তৌহিদবাদীরাই ভারতের আদিবাসী
হিন্দ অঞ্চলে যত লোক বসবাস করে তারাই হিন্দী বা হিন্দু। ফারসী ও তুর্কীতে হিন্দুস্তান। আরবীতে
বাংলাদেশের স্বাধীনতা ইতিহাসের নিয়মেই বাস্তব রূপ লাভ করেছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস- ইতিহাসের অনেক চড়াই-উৎরাই পাড়ি েিদয় ১৯৭১ সালে এসে এক সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ রূপান্তরিত হয়। এ যুদ্ধকে অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইও বলা যায়। ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ থেকে ইংরেজ তাদের শাসনযন্ত্র তলে নিয়ে এখানে দুই দেশের পত্তন করে যায়- একটির নাম ভারত অপরটির নাম পাকিস্তান। তদানীন্তন পূর্ববাংলা ও সিন্ধু, বেলুচিস্তান, পশ্চিম পাঞ্জাব, উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ প্রভৃতি নিয়ে পাকিস্তান নামক দেশটির জন্ম হয়।
পূর্ব বাংলা অংশের নাম হয় পূর্ব পাকিস্তান এবং অন্যান্য প্রদেশগুলোর সমন্বিত নাম হয় পশ্চিম পাকিস্তান। কিন্তু ১৯৪৭ সালের আজাদীর লড়াইয়ে পশ্চিম পাকিস্তান অংশের চেয়ে পূর্ব পাকিস্তান অংশের অবদান সবচেয়ে বেশি থাকা সত্তে¡ও পশ্চিমাযারা সবসময়ই পূর্বাঞ্চলের উপর কৌশলে প্রভৃত্ব করে আসছিলো। ফলশ্রুতিতে পূর্ব বাংলা পাকিস্তান সৃষ্টির কাল থেকেই স্বায়ত্তশাসনের দাবি করে আসছিলো। কিন্তু নানা তালবাহানার মধ্য দিয়ে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী কায়দায় এ অঞ্চলে কিছু দালাল সৃষ্টি করে তারা পূর্ব পাকিস্তানের উপর যে বৈষম্য নীতি চালিয়ে আসছিলো এ নিয়ে বহু আন্দোলন হয়েছে এখানে। এ অঞ্চলের ভাষা ও সংস্কৃতিকে ধ্বংস করার প্রয়াসও তারা চালায়। কিন্তু সবক্ষেত্রে এদেশের মানুষ রুখে দাঁড়িয়েছে। সৃষ্টি হেেছ ৫২-এর একুশে ফেব্রুয়ারির মতো প্রেরণার উৎস।
বাংলাদেশের মানুষের প্রেরণার যে উজ্জীবিত ধারা তা কখনও বেগবান হয়েছে, কখনও ষড়যন্ত্রের মুখে স্মিমিতও হয়েছে। জন্ম নিয়েছে নতুন আন্দোলনের। ১৯৬৯ সালে ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের তথাকথিত উন্নয়ন দশকের পূর্তি উৎসবকে এদেশের মানুষ গ্রহণ করতে পারেনি সত্য হিসেবে। সৃষ্টি হয়েছে ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান। ফলে আইয়ুব বিদায় নিয়েছেন। এসেছেন নতুন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান। তিনি এলেন নির্বাচনের বুলি মুখে নিয়ে। নির্বাচন দিলেন। নির্বাচনে বাংলাদেশ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনের অধিকারী হলো। শেখ মুজিবুর রহমানের দল এই সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনে সমর্থ হলো। কিন্তু বাংলাদেশের নেতৃত্বে পাকিস্তান চালিত হোক এটা পশ্চিম পাকিস্তানি স্বার্থান্বেষী মহল মেনে নিতে রাজি হলো না। লারকানার সামন্ত-প্রভু জেদী কূটনীতিক ক্ষমতার অন্ধমোহে আচ্ছন্ন জুলফিকার আলী ভুট্টোকে তারা ব্যবহার করলো ঘুটি হিসেবে। জুলফিকার আলী ভুট্টোর দল পশ্চিম পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করলেও তিনি মূলত দ্বিতীয় স্থান দখল করেন। তবুও তাঁর বায়না প্রধান মন্ত্রিত্ব তাঁর চাই-ই। অথচ সংরক্ষিত মহিলা আসনসহ মোট ৩১৩টি আসনবিশিষ্ট প্রস্তাবিত পার্লামেন্টে শেখ মুজিবুর রহমানের দল ১৬৭ আসন লাভ করে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। এই বজয় ছিলো বাংলাদেশের মানুষের বিজয়। এতে শঙ্কিত পশ্চিম পাকিস্তানি স্বার্থান্বেষী চক্র প্রমাদ গুণলো। ২০ ডিসেম্বর ১৯৭০-এ ভুট্টো সাহেব তো বলেই ফেললেন তার দলের সহযোগিতা ছাড়া শাসনতন্ত্র প্রণয়ন চলবে না এবং কেন্দ্রীয় সরকার গঠন করতে দেয়া হবে না। পরের দিন তিনি তাঁর সুর আরও চড়িয়ে বললেন, ‘পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে সমস্যার সমাধান করা যাবেনা। বিরোধী দলীয় আসনে বসার জন্য তাঁর দল (চ.চ) নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেনি। সব ব্যাপারে আমাদের মতামত নিতে হবে।’
এদিকে বাংলাদেশে স্বায়ত্তশাসনের দাবি আরও জোরদার হতে লাগলো। নির্বাচনের বিজয় স্বায়ত্তশাসনের দাবির বিজয় হিসেবে জনগণ গ্রহণ করলো। ইয়াহিয়া খান যেনো কোনো অজানা হাতে পরিচালিত হতে লাগলেন। ১৪ জানুয়ারি ১৯৭১-এ তিনি বললেন, ‘শেখ মুজিবুর রহমান হচ্ছেন দেশের ভবিষ্যত প্রধানমন্ত্রী। যখন তিনি দায়িত্ব গ্রহণ করবেন আমি আর থাকবো না।’ তার এ বক্তব্যে কতটুকু আন্তরিকতা রয়েছে তা নিয়ে দেশের মানুষের মনে বেশ সন্দেহের উদ্রেক হয়। ইতিমধ্যে লাহোরে হাইজ্যাক করা একটি ভারতীয় বিমানের ধ্বংসের ঘটনাকে কেন্দ্র করে জনমনে অশুভ সংকেত এসে দানা বাঁধে। ১৩ ফেব্রুয়ারি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া- বাংলাদেশের দাবির প্রেক্ষিতে পাকিস্তানের জন্য একটা সংবিধান প্রণয়নের উদ্দেশ্যে ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ৩ মার্চ সকাল নয়টায় ঢাকায় প্রাদেশিক পরিষদ ভবনে পাকিস্তান জাতীয় সংসদের অধিবেশন আহ্বান করলেন। কিন্তু ভুট্টো সাহেব বেঁকে বসলেন। ১৫ ফেব্রুয়ারি তিনি ঘোষণা করলেন, নির্বাচিত সংখ্যাগুরু দল প্রকাশ্যে অথবা গোপনে আমাদের কিছুটা ‘কনসেশনের’ প্রতিশ্রুত না দেয়া পর্যন্ত তিনি ও তার পার্টি (পি.পা) ঢাকায় ৩ মার্চ আহূত জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যোগদান করবে না। সংখ্যাগুরু দল কর্তৃক ইতিমধ্যে প্রণীত একটা সংবিধানে কেবলমাত্র আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মতি দেয়ার জন্য আমার পার্টি সদস্যদের পক্ষে ঢাকা যাওয়া এবং অপমানিত হয়ে ফিরে আসা সম্ভব নয়।
ভুট্টোর এই ঘোষণায় পূর্বাঞ্চলের নেতৃবৃন্দ অত্যন্ত মর্মাহত হলেন। মওলানা ভাসানী ১৩ ফেব্রুয়ারি ঘোষণা করলেন, জুলফিকার আলী ভুট্টো সাহেব তাঁর জেদের মাত্রাও বাড়িয়ে দিলেন। তিনি বললেন, ‘বর্তমান পরিস্থিতিতে ঢাকায় আসন্ন জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যোগদান অর্থহীন। জাতীয় সংসদ একটা কসাইখানায় পরিণত হবে।’
যা হবার তাই হলো। ১ মার্চ ১৯৭১ বেলা বারোটায় খবরে ভেসে এলো ইয়াহিয়া খানের অনির্দিষ্টকালের জন্য জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করার কথা। তিনি ঘোষণা করলেন, “পাকিস্তানে এখন ভয়াবহ রাজনৈতিক সংকটের সৃষ্টি হয়েছে। তাই আমি জাতীয় সংসদের আসন্ন অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করলাম।”
এই ঘোষণা রেডিও মারফত প্রচারিত হবার সঙ্গে সঙ্গে ঢাকা ফেটে পড়ে বিক্ষোভে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কলাভবনের সামনে হাজার হাজার ছাত্র ‘আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন হলো স্লোগান নিয়ে সমবেত হয়। কলাভবনে উড্ডীন করা হয় স্বাধীন বাংলার পতাকা। ছাদের মিছিল বেরোয়। জঙ্গী মিছিল। শেখ মুজিবুর রহমান ইয়াহিয়া খানের এই ঘোষণার খবর পেয়ে ছাত্র জনতার উদ্দেশ্যে বললেন, ‘জাতীয় সংসদের আসন্ন অধিবেশন স্থগিত করা খুব দুঃখজনক।’ ঘোষিত হয় ৩ মার্চ সারা দেশব্যাপী হরতাল ও ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে জনসভার কথা। অহিংস ও অসহযোগ আন্দোলনের আগুন ফেটে পড়ে। ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে এক বিশাল জনসমাবেশে শেখ মুজিবুর রহমান তার দীর্ঘ বক্তৃতার এক পর্যায়ে ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম, আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম।” ঘোষণা করেন।
৯ মার্চ পল্টন ময়দানে এক বিশাল জনসমাবেশে মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী সরাসরি স্বাধীনতা ঘোষণার দাবি করে বললেন, “অনেক হইয়াছে আর নয়। তিক্ততা বাড়াইয়া আর লাভ নাই। লাকুম দ্বীনুকুম অলইয়াদীন এর নিয়মে পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা স্বীকার করিয়া লও।”
এখানে উল্লেখ্য যে, মওলানা ভাসানী ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দে কাগমারী সম্মেলনে প্রথম স্বাধীনতার আওয়াজ তোলেন। পরবর্তীকালে এদেশের ছাত্রদের একটি অংশ ‘কৃষক শ্রমিক অস্ত্র ধর-পূর্ব বাংলা স্বাধীন কর’ স্লোগান দিয়ে জাতিকে সম্পূর্ণ ৬০ দশকে উজ্জীবিত করার প্রয়াস চালান। এমনকি ৭০-এর ১২ নভেম্বর উপকূল এলাকায় ভীষণ জলোচ্ছ্বাসে লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রাণহানি এবং পাকিস্তান সরকারের এ ব্যাপারে অমনোযোগিতা এবং ঐ সময় এক আন্তর্জাতিক মোটর র্যালির অভিজ্ঞতার আলোকে মওলানা ভাসানী দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে স্বাধীন পূর্ব বাংলা ঘোষণা করেন এবং সারাদেশে প্রচারপত্র ছড়িয়ে দেন। মওলানা ভাসানী আন্দাজ করতে পেরেছিলেন নির্বাচন বুর্জোয়া রাজনীতিতে টিকে থাকার একটি কৌশল। যে কারণে তিনি ১৯৭০-এর ডিসেম্বরের নির্বাচন বর্জন করেছিলেন। তবুও যখন সবাই দেখলেন সত্যিই নির্বাচনের প্রহসরেন মধ্যে দিয়ে পশ্চিমারা নিজেদের ক্ষমতা সুদৃঢ় করতে চায়। নির্বাচনের পর জনতার সঠিক রায় তারা মেনে নিতে নারাজ তখনই সশস্ত্র যুদ্ধ ছাড়া কোনো গত্যন্তর ছিলো না। মওলানা ভাসানী সেদিনের সেই বিশাল জনসমাবেশে বলেছিলেন, “ভাইয়ে ভাইয়ে গন্ডগোল হয়। নিজেরা আপস যদি পৃথক হয়ে যায় সেখানে শান্তি বিঘ্ন হবার কোনো সম্ভাবনা থাকে না। আর যদি নিজেরা আপস পৃথক হতে ব্যর্থ হয় সেক্ষেত্রে এক মর্মান্তিক অবস্থায় সৃষ্টি হয়।” তিনি ইয়াহিয়া খানকে উদ্দেশ্যে করে পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা মেনে নেবার জন্য জোরালো দাবি তোলেন এবং হুঁশিয়ার করে দেন। সেই সভাতেই তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে, “যদি আপস স্বাধীনতা না আসে তাহলে বাংলার মানুষকে সশস্ত্র লড়াই করতে হবে। তাতে ৩০ থেকে ৩৫ লক্ষ লোকের প্রাণহানি ঘটবে। রক্তের বদলে স্বাধীনতা আসবেই।”
৯ মার্চ মওলানা ভাসানী এক প্রচারপত্রের মাধ্যমে সারাদেশকে এই বলে আহ্বান জানান যে, ‘আজ আমি সাত কোটি পূর্ব বাংলার সাধারণ মানুষের কাছে এই জরুরি আহ্বান জানাইতে বাধ্য হচ্ছি যে, আপনারা দল মত ও শ্রেণি নির্বিশেষে প্রতিটি মানুষ একত্রে এবং একযোগে একটি সাধারণ কর্মসূচি গ্রহণ করুন যার মূল লক্ষ্য হবে ২৩ বছরের অমানুষিক এবং শোষণকারী শাসকগোষ্ঠীর করাল থেকে পূর্ব বাংলাকে সম্পূর্ণ চূড়ান্তভাবে স্বাধীন ও সার্বভৌম করা।” (দ্র. বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র : ২ খন্ড, ৭১২ পৃ:)।
এমনিভাবে স্বাধিকার আন্দোলন স্বাধীনতা আন্দোলনে রূপান্তরিত হয়। পূর্ব বাংলার আন্দোলনের তীব্রতা পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর মসনদ কাঁপিয়ে তোলে।
১৫ মার্চ করাচীকে এক সাংবাদিক সম্মেলনে ভুট্টো সাহেব শুধু সংখ্যাধিক্যের জন্য পাকিস্তান শাসন পরিচালনা করা যাবে না বলে দাবি তুললেন। তিনি আরো বললেন, “তার পার্টিকে বাদ দিয়ে কোনো সরকার গঠন করা সম্ভব নয়।”
তাঁর দাবিতে যোগ করলেন, তাঁর পার্টি পশ্চিম পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল। তাই কেন্দ্রের ক্ষমতা শেখ মুজিবের ও তাঁর দলের মধ্যে ভাগাভাগি করে দিতে হবে।
ওদিকে ভুট্টোর এই অযৌক্তিক দাবির প্রতিবাদে পশ্চিম পাকিস্তানি নেতা নবাবজাদা নসরুল্লা খান, মাহমুদুল হক উসমানী, খাজা মাহমুদ, নান্টু মিয়া, নিজামুদ্দীন হায়দার, সৈয়দ আলী আসগর শাহ, হামিদ সরফরাজ, নবাবজাদা শের আলী খান, খাজা মুহাম্মদ সরফরাজ, এ. আর এস. শাসুদ দোহা প্রমুখ পৃথক পৃথক বিবৃতি দিলেন। পেশোয়ারে এক আইনজীবী সমিতির সভায় আসগর খান বললেন, “সংখ্যাগুরু দলের কাছে অবিলম্বে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হোক এবং এটাই হচ্ছে গণতন্ত্রসম্মত।” ন্যাপ প্রধান খান ওয়ালী খানও বললেন, “নির্বাচিত পার্লামেন্টের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হোক। সত্য বলতে কি, পশ্চিম পাকিস্তানের আর অস্তিত্ব নেই। ১ জুলাই থেকে এখানে চারটি পৃথক প্রদেশ হয়েছে।”
এদিকে ঢাকায় শেখ মুজিব ইয়াহিয়া বৈঠকের প্রস্তুতি চলে। সর্বস্তরের ছাত্রজনতা এই বৈঠকের বিরোধিতা করলো। এই নিয়ে ঢাকায় মিছিলের পর মিছিল বেরুলো। শেষমেশ কড়া নিরাপত্তার মধ্যে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ঢাকা এলেন। কড়া সামরিক পাহারায় প্রেসিডেন্ট হাউসে (পুরাতন গণভবনে) এসে উঠলেন। ১৬ মার্চ শুর হলো ইয়াহিয়া-মুজিব বৈঠক। দু’জন প্রথম দফা বৈঠকে কোনো পরামর্শদাতা ছাড়াই একান্তে বৈঠকে বসলেন। পরদিন ১৭ মার্চ আবার বৈঠক বসলো। এবারও উভয়ের পক্ষ থেকে পরামর্শদাতাও উপস্থিত থাকলো। শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষ থেকে গণতান্ত্রিক রায়ের ভিত্তিতে ক্ষমতা হস্তান্তরের কথা তোলা হলো। সাথে সাথে ৬ দফার ভিত্তিতে প্রস্তাবিত সংবিধান প্রণয়নের যৌক্তিকতা প্রদর্শন করা হলো। ৬ দফার প্রতিটি দফার উপর বিস্তারিত আলোচনা হলো। কিন্তু বৈদেশিক বাণিজ্য, বৈদেশিক সাহায্য এবং ব্যাংকিং প্রশ্নে কিছুটা অচলাবস্থার সৃষ্টি হলো। কিন্তু শেখ মুজিবুরের পক্ষ থেকে জোরালো যুক্তি উত্থাপিত হলে ইয়াহিয়া খানের পরামর্শদাতারা হতভম্ব হয়ে গেলেন। এই বৈঠক থেকে বেরিয়ে এসে শেখ মুজিব সাংবাদিকদের প্রশ্ন থেকে নিজেকে এড়িয়ে গেলেন। এমনিভাবে বৈঠকের পর বৈঠক চলতে লাগলো কিন্তু সারা বাংলাদেশ এটা ইতিমধ্যে উপলব্ধ করতে পারছিলো এই বৈঠক সময় ক্ষেপণ এবং ক্ষমতার দ্ব›দ্ব। ২০ মার্চ মওলানা ভাসানী চট্টগ্রাম থেকে ২৩ মার্চ পাকিস্তান দিবসকে পতাকা দিবস হিসেবে পালন করার আহ্বান জানালেন। ২১ মার্চ জুলফিকার আলী ভুট্টো ঢাকা এলেন বেশ কয়েকজন পরামর্শদাতা সঙ্গে করে। ভুট্টো এসেই বললেন, শেখ মুজিব আর ইয়াহিয়ার সাথে বৈঠকেই সব সমস্যার সমাধান হতে পারে না। তিনিও একটি পক্ষ। ত্রিপক্ষীয় সমঝোতার মধ্যেই কেবল সমস্যার সমাধান সম্ভব। এদিকে শেখ মুজিবও আলোচনা ‘অগ্রগতির দিকে’ বলে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাব দিতে লাগলেন। আলোচনার মূল বিষয় সম্পর্কে জনগণ অন্ধকারেই থাকতে লাগলো। ২৩ মার্চ পতাকা দিবস পালিত হলো। আনুষ্ঠানিকভাবে শেখ মুজিবও পতাকা উড্ডীন করলেন। ২৪ মার্চও বৈঠক বসলো। ২৫ মার্চ শেক মুজিব সন্ধ্যায় জারীকৃত এক বিবৃতিতে সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের বিষয়টি বিলম্বিত হওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করলেন। তিনি বললেন, ‘প্রেসিডেন্টের ঢাকায় আগমন ও আলোচনার ফলে জনমনে এ রকম একটা ধারণা হয়েছিল যে, দেশের ভয়াবহ পরিস্থিতি সম্পর্কে কর্তৃপক্ষের চেতনার সৃষ্টি হয়েছে এবং রাজনৈতিকভাবে তা সমাধান সম্ভব। ... ... আমরা আমাদের দায়িত্ব নিষ্ঠার সাথে পালন করছি এবং সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের জন্যে সর্বাধিক প্রচেষ্টা করেছি। এখানে আর বিলম্বিত হওয়ার কোনো কারণ থাকতে পারে না। (এম. আর. আখতার মুকুল, আমি বিজয় দেখেছি পৃ. ৩৬৮)
২৫ মার্চ সন্ধ্যায় ইয়াহিয়া খান ঢাকা থেকে করাচী গেলেন। এই রাতেই ঢাকা নগরীতে শুরু হলো হত্যাকান্ড। ঢাকা শহরে সে রাত ছিলো এক কালো রাত। ইতিহাসের নজিরবিহীন বর্বরোচিত হত্যাকান্ডের স্মৃতিবিজড়িত রাত। মানুষের রক্তে লাল হয়ে উঠলো ঢাকার রাজপথ। এই রাতে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে দেশপ্রেমিক নেতাদের গ্রেফতার করা হলো। শেখ মুজিবকেও ওরা ধরে নিয়ে গেলো। ২৬ মার্চ এলো স্বাধীনতার দৃঢ় প্রত্যয়ে উদ্ভাসিত মুক্তিযুদ্ধের আহ্বান নিয়ে। সারা দেশে নেমে এলো নতুন বিপ্লবী উত্তেজনা। ওদিকে ইয়াহিয়া খান সামরিক আইন জোরদার করে সমস্ত রাজনৈতিক কর্মকান্ড নিষিদ্ধ ঘোষণা করে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দিলেন। সংবাদপত্রের উপর পূর্ণ সেন্সরশীপ আরোপ করা হলো। সারা দেশের মুক্তিযুদ্ধের সাজসাজ রব পড়ে গেলো, আর নয়- এবার স্বাধীনতা। জীবন দিয়ে হলেও স্বাধীনতা চাই। ২৬ মার্চ ইতিমধ্যে চট্টগ্রামে প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে মেরজ জিয়াউর রহমান স্বাধীনতা ঘোষণা করলেন। ওদিকে বাংলাদেশে পাকিস্তান সামরিক জান্তা প্রচুর সৈন্য সমাবেশ ঘটালো। শুরু করলো হত্যাকান্ড। ৩০ মার্চ মেরজ জিয়াউর রহমান পাক হানাদার বাহিনী কর্তৃক বাংলাদেশের গণহত্যা রোধ করার জন্য এগিয়ে আসতে জাতিসংঘ ও বৃহৎ শক্তিবর্গের নিকট আবেদন জানালেন তা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের মাধ্যমে প্রচারিত হলো। শিহর ছেড়ে দলে দলে মানুষ ছুটলো নিরাপত্তার খোঁজে গ্রাম-গ্রামান্তরে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে যেয়ে আশ্রয় নিলো অসংখ্যা মানুষ। দেশের ভেতরেও মুক্তি সংগ্রামের আয়োজন জোরদার হলো। দামাল ছেলেরা রুখে দাঁড়ালো। গঠিত হলো মুক্তিবাহিনী।
১৬ ডিসেম্বর বিকেল ৪-৩১ মিনিটে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর পক্ষে লেফটেন্যান্ট জেনারেল এ. এ. কে. নিয়াজীর ঢাকার রেকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করার মধ্য দিয়ে বিজয়ের বারতা ঘোষিত হয় লক্ষ লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয় বাংলাদেশের স্বাধীনতা। এ স্বাধীনতা বাংলাদেশের মানুষের অর্জিত স্বাধীনতা। এ স্বাধীনতা, এ সার্বভৌমত্ব বাংলাদেশের মানুষের কাছে প্রাণের চেয়েও প্রিয়। কোন হায়েনা শক্তিই একে লুট করতে পারবে না। কবির কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে বলি “বাংলার মাটি দুর্জয় ঘাঁটি বুঝে নিক দুর্বৃত্ত।”
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।