Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ঝালকাঠির বিআরটিএ কর্মকর্তাকে ঘুষ দিলেই মেলে লাইসেন্স

ঝালকাঠি জেলা সংবাদদাতা | প্রকাশের সময় : ৬ জুলাই, ২০১৯, ১:৫৭ পিএম

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) ঝালকাঠির সহকারী পরিচালকের বিরুদ্ধে ঘুষ নিয়ে মোটরযান রেজিস্ট্রেশন ও ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রদানের অভিযোগ পাওয়া গেছে। দালালের মাধ্যমে ঘুষ নিয়ে ঝালকাঠি জেলার বাইরের লোকজনকেও লাইসেন্স দিচ্ছেন তিনি। সরকার নির্ধারিত টাকার দ্বিগুণ টাকা না দিলে লাইসেন্স দেওয়া হয় না বলেও অভিযোগ করেছেন মোটরযান চালকরা। বুধবার দুপুরে চট্টগ্রাম বিভাগের ১১জনকে ঝালকাঠি বিআরটিএ কার্যালয় থেকে লাইসেন্স প্রদানের জন্য আঙুলের ছাপ নেওয়ার সময় আটক করে পুলিশ। এসময় দুই দালালকে সাজা প্রদান করে ভ্রাম্যমাণ আদালত। আটক ১১ জনকে এক হাজার টাকা করে জরিমানা করা হয়।

জানা যায়, বিআরটিএ ঝালকাঠির সহকারী পরিচালক মো. আইয়ুব আনছারী ২০০৭ সালে চট্টগ্রামে চাকরি করতেন। ওই সময় তাঁর কার্যালয়ে মোটরযান রেজিস্ট্রেশন ও ড্রাইভিং লাইসেন্স করার জন্য দালাল নিয়োগ করেন সাতকানিয়া উপজেলার বারকোনা গ্রামের আবদুল হককে। আবদুল হকের মাধ্যমে তিনি ঘুষ নিয়ে লাইসেন্স প্রদান করতেন। ঘুষের টাকা দিয়ে তিনি অবৈধ সম্পদ গড়ে তোলেন। এসব ঘটনায় ২০০৭ সালে দুর্নীতি দমন কমিশন তাঁর বিরুদ্ধে একটি মামলা করে। ওই মামলায় তাকে সাময়িক বরখাস্ত করে বিআরটিএ কর্তৃপক্ষ। পরবর্তীতে তিনি চাকরি ফিরে পেলে ভোলায় বদলী করা হয়। সেখানেও দালাল আবদুল হকের মাধ্যমে ঘুষ নেন তিনি। চার মাস পূর্বে তাকে ঝালকাঠিতে বদলী করা হয়। ঝালকাঠিতে যোগদানের পর এখানেও গড়ে তোলেন দালাল সিন্ডিকেট। সরকার নির্ধারিত ফি তিন হাজার ৬০ টাকা থাকলেও দালালের মাধ্যমে লাইসেন্স প্রতি ছয়-আট হাজার টাকা নেন তিনি। ঘুষ দিয়ে লাইসেন্স করলে, তাকে মোটরযান চালানোর পরীক্ষায় অংশ নিতে হয় না। শুধু টাকা দিয়ে আঙুলের ছাপ দিলেই পাওয়া যায় লাইসেন্স। ঘুষের টাকা না দিলে কাউকে লাইসেন্স দেওয়া হয় না। তিনি ঝালকাঠিতে আসার পর বরিশালের কাউনিয়া এলাকার হৃদয় মৃধা নামে একজনকে দালাল হিসেবে নিয়োগ করেন। সে ফরম পূরণ করে দেয়, এজন্য তাকে ৫০ টাকা এবং প্রতিদিন ৫০০ টাকা খরচ দেন কর্মকর্তা। এমনকি বরিশাল থেকে ওই কর্মকর্তার গাড়িতে করে ঝালকাঠি আসা যাওয়া করেন দালাল হৃদয়। ঝালকাঠি বিআরটিএ সহকারী পরিচালক আইয়ুব আনছারীর গ্রামের বাড়ি ঝালকাঠির নলছিটি উপজেলার ডেবরা গ্রামে। তিনি বর্তমানে বরিশাল বসবাস করছেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মোটরযান চালকরা জানান, ঝালকাঠি বিআরটিএ কার্যালয়ের দালাল হৃদয় মৃধার মাধ্যমে ঘুষ নেন সহকারী পরিচালক। জনপ্রতি ছয়-আট হাজার টাকা দিলে কোন পরীক্ষা ছাড়াই লাইসেন্স দেওয়া হয়। সরকার নির্ধারিত ফি জমা দিয়ে আবেদন করলে, তা গ্রহণ করেন না কর্মকর্তা। তিনি নানা অযুহাত দেখিয়ে ফেরত পাঠিয়ে দেন। নিয়মানুযায়ী যদি কারো আবেদন রাখেন, তাদের আবার মোটরযান চালানোর পরীক্ষায় অকৃতকার্য দেখান। পরে বাধ্য হয়ে তাঁর কার্যালয়ের দালালের কাছে যেতে হয় লাইসেন্স করতে আসা মানুষদের।

শহরের ভাড়ায় মোটরসাইকেল চালক মো. ইব্রাহিম বলেন, আমি বিআরটিএ কার্যালয়ে গিয়ে লাইসেন্স করার নিয়ম জানতে যাই। আমাকে নিয়ম অনুযায়ী আবেদন করলে, সারাজীবনেও লাইসেন্স পাওয়া যাবে না বলে জানান দালাল হৃদয়। সে আমার কাছ থেকে সাত হাজার ৬০ টাকা দাবি করেন। তিন হাজার টাকা স্যারকে (সহকারী পরিচালক) দিতে হবে বলে সে টাকা দাবি করে। টাকা দেওয়ার অল্প কিছু দিনের মধ্যেই আমার আঙুলের ছাপ নিয়ে লাইসেন্স প্রদান করেন।

এদিকে চট্টগ্রামে চাকরি করার সময় ঝালকাঠি বিআরটিএ কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক আইয়ুব আনছারীর গড়ে তোলা দালাল সিন্ডিকেটের মধ্যে অন্যতম আবদুল হক এখনো সক্রিয়। আবদুল হকের মাধ্যমে সে চট্টগ্রামের লোকজনেরও মোটরযান রেজিস্ট্রেশন ও ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রদান করেন। এজন্য তিনি জনপ্রতি আট হাজার করে টাকা নেন। বুধবার আবদুল হক চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলার ১১জন যুবককে লাইসেন্স করানোর জন্য ঝালকাঠি নিয়ে আসেন। ওই যুবকরা চট্টগ্রামের শাহ জব্বার এজেন্সির মাধ্যমে সৌদি আরবে যেতে আগ্রহী। এজেন্সি কর্তৃপক্ষ ওই যুবকদের ড্রাইভিং লাইসেন্স করার তাগিদ দেন। এ লাইসেন্স করা থাকলে তাদের সৌদি নেওয়া যাবে বলেও জানান। ওই যুবকরা চট্টগ্রাম বিআরটিএ কার্যালয়ে গেলে, তাদের অনভিজ্ঞতার কারণে লাইসেন্স দেয়নি কর্তৃপক্ষ। পরে দালাল আবদুল হকের মাধ্যমে তারা ঝালকাঠি বিআরটিএ কার্যালয়ে লাইসেন্স করাতে আসেন। জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের তিন তলায় ওই ১১জনকে সন্দেজনকভাবে ঘোরাফেরা করতে দেখে এনডিসি মো. বশির গাজী তাদের ডেকে কার্যালয়ে নিয়ে যান। সেখানে জিজ্ঞাসাবাদে তারা আবদুল হকের মাধ্যমে লাইসেন্স করার জন্য এখানে এসেছেন বলে স্বীকার করেন। লাইসেন্সের জন্য তারা জনপ্রতি আট হাজার টাকা করে দিয়েছেন।

ঝালকাঠির নেজারত ডেপুটি কালেক্টর (এনডিসি) মো. বশির গাজী বলেন, আমি সকাল সাড়ে আটটায় অফিসে প্রবেশের সময় কয়েকজন অপরিচিত ব্যক্তিকে ঘোরাঘুরি করতে দেখি। তাদের ডেকে ঠিকানা জানতে চাইলে তারা চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলে। কিকারণে এখানে এসেছেন জানতে চাইলে বলে বিআরটিএ অফিসে লাইসেন্স করার জন্য। তখন সন্দেহ হলে তাদের আমার কক্ষে নিয়ে যাই। তাদের কাছ থেকে বিস্তুারিত জেনে সিন্ডিকেটের সবাইকে ধরে ফেলি। এর মধ্যে দালাল আবদুল হককে ছয় মাসের কারাদÐ ও ২০ হাজার টাকা জরিমানা, পরিশোধ না করলে আরো এক মাসের কারাদÐ দেওয়া হয়। অপর এক দালাল হৃদয়কে সাত দিনের কারাদÐ এবং লাইসেন্স করাতে আসা ১১জনকে এক হাজার টাকা করে জরিমানা করা হয়। সহকারী পরিচালকের বিরুদ্ধে বিআরটিএ চেয়ারম্যানের কাছে জানানো হবে বলেও জানান তিনি।
এব্যাপারে ঝালকাঠি বিআরটিএ সহকারী পরিচালক আইয়ুব আনছারী বলেন, আমি এসব কিছুই জানি না। চট্টগ্রাম থেকে কারা এসেছে, আমি তাদের চিনি না। আমি কোন দালাল প্রশ্রয় দেই না। কারো কাছ থেকে টাকাও নেই না। দালাল কেউ থেকে থাকলে আমি তাদের চিহ্নত করে ব্যবস্থা নেবো।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: বিআরটিএ


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ