তৌহিদবাদীরাই ভারতের আদিবাসী
হিন্দ অঞ্চলে যত লোক বসবাস করে তারাই হিন্দী বা হিন্দু। ফারসী ও তুর্কীতে হিন্দুস্তান। আরবীতে
উপমহাদেশের আযাদী আন্দোলনে এ দেশের আলেম সমাজের ভ‚মিকা শুধু যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রশংসনীয় তাই নয়ং, বরং অবিস্মরণীয় এবং অভিনন্দনযোগ্যও। সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজদের গোলামির শৃঙ্খল থেকে স্বদেশকে মুক্ত করার জন্য আলেম সমাজের অসাধারণ ত্যাগ ও কোরবানি, কঠোর সংগ্রাম ও সাধনা, এক কথায় তাদের মহৎ দান এ উপমহাদেশের ইতিহাসের এক চিরস্মরণীয় অধ্যায়। আযাদী সংগ্রামের বিভিন্ন পর্যায়ে আমরা দেখি আলেম সমাজকে লক্ষ কোটি সংগ্রামী মানুষের নেতৃত্ব করতে, দেখি তাদেরকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলতে, বুলেট-সঙ্গীনের মুখে দাঁড়াতে, কারাগারের অভ্যন্তরে ও দ্বীপান্তরে বন্দীরূপে।
এ কথা সর্বজনবিদিত যে, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সর্বপ্রথম ব্যবসায়ের উপলক্ষেই এ দেশে আগমন করে। কিন্তু তখনও অনেক আলেম তাদের দূরবীক্ষণ দৃষ্টিতে নিরীক্ষণ করেছিলেন দেশের আসন্ন বিপদের কথা। যিনি সর্বপ্রথম দেশের ভবিষ্যৎ দুর্গতি সম্পর্কে আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন তিনি মহা মনীষী হযরত শাহ ওলিউল্লাহ দেহলভী (র.)। ১৮০৩ খ্রিস্টাব্দে কোম্পানির হীন এবং জঘন্য মনোবৃত্তির বহিঃপ্রকাশ ঘটল তাদের এই ঘোষণার মাধ্যমে ‘বান্দা খোদার মুলুক বাদমার, হুকুম কোম্পানি বাহাদুরের’ তখন তাদের কুমতলব সম্পর্কে কারো মনে এতটুকুও সন্দেহের অবকাশ ছিল না। তখন সর্বপ্রথম যিনি কোম্পানির এই ঘোষণায় প্রতিবাদ করলেন এবং পাক ভারত উপমহাদেশকে ‘দারুল হরব’ বলে ঘোষণা করলেন এবং পরিস্থিতির মোকাবেলা করার জন্য ততা আযাদী আন্দোলনের জন্য দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানালেন, তিনি মহামনীষী হযরত ওলিউল্লাহর সুযোগ্য পুত্র সে যুগের দেশবরেণ্য আলেম হযরত মাওলানা শাহ আব্দুল আজিজ রহ.।
তাঁর উদাত্ত আহ্বানে যাঁরা সাড়া দিয়ে আযাদী আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন এবং গোলামীর ঘৃণ্য শৃঙ্খল ছিন্ন করে দেশকে আযাদ করার মহান ব্রত গ্রহণ করেছিলেন, তন্মধ্যে হযরত আল্লামা সৈয়দ আহমদ বেরেলভী রহ., হযরত শাহ ইসমাঈল রহ. এবং হযরত মাওলানা আব্দুল হাই প্রমুখের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। কেননা এরা নিঃসন্দেহে এদেশ আযাদী সংগ্রামের অগ্রনায়ক। হযরত সৈয়দ আহমদ বেলেরভী রহ. এই উদ্দেশ্যে সমগ্র উপমহাদেশ ভ্রমণ করেন এবং জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে দেশের অগণিত মানুষ তার নেতৃত্বে আস্থা স্থাপন করেন, তার নিকট আযাদী সংগ্রামের দীক্ষা গ্রহণ করেন। তারা উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের পাহাড়ি এলাকাকে সংগ্রামের প্রাণকেন্দ্র রূপে নির্বাচিত করেন। সৈয়দ আহমদ রহ. ১৭৮৭ সালে বেরিলীতে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৮১৬ সালে উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য দিল্লী গমন করেন। তিনি দেশের তদানীন্তন সর্বশ্রেষ্ঠ আলেম মাওলানা শাহ আব্দুল আজিজের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। মাত্র তিন বৎসরে কুরআন, হাদিস, ফেকাহ এবং অন্যান্য বিষয়ে অসাধারণ ব্যুৎপত্তি লাভ করেন। তিনি ছিলেন একাধারে সমাজসংস্কারক, পন্ডিত, বাগ্মী, সংগঠক, অসিবিদ্যা ও অশ্ব পরিচালনায় পারদর্শী। তিনি কয়েক বছরের কঠোর পরিশ্রমে সমগ্র উপমহাদেশের জনসাধারণকে জিহাদী প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ করেন। তার জনপ্রিয়তা শুধু একটি কথা দ্বারা সহজে অনুমেয় যে, তিনি যখন পবিত্র কাবা শরীফ জিয়ারতে হজব্রত পালনের জন্য রওনা হলেন, তখন ১১ খানি জাহাজ শুদু অনুচরদের জন্য ভাড়া করতে হয়েছিল। হজের পর বিভিন্ন মুসলিম দেশে তিনি ব্যাপক সফর করেন। প্রায় তিন বছর পর যখন তিনি স্বদেশেকে মুক্ত করার নব প্রেরণা নিয়ে প্রত্যাবর্তন করলেন তখন তনি ঘোষণা করলেন, মুক্ত ভারতে মুক্ত ইসলাম মূলত এর পরই সম্পূর্ণ নতুন পন্থায় শুরু হয় তার সংগ্রাম। তিনি একটা মুজাহিদ বাহিনী গঠন করে তাদের নৈতিক, আধ্যাত্মিক এবং সামরিক শিক্ষার ব্যবস্থা করেন।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আযাদী আন্দোলনকে রুখে দাঁড়াবার উদ্দেশ্যে ভারতবাসীর মধ্যে কলহ-দ্ব›দ্ব সৃষ্টি করার হীন ষড়যন্ত্রে মেতে ওঠে, তাই তারা পাঞ্জাবের মহারাজ রঞ্জিৎ সিংকে দলভুক্ত করে। রঞ্জিৎ সিং তখন মুসলমানদের ওপর অমানসিক অত্যাচার আরম্ভ করেন। মূলত বিদেশী বানিয়ার দল রঞ্জিৎ সিং-এর কাঁধে বন্দুক রেখে মুজাহিদ বাহিনীর বুকে গুলি চালায়। এমনি সঙ্কটময় মুহূর্তে উৎপীড়িত নির্যাতিত মুসলমানদের আর্তনাদে বাধ্য হয়ে অগত্যা মাও. সৈয়দ আহমদকে শিখদের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করতে হয, আর তখনই বালাকোটের যুদ্ধ সংঘটিত হয়্ অথচ এ কথা সর্বজনস্বীকৃত যে, মাওলানা সৈয়দ আহমাদের আযাদী আন্দোলন শুধু মুসলমানরাই নয়, অমুসলমানরাও অংশগ্রহণ করেছিলেন। দেশের আযাদী অর্জনই ছিল তার একমাত্র লক্ষ্য। তাই জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সমগ্র দেশবাসীই তাতে ঝাঁপিয়ে পড়িয়েছিলেন। মাওলানা সৈয়দ আহমদের তোপখানার অধ্যক্ষ ছিলেন রাজরাম রাজপুত, আর এটিই তার উদারতা ও মহানুভবতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
এ সম্পর্কে মাওলানা সৈয়দ আহমদ গোয়ালিয়রের মহারাজা দৌলতরাওকে যে চিঠি লিখেছিলেন তাও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য এবং গুরুত্বপূর্ণ। আযাদী আন্দোলনের আর একজন বিখ্যাত মুজাহিদ মাওলানা হোসাইন আহমদ মাদানী কর্তৃক লিখিত ‘নকশে হায়াত’ বা আত্মজীবনীতে এই চিঠির বিস্তারিত বিবরণ স্থান পেয়েছে। হিন্দু রাজা দৌলতরাওকে লিখিত চিঠি- ‘বিদেশী বণিকরা যে আজ রাষ্ট্রের মালিক হয়ে বসেছেন, এ সম্পর্কে আপনি অবশ্যই অবগত রয়েছেন। দেশের আমীর ওমারাহ তথা সম্মানিত ব্যক্তিদের মান-মর্যাদা আজ ধুলায় লুণ্ঠিত। রাজ্যের কর্ণধার, যারা, তারা এখন নীরব দর্শকের ভ‚মিকা পালন করছেন। এমনি অবস্থায় নিতান্ত কর্তব্যের তাগিদে বাধ্য হয়ে কতিপয় দরিদ্র নিঃসম্বল লোক আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের ওপর নির্ভরশীল হয়ে, তার দ্বীনের খিদমতের জন্য বেরিয়ে এসেছেন। এরা দুনিয়ার লোভী নন। শুধু আল্লাহর দ্বীনের সেবায় তাদের এই সংগ্রাম সাধনা। অর্থসম্পদের লোভ-লালসাও তাদের নেই। তাদের সঙ্কল্প যেদিন আমরা জয়লাভ করব, সেদিন দেশ পরিচালনার দায়িত্ব উপযুক্ত লোকের প্রতি অর্পিত হবে।’
হযরত মাওলানা সৈয়দ আহমদ রহ.-এর উদার মনোভাব থাকা সত্তে¡ও ১৮৩১ সালে বালাকোটের ঐতিহাসিক ময়দানে যুদ্ধ হল্ োআর তাতে মাওলানা সৈয়দ আহমদ রহ. মাওলানা শাহ ইসমাইল শহীদ ও মাওলানা আব্দুল হাই প্রমুখ নেতৃস্থানীয় ওলামায়ে কেরাম দেশ ও জাতির আযাদীর জন্য জিহাদ করে শাহাদত বরণ করেন। যদিও সেদিন তারা বালাকোটের রণাঙ্গনে পরাজিত হয়েছেন, কিন্তু তাদের শহীদী খুন ব্যর্থ হয়নি। বরং আযাদী আন্দোলনের যে বহ্নিশিখা মওলানা সৈয়দ আহমদ রহ. প্রজ্বলিত করেছিলেন, তারই অবশ্যম্ভাবী পরিণতি স্বরূপ ১৮৫৭ সালে ঐতিহাসিক সিপাহী বিদ্রোহ সংঘটিত হয়। সিপাহী বিপ্লবের প্রেরণা ও প্রস্তুতি যে সমস্ত লৌহমানবের দ্বারা হয়েছিল, তাদের অধিকাংশই সর্বশ্রেষ্ঠ বিপ্লবী বীর মুজাহিদ মাওলানা সৈয়দ আহমদ বেরেলভী রহ.-এর খলিফাদের হাতে গড়া ছিলেন। অবিভক্ত বাংলার ইংরেজ প্রশাসক ডবিøউ ডবিøউ হান্টার তার দি ইন্ডিয়ানুস মুসলিমস নামক গ্রন্থে মাওলানা সৈয়দ আহমদ রহ.-এর জিহাদী জীবনের যে বিস্তৃত বিবরণ দিয়েছেন তাতে আযাদী আন্দোলনে আলেম সমাজের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার প্রকৃষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়। মাওলানা সৈযদ আহমদ রহ.-এর মুজাহিদ বাহিনীর সংগঠনের বিস্তারিত বিবরণ জামাতে মুজাহেদীন সার গুজাস্তে মুজাহেদীন এবং সৈয়দ আহমদ রহ. নামক তিনটি গ্রন্থের কযেক সহস্র পৃষ্ঠায় উর্দু ভাষায় সংরক্ষিত রয়েছে। এতে শুধু যে হযরত মাওলানা সৈয়দ আহমদ রহ.-এর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, বীরত্ব ও সাহসিকতা এবং জিহাদী প্রেরণার পরিচয় পাওয়া যায় তাই নয়, বরং পাক-ভারত উপমহাদেশের আন্দোলনে গোটা আলেম সমাজের গুরত্বপূর্ণ ভূমিকাও সুস্পষ্ট প্রতিভাত হয়।
বস্তুত এ দেশের আলেম সমাজ আযাদী আন্দোলনে যেভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন এবং প্রায় দুশ’ বছর ধরে যেভাবে এই সংগ্রামকে অব্যাহত রেখেছেন, তা সত্যিই অতুলনীয় ও বিস্ময়কর। আন্দামানের বন্দী মাওলানা ফজলে হক খায়রাবাদী রহ. মাওলানা এনায়েতুল্লাহ রহ. হাজী এমদাদুল্লাহ মুহাজেরে মক্কী এই উপমহাদেশের সর্বশ্রেষ্ঠ ইসলামী শ্ক্ষিাপ্রতিষ্ঠান দেওবন্দ মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা কাসেম নানুতবী রহ. এবং মাওলানা রশিদ আহমদ গাংগুহী রহ. প্রমুখ ওলামায়ে কেরাম, যারা এ দেশে আযাদী আন্দোলন করেছেন এবং এ জন্য অবিরাম সংগ্রাম সাধনা ও কঠোর পরিশ্রম করেছেন, তাদের নাম এ দেশের ইতিহাসে চিরদিন অমর ও অক্ষয় হয়ে থাকবে। এঁরা সকলেই শাহ ওলিউল্লাহ দেহলবী রহ. ও হযরত মাওলানা আব্দুল আজিজ রহ.-এর আধ্যাত্মিক শিষ্য এবং হযরত মাওলানা সৈয়দ আহমদ রহ.-এর আযাদী আন্দোলনের অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত।
এমনিভাবে দেশকে পরাধীনতার নাগপাশ থেকে উদ্ধার করার জন্য যারা আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন এবং ১৮৫৭-৫৮ সালের জাতীয় অভ্যুত্থান যাদের কঠোর পরিশ্রমের ফল, তাদের মধ্যে মাওলানা শাহ আহমদুল্লাহর নামও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি সারা দেশে ইংরেজবিরোধী বক্তৃতা করে দেশবাসীকে আযাদী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করতে এবং যাবতীয় ত্যাগ স্বীকার করতে উদ্বুদ্ধ করেন। সরকার তাকে অযোধ্যার কারাগারে নির্জন প্রকোষ্ঠে বন্দী করে এবং আদালত তার কঠোর শাস্তির নির্দেশ দেয়। কিন্তু তার ভক্ত ও অনুরক্তের দল আযাদী পাগল বিক্ষুব্ধ জনতা বলপ্রয়োগ করে তাকে অযোধ্যার কারাগার থেকে মুক্ত করে। মাওলানা আহমুদল্লাহ সংগ্রামের পুরোভাগে থাকতেন, তাঁর সম্মুখে দাঁড়াবার সাহস করা হতো না। তিনি ১৯৫৮ সালের ৫ জুন অযোধ্যা রোহিলাখন্ডের সীমান্ত এলাকায় পৌঁছলে তাকে ধোঁকা দিয়ে রাজা জগন্নাথ নামক এক ব্যক্তি তার প্রাসাদে নিয়ে গিয়ে তাকে গুলি করে হত্যা করে। কথিত আছে, শাহজাহানপুরের ম্যাজিস্ট্রেট এই হীন কার্যের জন্য সেই জগন্নাথকে ৬৫০০০ টাকা পুরস্কার দেন। এমনিভাবে আযাদী আন্দোলনের বীর মুজাহিদ মওলানা শাহ আহমদুল্লাহর জীবন প্রদীপ চার দিনের জন্য নির্বাপিত হয়। বালাকোটের পরাজয়ের পর মাওলানা সৈয়দ আহমদ রহ.-এর মুজাহিদ বাহিনী তাদের কেন্দ্র স্থাপন করেছিলেন সিন্ধুনদের পশ্চিম তীরে, মহাবন পর্বতের পদদেশে অবস্থিত সিতানা নামক স্থানে। বস্তুত পাক-ভারত উপমহাদেশের আযাদী আন্দোলনের ইতিহাসে সিতানার কথা স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ রয়েছে, কেননা এই অজ গ্রামটিকে কেন্দ্র করেই মুজাহিদ বাহিনী পরাক্রমশালী ব্রিটিশের বিরুদ্ধে বহুদিন ধরে যুদ্ধ করেছিলেন। এ প্রসঙ্গে মাওলানা এহিয়া আলী খানের কথা উল্লেখ করতে হয়। এককালে তিনিই ছিলেন মুজাহিদ বাহিনীর প্রধান পরিচালক। তার কার্যালয় ছিল পাটনায়। তিনি সমগ্র দেশ থেকে মুজাহিদ বাহিনী সংগ্রহ করতেন ও পাটনায় তাদের শিক্ষা দিতেন এবং পরে সিতানায় প্রেরণ করতেন। সুদক্ষ, সুচতুর, বিচক্ষণ সিংহপুরুষ মাওলানা এহিয়া আলী খান এসব কিছু করতেন অতি সঙ্গোপনে। অতি অল্প সময়ের মধ্যে তিনি ইংরেজবিদ্বেষ ও আযাদীর রক্ত প্রবাহিত করতেন নতুন মুজাহিদের শিরায় শিরায়, রন্ধ্রে রন্ধ্রে। মাওলানা এহিয়া আলী খান এভাবে সারা দেশে বিপ্লববাদ প্রচার করেন এবং মুজাহিদ বাহিনীর সংগঠনে আত্মনিয়োগ করেন। কিন্তু অদৃষ্টের লিখনকে কেউ খন্ডন করতে পারে না।
আর পারে না বলেই ১৮৬৩ সালের মে মাসে পাঞ্জাবী ‘মীর জাফর’ গাজন খাঁর ষড়যন্ত্রে কয়েকজন সরলপ্রাণ মুজাহিদ বন্দী হন এবং পাঞ্জাব, যুক্ত প্রদেশ, আম্বালী, মুলতান প্রভৃতি এলাকায় ব্যাপক ধরপাকড় হয়। এ সময় যারা বন্দী হন এবং পরে ফাঁসির দন্ডাদেশ প্রাপ্ত হন, তাঁদেরই একজন হলেন মাওলানা এহিয়া আলী খান।
১৮৫৭ সালের ব্যর্থ অভিযানের পর ইংেিরজরা মুসলমানদের ওপর যে অমানুষিক উৎপীড়ন, নির্যাতন চালায় তা বর্ণনাতীত, কিন্তু শাহ ওলি উল্লাহ ও শাহ আব্দুল আজিজের প্রজ্বলিত অগ্নি নিষ্প্রত হবার নয়। বিশেষত হযরত সৈয়দ আহমদ রহ.-এর স্বাধীনতা সংগ্রামের পুঁতমন্ত্রে যারা দীক্ষিত, তাদেরও দমবার কথা নয, তাই আমার দেখি, ১৮৫৭ সালের আযাদী সময়ের বীর মুজাহিদ মাওলানা মোহাম্মাদ কাসেম রহ. পুনরায় সংগ্রামের আয়োজনের উদ্দেশ্যে সুবিখ্যাত দেওবন্দ মাদ্রাসা স্থাপন করেছিলেন। দেওবন্দ মাদ্রাসা বিগত একশ’ বছর আযাদী আন্দোলনের একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্ররূপে সুপ্রতিষ্ঠিত এবং সুপ্রমাণিত হয়। শাইখুল হিন্দ মাওলানা মাহমুদুল হাসান রহ. মাওলানা কাসেমের ছাত্র ছিলেন। মুজাহিদের ছাত্র মুজাহিদ। অনন্য সাধারণ প্রতিভাবান অগাধ পান্ডিত্যের অধিকারী মাওলানা খ্যাতির দীপ্তি ছড়িয়ে পড়ে দেশ-বিদেশে। ফলে শুধু পাক-ভারত উপমহাদেশেই নয় বরং মক্কা শরীফ, বলখ, কাবুল, কান্দাহার, বুখারা, সমরকন্দ, তুর্কিস্তান ও আফগানিস্তান থেকে অগণিত জ্ঞানপিপাসু সমবেত হয় তার নিকট এবং তার স্বদেশপ্রেম ও আযাদী সংগ্রামের দীক্ষা গ্রহণ করে সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। মাওলানা মাহমুদুল হাসান ছিলেন দেওবন্দ মাদ্রাসার প্রধান অধ্যাপক। তাঁর দুর্লভ মনীষার আকর্ষণেই সমবেত হতেন অগণিত মানুষ এবং আযাদী আন্দোলনের দুর্নিবার আগ্রহে তাদের মন হাতে উদ্বেলিত। শাইখুল হিন্দ, দেওবন্দ মাদ্রাসায় অধ্যাপনার সঙ্গে সঙ্গে দেশকে আযাদ করার জন্য জিাহদের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, এজন্য তিনি নিজেই নির্বাচন করেন তাঁর সহকর্মীদের সংগ্রামপথের সহযাত্রীদের এবং হযরত মাওলানা সৈয়দ আহমদ রহ.-এর মুজাহিদ বাহিনীর সীমান্ত কেন্দ্রের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেন। এই উদ্দেশ্যে শাইখুল হিন্দ মাওলানা মাহমুদুল হাসান গুণমুগ্ধ শিষ্য মাওলানা সাইফুর রহমান, মাওলানা ফজল মাহমুদ, মাওলানা মোহাম্মদ আকবর প্রমুখ ওলামায়ে কেরামকে সীমান্ত দেশে প্রেরণ করেন।
তাঁরা ইয়াগীস্থানকে কেন্দ্র করে শাইখুল হিন্দ মাওলানা মাহমুদুল হাসান-এর নির্দেশক্রমে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের উৎখাতের উদ্দেশ্যে তাদের ওপর আক্রমণ পরিচালনা করেন। গোলা-বারুদ-অর্থ-রসদ সরবরাহ করেন তিনি। সমগ্র দেশ থেকে এই উদ্দেশ্যে অর্থ সংগ্রহ করেন। সুদূর দেওবন্দ থেকে আফগান সীমান্ত পর্যন্ত যোগাযোগ রক্ষা করা, সংগ্রাম পরিচালনা করা এবং প্রয়োজনীয় সাহায্য নির্দিষ্ট সময়ে প্রেরণ করা, বিশেষ করে ব্রিটিশ গোয়েন্দাদের চোখে ধুলা দিয়ে সকল ব্যবস্থা করা সত্যিই এক অত্যন্ত কঠিন এবং জটিল সমস্যা ছিল। মাওলানা মাহমুদুল হাসান ছিলেন অত্যন্ত বিচক্ষণ ও অসাধারণ প্রতিভাবান ও পরম সাহসী লোক। তিনি অটল-অবিচল হয়ে এই সংগ্রামে অবতীর্ণ হলেন, তাঁর গুণমুগ্ধ শিষ্য মওলানা ওবায়দুল্লাহ সিন্ধি, মাওলানা উজাইরগুল, মাওলানা আব্দুর রহিম রায়পুরী, মাওলানা মোহাম্মদ সাদেক, নও মুসলিম মওলানা শেখ আব্দুর রহিম ছিলেন এই জটিল পথে শাইখুল হিন্দের সহযাত্রী।
সীমান্তের এই আক্রমণ প্রতিরোধ করার জন্য ব্রিটিশ সরকার সৈন্য প্রেরণ করল, কিন্তু গেরিলা যুদ্ধে চির অভ্যন্ত মুজাহিদ বাহিনীকে পরাজিত করা সহজ ব্যাপার ছিল না, পর্বতের গহিন অরণ্য তাঁদেরকে আত্মগোপন করতে সাহায্য করত, তাই অনায়াসে ব্রিটিশ সৈন্য তাদের হাতে বিপন্ন হতো। শাইখুল হিন্দু ইংরেজের বিরুদ্ধে জিহাদ পরিচালনায় সাহায্যের জন্য ইস্তাম্বুল এবং আরব দেশ সফর করেন এবং হেজাজের তদানীন্তর অধিপতি গালেব পাশার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। অতঃপর তিনি মদিনা মোনাওয়ারা গমন করেন এবং তাঁরই সুযোগ্য শিষ্য মাওলানা হোসাইন আহমদ মাদানীকে সাথী হিসেবে গ্রহণ করেন, যিনি সুদীর্ঘ সতেরো বছর ধরে প্রিয় নবী সা.-এর মসজিদে হাদিস শাস্ত্রের অধ্যাপনায় রত ছিলেন। অতঃপর তিনি মস্কো ও ইস্তাম্বুলে মিশন প্রেরণ করেন। এ সময় ব্রিটিশ সরকারের নিকট রহস্য ফাঁস হয়ে যায়। ফলে মাওলানা ওবায়দুল্লাহ বন্দী হন এবং সঙ্গে সঙ্গে ১৯১৭ সালে ব্রিটিশ সরকারের অনুরোধক্রমে সৌদি আরবের তদানীন্তর অধিপতি শরীফ হোসেন জেদ্দায় শাইখুল হিন্দ মাওলানা মাহমুদুল হাসানকে বন্দী করে। তাঁর সঙ্গে বন্দী হন হাকিম নুসরত হোসাইন, হযরত মাওলানা হোসাইন আহমদ মাদানী, মাওলানা ওজাইরগোল পেশোয়ার এবং মাওলানা ওহীদ আহমদ রহ. প্রমুখ। ১৯১৭ সালের ডিসেম্বর মাসে তাঁরা বন্দী হন। এক মাস জেদ্দায় রাখার পর তাঁদেরকে কায়রো পাঠানো হয়। কায়রোর জিয়া কারাগারে তাদের জবানবন্দী গ্রহণ করা হয়। অতঃপর ইটালির নিকটবর্তী মাল্টা দীপে তাঁদেরকে প্রেরণ করা হয়। এমনিভাবে তাঁরা এ দেশের আযাদী আন্দোলনের জন্য সংগ্রাম করেন। এ জন্য আযাদী আন্দোলনে আলেম সমাজের অবদান ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ থাকবে। এ দেশকে আযাদ করার জন্য মাওলানা মোহাম্মাদ আলী, মাওলানা শওকত আলী, মাওলানা হাসরত মোহানী ও মাওলানা আজাদ সুবহানী প্রমুখ ওলামায়ে কেরামের দানও অপরিসীম। বস্তুত আজাদী আন্দোলনের ইতিহাসে মাওলানা মোহাম্মদ আলীর নাম স্মরণীয় হয়ে থাকবে। কেননা তিনি ছিলেন নির্ভীক মুজাহিদ বিপ্লবী বীর। তার মতো দুর্লভ মনীষী সাধারণত কোনো দেশে অনেক দিন পরই পরিদৃষ্ট হয়। তিনি তাঁর কলকাতা থেকে প্রকাশিত ‘দি কমরেড’ পত্রিকা মারফতে এবং পরে দিল্লী থেকে প্রকাশিত উর্দু দৈনিক ‘হামদর্দ’-এর মাধ্যমে সারা দেশে আযাদীর অগ্নিমন্ত্র প্রচার করেছিলেন। তার অসাধারণ প্রতিভা সর্বজনবিদিত স্বীকৃত এবং উচ্চ প্রশংসিত ছিল। খেলাফত আন্দোলনের মাধ্যমে তিনি সারা দেশে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন। ১৯৩০ সালে বিলাতে অনুষ্ঠিত গোলটেবিল বৈঠকে তার ঐতিহাসিক উদ্দীপনাময় ভাষণে যখন ঘোষণা করেছিলেন, ‘আমি স্বাধীনতার জন্য বিলাত এসেছি, পরাধীন দেশে প্রত্যাবর্তনের ইচ্ছা আমার নেই, অপরের হলেও কোনো স্বাধীন দেশে মৃত্যুবরণ করাকে আমি শ্রেয় মনে করি।’ তখনই সমগ্র বিশ্ব উপলব্ধি করেছিল যে আযাদীর রক্ত প্রবাহিত হচ্ছে তার শিরায় শিরায়। দেশের আযাদী তার নিকট স্বীয় জীবন থেকেও অধিকতর মূল্যবান। এমনিভাবে সর্বপ্রথম যিনি এ দেশের পূর্ণাঙ্গ আযাদীর দাবি উত্থাপন করেন, যিনি ইংরেজ বিতাড়নের তথা ব্রিটিশ সাাম্রাজ্যবাদকে কবর দেয়ার জন্য ছিলেন বদ্ধপরিকর, বিদেশী বেনিয়া শাসক গোষ্ঠীকে দেশের পবিত্র মাটি থেকে বহিষ্কার করে পূর্ণাঙ্গ আযাদী অর্জন ছিল যার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য, তিনি মাওলানা হাসরত মোহানী। তিনি আযাদীর জন্য বহুদিন কারাদন্ড ভোগ করেছিলেন, সর্বপ্রকার উৎপীড়ন-নির্যাতন সহ্য করেছিলেন।
তদানীন্তন বাংলাদেশ যেসব ওলামায়ে কেরাম আযাদী আন্দোলনের অগ্রনায়ক ছিলেন তাদের মধ্যে মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ, মওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী, হাজী শরীয়তুল্লাহ, পীর দুদু মিয়া প্রমুখ ওলামায়ে কেরামের নাম অবিস্মরণীয়। মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবদী সারা দেশে জ্বালাময়ী বক্তৃতার মাধ্যমে লোকের মনে আযাদীর প্রেরণা জাগিয়েছিলেন এবং তার সম্পাদনায় প্রকাশিত, ‘সুলতান’ ‘আল-ইসলাম’ পত্রিকা এবং ‘কুরআনে স্বাধীনতার বাণী’ গ্রন্থখানি বাঙালি মুসলমানদের মনে নব-প্রাণ সঞ্চার করে খেলাফত ও অসহযোগ আন্দোলনে তিনি ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। এ জন্য কারাবরণও করেছিলেন। এতদ্ব্যতীত ‘জমিদার’ পত্রিকার সম্পাদক মাওলানা জাফর আলী খানের দানও আযাদী আন্দোলনে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
যদিও মওলানা আবুল কালাম আযাদের রাজনৈতিক মতবাদের সাথে আমরা একমত নই, কিন্তু এ দেশ থেকে ইংেিরজ বিতাড়নে তথা আযাদী আন্দোলনে তার অবদান অনস্বীকার্য। আযাদী অর্জনের জন্য তিনি সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশের হাতে বর্ণনাতীত নির্যাতন সহ্য করেছেন। কিন্তু নির্ভীকচিত্তে, বীর বিক্রমে আযাদীর লড়াই করে তাতে জয়ী হয়েছেন। এখানে যে কথাটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, তা হলো এই যে, প্রায় দুশ’ বছর ধরে আলেম সমাজ যে আযাদী আন্দোলন করেছেন এবং দেশের স্বাধীনতার জন্য যে অবিরাম সংগ্রাম করেছেন, তার একটি বৈশিষ্ট্য ছিল যে, তাঁরা ইসলামের জন্য দেশের আযাদী অপরিহার্য বলে মনে করতেন। কেননা ইসলামী জীবন বিধানের পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন দেশেল আযাদী ব্যতীত আদৌ সম্ভব নয়। তাই ওলামায়ে কেরামের আযাদী আন্দোলনের এই ধারা অবশেষে পাকিস্তান আন্দোলনে শুধু যে সহায়ক হয়, তাই নয়, বরং পাকিস্তান আন্দোলনে তা সম্পূর্ণভাবে রূপান্তরিত হয়। তাই আমরা দেখি ১৯৪৫ সালে কলকাতা মহানগরীতে শাইখুল ইসলাম মাওলানা শাব্বির আহমদ ওসমানীর নেতৃত্বে পাকিস্তান আন্দোলনকে কোরদার করার উদ্দেশ্যে জমিয়তে ওলামায়ে ইসলাম গঠন করা হয়। মওলানা জাফর আহমাদ ওসমানী, মওলানা সৈয়দ সুলাইমান নদভী প্রমুখ ওলামায়ে কেরাম তখন সারা দেশে পাকিস্তান অর্জনের দাবি নিয়ে ব্যাপক সফর করেন।
বস্তুত হযরত শাহ ওলিউল্লাহ দেহলভী রহ. হযরত শাহ আব্দুল আজীজ রহ. যে জিহাদের আহ্বান জানিয়েছিলেন এবং সৈয়দ আহমদ বেরেলভী রহ. যে জিহাদ পরিচালনা করেছিলেন, তা এ দেশের আলেম সমাজ অব্যাহত রেখেছেন তাদের বুকের রক্ত দিয়ে। আযাদী আন্দোলনে এ দেশের আলেম সমাজের অবদান অবিস্মরণীয় ও অতুলনীয়।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।