তৌহিদবাদীরাই ভারতের আদিবাসী
হিন্দ অঞ্চলে যত লোক বসবাস করে তারাই হিন্দী বা হিন্দু। ফারসী ও তুর্কীতে হিন্দুস্তান। আরবীতে
রায়বেরেলীর সৈয়দ আহমদ শহদি কর্তৃক পরিচালিত জিহাদ আন্দোলন উপমহাদেশের মুসলিম জনগণের সর্বাপেক্ষা তাৎপর্যপূর্ণ এবং ব্যাপকভিত্তিক এক গণ-অভ্যুত্থানরূপে ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে রয়েছে। এ আন্দোলন ছিল প্রধানত পারিপার্শ্বিক নানা অপপ্রভাবে কলুষিত মুসলিম জনগণের ঈমান আকিদাকে শিরক, বিদআত, বিজাতীয় অনুকরণ প্রবৃতি নানা জঞ্জাল থেকে মুক্ত করে পূর্ণ ঈমানী জৌলুশ ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে পরিচালিত।
মোগল সালতানাতের পতন যুগ শুরু হওয়ার সাথে সাথে জাঠ, মারাঠা, শিখ প্রভৃতি মুসলিমবিদ্বেষী শক্তিগুলোর ব্যাপক অভ্যুত্থান শুরু হয়। পূর্বদিকে বাংলার শাসন ক্ষমতা ইংরেজ বণিকেরা দখল করে নেয়। শিখ সামন্তরাজা রঞ্জিত সিং ইরেজদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় সমগ্র পাঞ্জাব এবং উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ দখল করে লাহোরকেন্দ্রিক একটা শক্তিশালী শিখ রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে বসে। নবোত্থিত এই শিখ শক্তির আগ্রাসী থাবায় পাঞ্জাব ও সীমান্ত প্রদেশের মুসলিম জনগণ পর্যায়ক্রমে পর্যুদস্ত হতে থাকে।
অপরদিকে সমগ্র উপমহাদেশব্যাপী মুসলমানদের ধর্মীয় ও নৈতিক জীবনে নেমে আসে মারাত্মক অধঃপতন। ঈমান-আকিদার স্থান দখল করে বসে নানা কুসংস্কার ও বিজাতীয় ধ্যান-ধারণা। মুসলিম জনগণ পরিণত হয় নামসর্বস্ব মুসলমানে। সমাজের উচ্চ বিত্তদের মধ্যে শিয়া ধ্যান-ধারণা, পীরপূজা, গোরপূজাসহ অগণিত শিরক, বিদআত স্থায়ীভাবে শিকড় গেড়ে বসে। জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে নেমে আসা ক্রমবর্ধমান অধোগতি সম্পর্কে সম্পূর্ণ নিস্পৃহ হয়ে এ স্তরের লোকেরা ভোগ বিলাসের আত্মঘাতী পথে গা ভাসিয়ে দেয়।
অপরদিকে নিম্নবিত্ত শ্রেণীর মুসলিম জনগণ পাশ্ববর্তী হিন্দু সমাজের নানা আচার-আচরণে ব্যাপকভাবে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। অনেক এলাকার মুসলিম জনগণ নামের সঙ্গে হিন্দু পদবি গ্রহণ করাকে গৌরবজনক কৌলিন্যের লক্ষণ বলে বিবেচনা করতে শুরু করে।
পাঞ্চাব এবং সীমান্ত প্রদেশের বহু লুণ্ঠিত জনপদের মুসলিম নারীদেরকে শিখেরা বাঁদীরূপে ব্যবহার এবং প্রকাশ্য হাট-বাজারে ক্রয়-বিক্রয় করতে থাকে। মসজিদে আযান এবং জুমা-জামাত বন্ধ হয়ে যায়।
ইমামুল হিন্দ শাহ ওয়ালী উল্লাহর সুযোগ্য সন্তান এবং সার্থক উত্তারাধিকারী শাহ আব্দুল আজীজ তখন জীবনের শেষ প্রান্তে উপনীত হয়েছেন। হযরত মুজাদ্দিদে আলফেসানী রহ. এর যে সংগ্রামী উত্তরাধিকার তাঁর ধমনিতে প্রবহমান ছিল, সে উত্তরাধিকারের দাযিত্ব পালনের লক্ষ্যে তিনি একটা ব্যাপক সংস্কার আন্দোলন শুরু করার উদগ্র আকাক্সক্ষা ব্যক্ত করেন। সাংগঠনিক শক্তি সঞ্চয়ের মাধ্যমে তিনি আগ্রাসী শিখ ও মারাঠাদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করারও পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। কিন্তু বার্ধক্যের কারণে এ পরিকল্পনার বাস্তবায়ন সম্ভব ছিল না। তাই তিনি তাঁর প্রিয় শাগরেদ মাওলানা সৈয়দ আহমদ ব্রেলভীর ওপর এ দায়িত্ব অর্পণ করেন। ঐতিহ্যবাহী এক বুযুর্গ পরিবারের সন্তান সুঠামদেহী যুবক সৈয়দ আহমদের অসীম মনোবল এবং আধ্যাত্মিক শক্তি লক্ষ্য করে এ গুরুদায়িত্ব বাস্তবায়নের লক্ষ্যে তার সঙ্গে ভ্রাতুষ্পুত্র শাহ ইসমাঈল, জামাতা মাওলানা আব্দুল হাই লক্ষেèৗভী এবং অন্য এক প্রিয় শাগরেদ মাওলানা ইমামুদ্দিন বাঙলিকে যুক্ত করে দেন।
বলাবাহুল্য সৈয়দ আহমদ শহীদের এ মহৎ আন্দোলন সংগঠন, পরিচালনা এবং প্রাণপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণে বাংলার বীর সন্তান মাওলানা ইমামুদ্দিনের দুঃসাহসী ভূমিকা বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে।
সৈয়দ সাহেব প্রথমে মুসলিম জনগণের ধর্মীয় সংস্কারের লক্ষ্যে ব্যাপক তাবলিগী সফর শুরু করেন। এক পর্যায়ে তিনি অনুধাবন করেন যে, বৈরী শক্তির মোকাবেলা করার মতো বাস্তব পদক্ষেপ ব্যতীত শুধু ওয়াজ-নসিহতের দ্বারা অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছা সম্ভব হবে না, তখন তিনি ইংরেজ সহযোগী শিখদের বিরুদ্ধে জিহাদ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পথে অগ্রসর হন। জিহাদ শুরু করার আগে নিবেদিতপ্রাণ একদল মুজাহিদ তৈরি করা এবং জনগণের মধ্যে এ ব্যাপারে ব্যাপক সাড়া জাগানোর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন।
পর্যাপ্ত আধ্যাত্মিক শক্তিসম্পন্ন মুজাহিদ তৈরি করার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের একটা অংশ হিসেবেই সদলবলে তিনি হজের সফরে রওনা হওয়ার কথা ঘোষণা করেন। তখনকার দিনে এ সফর ছিল যেমন কষ্টসাধ্য, তেমনি সময়সাপেক্ষ। সৈযদ সাহেব অন্তত তিন বছরে এই সফর সমাপ্ত করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন।
আগেই উল্লিখিত হয়েছে যে, সৈয়দ আহমদ শহীদ তার আন্দোলন শুরু করার সূচনাতে স্বীয় উস্তাদ শাহ আব্দুল আজীজের যে কয়জন শাগরেদকে তার উপদেষ্টা এবং সার্বক্ষণিক সঙ্গীরূপে পেয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য এক ব্যক্তিত্ব ছিলেন মাওলানা ইমামুদ্দিন বাঙালি। এ ছাড়া জিহাদ আন্দোলনের আর একজন শীর্ষ স্থানীয় নেতা ও সংগঠক ছিলেন সুফি নূর মুহাম্মাদ নামক বিশিষ্ট সাধক আলেম। এঁরা উভয়ই ছিলেন সৈয়দ সাহেবের বিশিষ্ট খলিফা এবং জিহাদ আন্দোলনের প্রথম কাতারের নেতা ও সংগঠক। এই দুই মহান সাধক বীর পুরুষের মাধ্যমেই জিহাদ আন্দোলনের সাথে বাংলার জনগণের প্রত্যক্ষ যোগাযোগ গড়ে উঠেছিল। এঁদের মধ্যে মাওলানা ইমামুদ্দিন ছিলেন নোয়াখালী জেলার হাজীপুরের অধিবাসী এবং সূফী নূর মুহাম্মাদ ছিলেন চট্টগ্রামের লোক। এ ছাড়া হজের সফরে রওনা হয়ে কলকাতার দীর্ঘ তিন মাস অভস্থান করেও সৈয়দ সাহেব বহুলোককে প্রত্যক্ষভাবে এ আন্দোলনের সাথে যুক্ত করতে সমর্থ হয়েছিলেন।
সৈয়দ সাহেব হিজরী ১২৩৬ সনের ১ শাওয়াল (১৮২০ খ্রি.) ঈদরে নামায বাদ রায়বেরেলী থেকে চারশ সঙ্গীসহ নৌকাযোগে কলকাতার পথে রওনা হন। উদ্দেশ্য, কলকাতা থেকে জাহাজ ভাড়া করে জেদ্দায় যাওয়ার ব্যবস্থা করা।
পথে পথে বিভিন্ন স্থানে মনযিল এবং তাবলীগি সমাবেশ করার পর দীর্ঘ চার মাস পর রাজমহলের পথে এই কাফেলা বাংলার জমিনে এসে প্রবেশ করে। বাংলার সীমান্তে কাফেলার অভ্যর্থনার বর্ণনা দিতে গিয়ে ‘ওয়াকায়ে আহমদীর লেখক বলেন রাজমহল থেকে মুন্সী মুহাম্মদী আনসারী নামক একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি হযরত সৈয়দ সাহেবকে দশ বারো ক্রোশ দূরবর্তী তার গ্রামে নিয়ে যান। সেখানে মুন্সী মুহাম্মদী আনসারীর পিতা মুন্সী রউফ উদ্দীন, মুন্সী মখদুম বখশ, মুন্সী হাসান আলী, ফজলুর রহমান এবং মুন্সী আযীযুর রহমান সৈযদ সাহেবের হাতে বায়আত হন। এদের মধ্য থেকে মুন্সী রউফ উদ্দীন ও মুন্সী ফজলুর রহমান কাফেলার সঙ্গে শরিক হন।
রাজমহল থেকে রওনা হয়ে ৫ সফর কাফেলা মুর্শিদাবাদ পৌঁছে মুর্শিদাবাদের বিশিষ্ট লোকদের অধিকাংশই ছিল তখন শিয়া মতের অনুসারী। তাযিয়া এবং বিভিন্ন ধরনের কুসংস্কারপূর্ণ অনুষ্ঠান ছিল তাদের প্রধান উপজীব্য। সৈয়দ সাহেব মাওলানা আব্দুল হাইকে ওয়াজ করার নির্দেশ দিলেন। ওয়াজের প্রভাবে শত শত লোক সৈয়দ সাহেবের হাতে বায়আত হয়ে সকল কুসংস্কারমুক্ত হন। মুর্শিবাদ থেকে রওনা হয়ে কাফেলা একরাত কাটোয়ায় অবস্থান করে। সেখান থেকে কাফেলা হুগলি বন্দরে উপনীত হয়। হুগলিতে সাত দিন অবস্থান করে কয়েক হাজার লোককে মুরিদ করা হয়।
কাফেলা হুগলি বন্দরে থাকতেই কলকাতার বিশিষ্ট আইনজীবী মুন্সী আমিন উদ্দীন নৌকাযোগে এসে হযরত সৈয়দ সাহেবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং কাফেলার সব লোককে তার মেহমান হওয়ার জন্য অনুরোধ করেন।
মুন্সী আমিন উদ্দীন ছিলেন কলকাতার একজন প্রভাবশালী ও ধনাঢ্য ব্যক্তি। মুন্সী সাহেবের আন্তরিক ভক্তি এবং আগ্রহ লক্ষ্য করে সৈয়দ সাহেব তার মেহমানদারি কবুল করতে সম্মত হন। মুন্সী আমিন উদ্দীন হযরত সৈয়দ সাহেবের কাফেলার মেহমানদারির জন্য শহরের উপকণ্ঠে একটা সুপ্রশস্ত বাগানবাড়ি ক্রয় করে রেখেছিলেন। কাফেলার নারী পুরুষ সকলের জন্যেই এই বাড়িতে ভালোভাবে সঙ্কুলান হয়ে গেল। পথে পথে যারা কাফেলার এসে শরিক হয়েছিলেন, তাদের নিয়ে তখন লোক সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল পাঁচশতের মতো।
সৈয়দ সাহেবের কাফেলা দীর্ঘ তিন মাস কলকাতায় অবস্থান করেছিল। এর মধ্যে প্রতিদিন বাদ ফজর কাফেলার অবস্থান স্থলে ওয়াজ মাহফিল অনুষ্ঠিত হতো। ওয়াকায়ে এ আহমদীর বর্ণনা অনুযায়ী প্রতিদিন শত শত লোক মুন্সী আমিন উদ্দীনের বাগান বাড়িতে সমবেত হতো। সৈয়দ সাহেবের ওয়াজ-নসিহত শুনত এবং বায়আত গ্রহণ করে শিরক-বিদআত থেকে তওবা করত।
বাংলার প্রত্যন্ত এলাকায় সৈয়দ সাহেবের দাওয়াত পৌঁছানোর জন্য মাওলানা ইমামুদ্দীন তার জন্মভুমি নোয়াখালী এবং সুফী নুর মুহাম্মাদ চট্টগ্রাম ও সিলেট রওনা হয়ে যান। মাওলানা ইমামুদ্দীনের সঙ্গে নোয়াখালী, কুমিল্লা এবং মোমেনশাহী এলাকায় অর্ধশত বিশিষ্ট ব্যক্তি এসে উপনীত হন। সূফী নুর মুহাম্মাদ নিয়ে আসেন সিিেলট ও চট্টগ্রামের কিছু বিশিষ্ট লোক। সূফী সাহেবের এই কাফেলার সঙ্গেই এসেছিলেন বাংলার অন্যতম মুজাহিদ সংগঠক মাওলানা আব্দুল হাকিম চাটগামী ময়মনসিংহের মুন্সী ইবরাহীম ও সৈয়দ হামযা আরকানী প্রমুখ কয়েকজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি।
কলকাতার সফরেই মৌলভী বরকতুল্লাহ এবং মৌলভী এনায়েতুল্লাহ ওরফে কাযী মিয়া জান নামক দু’ব্যক্তি হযরত সৈয়দ সাহেবের খিলাফত লাভ করেছিলেন বলে জানা যায়।
দীর্ঘ দু’বছর হজের সফরে কাটানোর পর সৈয়দ সাহেব বোম্বে হয়ে কলকাতায় ফিরে আসেন। ফেরার পথেও সৈয়দ সাহেব কলকাতায় কিছুকাল অবস্থান করে বাংলার জামাতকে সুসঙ্ঘবদ্ধ করার ব্যবস্থা করেন। মাওলানা ইমামুদ্দীন পূর্ব বাংলার নোয়াখালী কুমিল্লা, ঢাকা ও মোমেনশাহী এলাকায় প্রেরিত হন। মৌলভী বরকতুল্লাহ উত্তরবঙ্গ এবং সূফী নূর মুহাম্মাদ কলকাতার আশপাশে প্রচার ও সংগঠনের কাজ শুরু করেন।
আন্দোলনের প্রধান লক্ষ্য ছিল মুসলিম জনসাধারণের আকিদা ও আমলের সংস্কার। দ্বিতীয় পর্যায়ে জনসাধারণের মধ্যে ইসলামী জীবনধারা সম্পর্কে তীব্র অনুভূতি সৃষ্টি করা। তৃতীয় পর্যাযে সর্বপ্রকার বৈরী শক্তির মোকাবেলায় প্রয়োজনীয় প্রতিরোধ গড়ে তোলা। চতুর্থ পর্যায়ে জানমাল দিয়ে কেন্দ্রীয় মুজাহিদ আন্দোলনকে সহযোগিতা দান করার অঙ্গীকার গ্রহণ করা।
মাওলানা ইমামুদ্দীন, সুফি নুর মুহাম্মাদ, মৌলভী বরকতুল্লাহ এবং মাওলানা আব্দুল হাকিমের নেতৃত্ব বাংলার মাটিতে আন্দোলন চারটি পর্যায়েই ব্যাপক সাফল্য অর্জিত হয়েছিল। ইংরেজ আমল হান্টারের ভাষায় “বাংলায় এমন কোন জনপদ ছিল না, যেখানকার মুসলমানদের মধ্যে সৈয়দ সাহেবের সংস্কারের বাণী ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেনি। প্রতিটি ধার্মিক পরিবারের যুবকরা সীমান্তে গিয়ে জিহাদ করার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতো, বৃটিশ সরকারের গোয়েন্দাদের চোখ ফাকি দিয়ে হঠাৎ করে একদিন তারা সীমান্তের মুজাহিদ কাফেলায় যোগ দেওয়ার উদ্দেশ্যে বের হয়ে যেত। জমির খাজনা পরিশোধ করতে অসমর্থ কৃষকরাও জিহাদের জন্য নিয়মিত অর্থ প্রদান করতে কুণ্ঠিত হতো না।”
দু’বছর এগারো মাস হজ্বের সফর সমাপ্ত করে সৈয়দ সাহেব রায়বেরেলী পৌছেন। ততদিন বার্মা সীমান্ত থেকে শুরু করে দিল্লী পর্যন্ত তার দাওয়াত পৌছে গিয়েছিল। লক্ষ লক্ষ লোক তার সংস্কার প্রচেষ্টার ফলে শিরক ও বিদআতের সকল জঞ্জাল থেকে মুক্ত হয়ে খালেস তওহীদের বিপ্লবী মন্ত্রে উদ্দীপিত হয়ে উঠেছিল।
সৈয়দ সাহেবের সংস্কার আন্দোলনের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য ছিল উপমহাদেশের প্রতিটি জনপদের মুসলিম জনগণের জন্য মুক্ত স্বাধীনভাবে আল্লাহর বন্দেগি করার মুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করা। হজ থেকে ফিরে যখন তিনি শুনতে পেলেন যে, আগ্রাসী শিখ সামন্ত শাসকেরা পাঞ্জাব ও সীমান্ত প্রদেশের সর্বত্র মসজিদের আযান এবং জামাত বন্ধ করে দিয়েছেন, স্বাধীনভাবে ধর্মকর্ম করার সকল সুেিযাগ রুদ্ধ করা হয়েছে, অনেক এলাকার মুসলিম নারী-শিশুদের জবরদস্তি করে ধরে এনে গোলাম বাঁদীতে পরিণত করা হচ্ছে, তখন আর কালবিলম্ব না করে তিনি শিখ শক্তির বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করার দৃঢ় সঙ্কল্প ঘোষণা করলেন। মাওলানা ইসমাঈল শহীদ, মাওলানা আব্দুল হাই, মাওলানা ইমামুদ্দীন বাঙালি ও সুফি নুর মুহাম্মাদ প্রমুখ প্রথম সারিরর খলিফাগণকে জিহাদের কাফেলায় লোকজন সমবেত করার উদ্দেশ্যে প্রেরণ করা হলো। উর্দু সাহিত্যের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় কবি মোমেন দেহলভী ছিলেন সৈয়দ সাহেবের একজন বিশিষ্ট মুরীদ ও খলীফা। তিনি জিহাদের গীত রচনা করলেন। মুরিদগণের মুখে মুখে তা সমগ্র উপমহাদেশে ছড়িয়ে পড়ল।
সৈয়দ সাহেবের হজ থেকে ফেরার পথে এনায়েতুল্লাহ নামক ভাগীরথী তীরের এক নওজোয়ান তার কাফেলায় শরিক হয়ে খিলাফত লাভ করেছিলেন। তিনি বাংলার গ্রামগঞ্জে মোমেন দেহলভীর জিহাদী কাসিদা পাঠ করে লোকজনকে উদ্দীপিত করার দায়িত্ব নিলেন।
সৈয়দ সাহেব তার আসন্ন জিহাদের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য ব্যাখ্যা করে একটা ইশতেহার রচনা করলেন। ইশতেহারের বক্তব্য ছিল নি¤œরূপ :
“শিখ জাতি বেশ কিছুকাল যাবৎ লাহোর এবং আশপাশের এক বিস্তীর্ণ এলাকার উপর জবরদখল কায়েম করে বসে আছে। এদের অত্যাচার-নির্যাতন সভ্যতার সকল সীমা অতিক্রম করেছে। এরা হাজার হাজার নিরপরাধ মুসলমানকে হত্যা করেছে। অগণিত মুসলমানকে লাঞ্ছিত করেছে। মসজিদে আজান দেয়া নিষিদ্ধ করা হয়েছে গরু জবাই করা সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করে দিয়েছে।
অথ্যাচার-নির্যাতন সীমাতিক্রম করার পর সংশ্লিষ্ট মুসলিম জনগণকে জাগ্রত ও সুসংগঠিত করে আগ্রাসী শিখ শক্তির মোকাবেলায় দাঁড়ানোর জন্য জিহাদ ঘোষণা করা হয়েছে। ইতোমধ্যেই কয়েক হাজার মুজাহিদ জিহাদে অংশ গ্রহণ করার উদ্দেশ্যে সীমান্ত প্রদেশের দিকে অগ্রস হতে শুরু করেছেন। ইনশাআল্লাহ খুব শীঘ্রই সশস্ত্র জিহাদ শুরু হচ্ছে। প্রত্যেক মুসলমানকে স্ব স্ব সাধ্য অনুযায়ী এই মহোত্তম কাজে অংশগ্রহণ করার জন্যে দাওয়াত দেয়া হচ্ছে।”
মুজাহিদীনের বিরুদ্ধে ইংরেজদের সাজানো মোকদ্দমার নথিপত্র অনুযায়ী সশস্ত্র জিহাদ ঘোষণা করার সে দিনটি ছিল ১৮২৬ খ্রিস্টাব্দে ৩১ ডিসেম্বর। সে দিন থেকেই সীমান্ত এলাকায় সশস্ত্র মুজাহিদগণ সম্মুখ সমরে অবতীর্ণ ছিলেন।
মাওলানা জাফর থানেশ্বরী তার আত্মজীবনীতে লিখেন যে, মাওলানা সৈয়দ আহমদ যখন শত শত মাইল দূরে গিয়ে শিখদের বিরুদ্ধে জিহাদ করার সঙ্কল্প ঘোষণা করেন তখন অনেকেই তাকে প্রশ্ন করেছিল যে দেশের অভ্যন্তরে ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ না করে সুদূর সীমান্ত এলাকায় গিয়ে শিখদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার অর্থ কী?
সৈয়দ সাহেব জবাবে বলেছিলেন প্রথম ইংরেজরা এখানে মুসলমানদের ধর্মীয় স্বাধীনতায় প্রত্যক্ষভাবে হস্তক্ষেপ করেনি। শিখেরা ধর্মকর্মে হস্তক্ষেপ করছে। দ্বিতীয়ত এদেশে ইংরেজ আধিপত্য মজবুত করার পিছনে শিখদের সক্রিয় সহযোগিতা সর্বজনবিদিত। তৃতীয়ত সীমান্তে মুসলিম আধিপত্য কায়েম হলে পরবর্তী পর্যায়ে সমগ্র উপমহাদেশকে সর্বপ্রকার শত্রæর কবলমুক্ত করা সহজ হবে।
উপরি উক্ত সুনির্দিষ্ট কতকগুলো লক্ষ্য সামনে নিয়ে হযরত সৈয়দ আহমদ শহদি হিজরী ১২৪১ (১৮২৫ খ্রি.) সনের প্রথম দিকে জন্মস্থল রায়বেরেলী থেকে যাত্রা মুরু করলেন, তাঁর সঙ্গী-সাথীর সংখ্যা ছিল পাঁচ থেকে ছয় হাজার। এর মধ্যে কাফেলার রোজ নামচা লেখকের বর্ণনা অনুযায়ী বাংলার মুজাহিদ সংখ্য ছিল এক হাজারের কাছাকাছি। তন্মধ্যে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কাজের দায়িত্বে নিয়োজিত নেতৃস্থানীয় লোক ছিলেন চল্রিশ জনের মতো। পাঞ্জাব ও সীমান্ত এলাকার মুসলমানদের হৃত ধর্মীয় অধিকার পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে অগ্রসরমান এই দ্বীনি কাফেলা যাতে যাত্রা পথেই বাধাপ্রাপ্ত না হয়, সেজন্য পাঞ্জাবরে পথ পরিহার করে তারা সিন্ধুর পথে অগ্রসর হতে থাকেন। পথে পথে হায়দারাবাদ, সিন্ধু, বাহওয়ালাপুর হয়ে বোলান উপত্যকা অতিক্রম করে প্রথমে কান্দাহার ও পরে কাবুলে গিয়ে উপনীত হন। পথিমধ্যে সিন্ধুর হায়দরাবাদ ও বাহওয়ালপুর এলাকার মুসলমানদের মধ্যে জিহাদের দাওযাত চলতে থাকে। মাওলানা ইসমাঈল শহীদ, মাওলানা আব্দুল হাই, মাওলানা ইমামুদ্দিন বাঙালি, সুফি নুর মুহাম্মদ প্রমুখ শীর্ষস্থানীয় আলেম ও বুযুর্গগণ স্থানে স্থানে ওয়াজ-নসিহত করে জনগণকে জিহাদের মন্ত্রে উদ্দীপিত করতে থাকেন।
হিন্দুস্তান থেকে কাবুল পর্যন্ত নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা এবং নতুন লোক ও অর্থ পৌছানোর সুব্যবস্থাও সম্পন্ন করা হয়।
কাবুলে কিছুকাল অবস্থান করে খায়বার গিরি পথ হয়ে কাফেলা এসে পেশোয়ার পৌঁছে। পেশোয়ারে তখন রঞ্জিত সিং-এর তরফ থেকে একজন সুবেদার নিয়োজিত ছিলেন। তিনি রাজস্ব আদায় করে লাহরে প্রেরণ করতেন, শিখ সেনাদের ছাউনি ছিল আটক দরিয়ার পূর্ব পাড়ে পাঞ্জাব সীমান্তে অবস্থিত একটি দুর্গে। দুর্গ থেকে পেশোয়ার পর্যন্ত নিয়মিত সশস্ত্র প্রহরায় ডাক চলাচল করত। কোন কসবা বা শহরের লোকেরা অবাধ্যতা শুরু করলেই দুর্গ থেকে সৈন্য প্রেরণ করা হতো, চালানো হতো অবাধ লুণ্ঠন এবং অগ্নিসংযোগ। নির্বিচারে হত্যা করা হতো সে এলাকার লোকজনকে।
হযরত সৈয়দ আহমাদ শহীদ সীমান্ত প্রদেশের কেন্দ্রস্থল পেশোয়ারের সাথে শিখদের প্রত্যক্ষ যোগাযোগ বিভিন্ন করার লক্ষ্য নিয়ে কাফেলাসহ পেশোয়ারার উপত্যকা পেছনে রেখে নওশেরায় গিয়ে উপনীত হলেন। এখানে দরিয়া আবাসীনের তীরে অবস্থান গ্রহণ করে নিজস্ব একজন দূতের মারফত রঞ্জিত সিং-এর লাহোর দরবারে একটা বিস্তারিত পত্র পেরণ করলেন। পত্রে তার এই অভিযানের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করে মুসলিম জনগণের সঙ্গে এ পর্যন্ত যেসব জুলুম করা হয়েছে তা বন্ধ করার নিশ্চয়তা বিধান এবং জবরদখলকৃত মুসলিম এলাকাগুলো মুক্ত করে দেয়ার দাবি জানানো হলো।
উদ্ধত লাহোর দরবার একজন সংসারত্যাগী ফকিরের এ পত্রের কোনো জবাব না দিয়ে মুজাহিদীনের এ কাফেলাকে শায়েস্তা করার হুকুম দিয়ে সরদার বুধসিং-এর নেতৃত্বে এক বিরাট সৈন্যবাহিনী পাঠিয়ে দিলো। মুজাহিদগণের সঙ্গে বুধসিং-এর মোকাবেলা হয় নওশের থেকে সাত-আট মাইল দূরবর্তী আকোড়াখটক নামক স্থানে। প্রথম এই মোকাবেলায় সরদার বধুসিং-এর বাহিনী শোচনীয়ভাবে পরাজয় বরণ করে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়।
আকোড়াখটকের যুদ্ধে বুধসিং-এর পরাজয়ের ফলে পেশোয়ারের সাথে শিখদের প্রত্যক্ষ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। পেশোয়ারের সুবেদার ইয়ার মুহাম্মাদ খান এবং তার ভাই পীর মুহাম্মাদ খান এ খবর শোনার পর পত্র মারফত মুজাহিদগণের সঙ্গে যোগাযোগ করতে শুরু করেন।
সরদার বুধসিংকে তাড়িয়ে দেওয়ার পর থেকেই মুজাহিদগণ শিখদের তরফ থেকে একটা বড় ধরনের আক্রমণের আশঙ্কা পোষণ করা আসছিলেন। নওশেরার পূর্বদিকে সিদোতে সম্ভাব্য সেই আক্রমণ প্রতিরোধ করার জন্য প্রস্তুতি শুরু করলেন। ইতোমধ্যে হাযরো নামক স্থানে শিখদের একটা সমাবেশের খবর এলো। ‘মনযুরা’ নামক রোচনামচার বর্ণনা অনুযায়ী বাংলার মুজাহিদগণ দ্বারা গঠিত একটা নৈশ অভিযানকারী দল অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে সে সমাবেশটা সম্পূর্ণরূপে পর্যুদস্ত করে দেয়। এ অভিযানে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র এবং রসদপত্র মুজাহিদগণের হয়।
পরপর দু’টি সংঘর্ষে জয়লাভ করার পর মুজাহিদগণের মনোবল বৃদ্ধি হওয়ার সাথে সাথে এলাকার জনগণের আস্থাও অনেকটা বর্ধিত হলো। এলাকার বিশিষ্ট আলেম এবং গোত্র সরদারগণের এক সমাবেশে ১৮২৭ সনের ১১ জানুয়ারি হযরত সৈয়দ আহমদ শহীদকে ‘আমিরুল মুমিনীন’ রূপে ঘোষণা করে তার হাতে জিহাদ এবং ইমামতের বায়আত গ্রহণ করা হলোঅ পেশোয়ারের আমির সরদার ইয়ার মুহাম্মদ খান দূত মারফত পত্র প্রেরণ করে ‘আমিরুল মুমিনীন’-এর প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করলেন। হযরত সৈয়দ সাহেব ইয়ার মুহাম্মদ খানকেই শাসন কর্তত্বে বহাল রেখে বিশিষ্ট আলেমগণের একটি পরামর্শ মজলিস কায়েম করে সমগ্র সীমান্ত প্রদেশে ইসলামী আইন কানুন জারি করার সুব্যবস্থা করেন।
হযরত সৈয়দ সাহেবের সংস্কার আন্দোলনের উত্তরাধিকার যারা এ বাংলার জমিনে বহন করে গেছেন তাদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা স্মরণীয় ব্যক্তিত্ব তার অন্যতম বিশিষ্ট খলিফা মাওলানা কারামত আলী জৌনপুরী। ইনি সারা জীবন বাংলা আসামে ঈমান আখলাক সংস্কারের প্রচেষ্টা চালিয়ে এ বাংলার মাটিতেই চিরনিদ্রায় শায়িত রয়েছেন। তার সে প্রচেষ্টার ধারাবাহিকতা তাঁর সুযোগ্য বংশধর এবং বহুসংখ্যক অনুসারীর মাধ্যমে এদেশে আজো অব্যাহত রয়েছে। মাওলানা ইমামুদ্দিন ও মাওলানা আব্দুল হাকিম প্রধানত মুজাহিদ সংগঠনের কাজেই নিয়োজিত থাকেন। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তারা এ কাজ করে গেছেন। মুসলিম জনগণের ধর্মীয় ও সামাজিক সংস্কারের ক্ষেত্রেও তাদের অবদান বিশেষভাবে উল্লেখ করার মতো।
সূফী নূর মুহাম্মাদের সংস্কার আন্দোলনের প্রধান উত্তরাধিকারী ছিলেন কলকাতার সুফি ফতেহ আলী, সূফী ফতেহ আলীর খলিফা বাংলার মুজাদ্দেদ ফুরফুরার মাওলানা আবু বকর সিদ্দিক এবং তার খলিফাগণের মধ্যে শর্ষীনার মাওলানা নেছারউদ্দিনও। পরগড়নার মাওলানা রুহুল আমীন সাহেবের দ্বীনি খেদমত এদেশ সর্বজনবিদিত।
উল্লেখ নিষ্প্রয়োজন যে, হযরত সৈয়দ আহমদ শহীদের এসব অনুসারীর কর্ম শুধু ওয়াজ-নসিহতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেননি। এ দেশের পর্যুদস্ত মুসলিম ঈমান-আকিদার সংস্কার করার সাথে সাথে শিক্ষা বিস্তার এবং শোষিত নৈরাজ্য-পীড়িত জনগণের মধ্যে অধিকার সচেতনতা সৃষ্টি করার ক্ষেত্রেও তাদের অবদান ছিল সর্বাপেক্ষা তাৎপর্যপূর্ণ।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।