যেহেতু এ নিয়ে গুঞ্জরণ সৃষ্টি হয়েছে, তাই এ ব্যাপারে কোরআন হাদিস এবং বাস্তবতার আলোকে বিষয়টি বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন।
মূলত শারঈ দৃষ্টিকোণ থেকে যদি আমরা লক্ষ করি তাহলে স্পষ্টই বোঝা যায় যে, কোরআন ও হাদিসে মাস গণনার জন্য চাঁদ দেখার যে নির্দেশনা এসেছে তা স্থানিক তথা একটি নির্দিষ্ট জনসমষ্টির জন্য প্রযোজ্য, যাদের উপর চন্দ্র উদিত হয়েছে। যেমনÑ আল্লাহতায়ালা বলেন, “তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি এ মাস (রমজান) পাবে, সে যেন রোজা রাখে।” (সূরা আল বাকারা : ১৮৫) প্রিয়নবী (সা.) বলেছেন, “তোমরা চাঁদ দেখে ছিয়াম রাখ এবং চাঁদ দেখে ছিয়াম ভঙ্গ কর।” (বুখারি, মুসলিম, মিশকাত হাদিস নং-১৯৭০)
যদি হাদিসে বর্ণিত এই নির্দেশটি স্থানিক না হয়ে সমগ্র বিশ্বের জন্য প্রযোজ্য হতো তাহলে চাঁদের সর্বপশ্চিমের উদয়স্থল তথা বর্তমান আমেরিকা মহাদেশকে অথবা পৃথিবীর মধ্যস্থল হিসেবে সউদি আরবকে শরীয়তে মানদ- হিসেবে গ্রহণ করা হতো এবং সেখানে চাঁদ দেখা মাত্রই সমগ্র বিশ্বে একই স্থানে সিয়াম ও ঈদ পালনের জন্য নির্দেশ দেয়া হতো। কিন্তু কোরআন ও হাদিসের কোথাও এর প্রমাণ পাওয়া যায় না। বরং তাৎপর্যপূর্ণভাবে কোরআনের ভাষাটি এসেছে এভাবে যে, “যারা এ মাস পাবে” এখানে সকলকে উদ্দেশ্য নয় বরং তারাই উদ্দেশ্য যারা চাঁদ দেখতে পাবে। হাদিসের ব্যাখ্যা থেকে যা আরো সুস্পষ্ট হয়। অতএব রমজানে সিয়াম রাখা ও রমজান শেষে ঈদ পালন করার সাথে ব্যক্তি বা ব্যক্তিসমষ্টির চাঁদ দেখা শর্ত। এটাই আরবি মাস বা চান্দ্রমাস নির্ণয়ের চিরাচরিত ও স্বতঃসিদ্ধ পদ্ধতি।
আধুনিক যুগে স্যাটেলাইট আবিষ্কারের পূর্বে এ নিয়ে কখনও এভাবে প্রশ্ন ওঠেনি। মূলত চন্দ্র ও সূর্য একই নিয়মে পৃথিবীর চতুর্পাশে ঘূর্ণায়মান। চন্দ্র হলো মাসের সময় নির্ধারক, আর সূর্য হলো দিনের সময় নির্ধারক। কোন স্থানে সূর্য উদয়ের সাথে সাথে যেমন দিনের শুরু হয় তেমনি অমাবস্যার পর চন্দ্র উদয়ের সাথে সাথে মাসের শুরু হয়। এটাই স্বতঃসিদ্ধ প্রাকৃতিক রীতি। এভাবেই চন্দ্র ও সূর্য প্রকৃতির নিয়মে একে অপরের সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। এক্ষণে সিয়াম ও ঈদ পালনে এই প্রাকৃতিক চক্রকে (ঘধঃঁৎধষ পুপষব) অস্বীকার করা যেমন অবৈজ্ঞানিক, তেমনই অজ্ঞতার পরিচায়ক।
নি¤েœ এ বিষয়ে ভিন্নমত পোষণকারীদের কিছু প্রমাণ ও যুক্তি খ-ন করা হলো।
১. যারা বর্তমানে একই দিনে সিয়াম ও ঈদ পালনের দাবি তুলেছেন তারা এই হাদিসটি প্রমাণ হিসেবে পেশ করতে চান, ‘দু’জন ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তি চাঁদ দেখার সাক্ষী দিলে প্রিয়নবী (সা.) সিয়াম পালন ও তা ভঙ্গ করার নির্দেশ দিয়েছেন। (নাসাঈ শরিফ, হাদিস নং ২১১৬) অতএব আধুনিক মিডিয়ার মাধ্যমে বিশ্বের কোনো স্থানে চাঁদ দেখার খবর পেলেই তা সমগ্র বিশ্বের জন্যই প্রযোজ্য হবে। এখন প্রশ্ন হলো, উক্ত সাক্ষ্য দুনিয়ার সকল মানুষের জন্য প্রযোজ্য হবে কিনা? এ ব্যাপারে মানুষের মস্তিষ্কপ্রসূত যুক্তিকে পদদলিত করে সাহাবায়ে কেরামের আমলকে অগ্রাধিকার দেয়াই যথার্থ হবে। “বিশিষ্ট সাহাবি কুরাইব (রা.) থেকে বর্ণিত আছে, তিনি সিরিয়ায় রমজানের রোজা রেখে মাস শেষে মদিনায় ফিরে এখানকার রোজার সাথে এক দিন কমবেশি দেখতে পান। এ বিষয়ে ইবনু আব্বাস (রা.) কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, ওখানে তোমরা শুক্রবার সন্ধ্যায় চাঁদ দেখেছ। অতএব আমরা সিয়াম চালিয়ে যাব, যতক্ষণ না ঈদের চাঁদ দেখতে পাব। অন্য বর্ণনায় এসেছে, আমরা ৩০ দিন পূর্ণ করব। তাকে বলা হলো, মু’আবিয়ার চাঁদ দেখা ও সিয়াম রাখা কি আপনার জন্য যথেষ্ট নয়? তিনি বললেন, না। এভাবে প্রিয়নবী (সা.) আমাকে নির্দেশ করেছেন।” (জামে তিরমিযী, হাদিস নং ৫৫৯; আবু দাউদ, হাদিস নং ২০৪৪) ইমাম নববী (রহ.) বলেন, এ হাদিস স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে যে, এক শহরের চন্দ্র দর্শন অন্য শহরে প্রযোজ্য নয় অধিক দূরত্বের কারণে। (মি’রআত ৬ষ্ঠ খ-, ৪২৮ পৃষ্ঠা, হাদিস নং ১৯৮৯ এর ব্যাখ্যা)
উল্লেখ্য যে, সিরিয়া মদিনা থেকে উত্তর-পশ্চিমে এক মাসের পথ অর্থাৎ ৭০০ মাইলের দূরত্ব। সময়ের পার্থক্য ১৪ মিনিট ৪০ সেকেন্ড। সম্ভবত সে কারণেই সেখানে মদিনার একদিন পূর্বে চাঁদ দেখা গিয়েছিল। মিশকাতের ভাষ্যকর ওবায়দুল্লাহ মুবারকপুরী (১৩২২-১৪১৪ হিঃ/ ১৯০৪-১৯৯৪ খ্রি.) বলেন, ‘পশ্চিম দিগন্তে ভূপৃষ্ঠ থেকে নবচন্দ্রের উদয়কালের উচ্চতার আধুনিক হিসাব মতে পশ্চিম অঞ্চলে চাঁদ দেখা গেলে পশ্চিমাঞ্চলসহ সেখান থেকে অন্যূন ৫৭০ মাইল দূরত্বে পূর্বাঞ্চলের অধিবাসীদের জন্য ঐ চাঁদ গণ্য হবে। আর যদি পূর্বাঞ্চলে চাঁদ দেখা যায়, তা’হলে পশ্চিমাঞ্চলে অনুরূপ দূরত্বের অধিবাসীদের জন্য উক্ত চাঁদ গণ্য হবে। (মির’আত ৬ষ্ঠ খ- ৪২৯ পৃষ্ঠা. হাদিস নং ১৯৮৯ এর ব্যাখ্যা)
সর্বাধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানের মতে উক্ত হিসেবে মক্কা শরিফে চাঁদ দেখা অঞ্চলের দেশসমূহের ৫৬০ মাইল পর্যন্ত উক্ত চাঁদ দেখা যাওয়া সম্ভব এবং উক্ত দূরুত্বের অধিবাসীগণ উক্ত চাঁদের হিসাব সিয়াম ও ঈদ পালন করতে পারেন। উল্লেখ্য যে, এই মাইলের হিসাব সরাসরি আকাশ পথের মাইল, সড়ক পথের নয়। (চলবে)



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: বিশ্বময় ইসলামের জাগরণ - সারা বিশ্বে একই দিনে রোজা ও ঈদ একটি বিশ্লেষণ
আরও পড়ুন