তৌহিদবাদীরাই ভারতের আদিবাসী
হিন্দ অঞ্চলে যত লোক বসবাস করে তারাই হিন্দী বা হিন্দু। ফারসী ও তুর্কীতে হিন্দুস্তান। আরবীতে
যেদিন থেকে এই পৃথিবী সৃষ্টি হয়েছিল, শিল্প ও সৌন্দর্য ছিল সৃষ্টির অভ্যন্তরে ও বাইরে। কিন্তু এই সৌন্দর্যকে যিনি দেখতে পান এবং বিভিন্নভাবে অন্যকে দেখানোর চেষ্টা করেন, তিনি একজন শিল্পী। একজন শিল্পী এবং একজন সাধারণ মানুষের মধ্যে পার্থক্য এখানেই। একজন সাধারণ মানুষ বৃক্ষকে বৃক্ষ রূপেই দেখেন, নদীকে নদীর মতো। কিন্তু শিল্পী দেখেন কী অপরিসীম ধৈর্য ও শিল্পগুণ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বৃক্ষটি, তিনি দেখেন কতটা জল নিয়ে তবে স্রোতস্বিনী প্রবাহমান হয়। একজনের সাধারণ দৃষ্টি আর অপরজনের প্রগাঢ় পর্যবেক্ষণ। সত্য ও সুন্দর একাকার হয়ে যায় শিল্পীর কর্ষিত বাগানে। প্রকৃতির বর্ষণের স্নিগ্ধতায় সিক্ত হয়ে ওঠে অন্তর। একজন শিল্পী নিজেকে খোঁজেন তৃণ থেকে মহাকাশের সর্বস্তরে এবং তিনি রেখাপাত করে যান এক অনিন্দ্য সুন্দরের।
শেখ মোহাম্মদ সুলতান যার ডাকনাম লাল মিয়া, পরবর্তীতে যিনি এস এম সুলতান হিসেবেই সমধিক পরিচিত সমস্ত বিশ্বভুবনে; তিনি এক আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব ও সুমহান বিস্ময়। অজগর সাপ ও কুকুরের মধ্যে যিনি ভালোবাসা ঘটান, ময়না ও টিয়ার মধ্যে প্রচন্ড স¤প্রীতি, তিনি একজন শিল্পী, প্রকৃত সত্তা। কে কবি? এমন প্রশ্নের উত্তরে মাইকেল মধুসূদন দত্ত বলেছিলেন, ‘শব্দে শব্দে বিয়ে দেয় যে জন, সে জন কবি নয়; বরং কবি সেই, যার কথায় কাননে কুসুম ফোটে, নদীতে বয়ে যায় স্রোত, প্রকৃতি যার আজ্ঞা মানে, তিনিই প্রকৃত কবি।’ এস এম সুলতান যেন এমনই একজন শিল্পী, তুখোড় নিনাদ, যার আজ্ঞা মানে বিষধর সাপ, বনের বুলবুলি, ঘুঘু। বাগানে ফুল হেসে ওঠে তাকে দেখে। এমনই সম্মোহিত ক্ষমতা ছিল তার। লম্বা চুলের অধিকারী এস এম সুলতান দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করে পিতাকে সাহায্যের জন্য রাজমিস্ত্রি হন। কিন্তু ইটের প্রতিটি সাজানো স্তরে ফুটে উঠতে থাকে প্রচন্ড বিস্ময়, সত্যের অনিকেত। ‘সূর্যের যে প্রতিদিনের প্রভা সে তো স্বাভাবিক কিন্তু পুুরনো জীর্ণ ভাঙা স্ত‚পের ভেতর দিয়ে যে আলোকচ্ছটা বেরিয়ে আসে, সে তো অন্য কথা।’ রবীন্দ্রনাথের সেই শিল্পীত সত্যই যেন পরিস্ফুটিত হয় এস এম সুলতানের মতো দক্ষ চিত্রশিল্পীর হাতে। বিশ্ববরেণ্য এই চিত্রশিল্পীর প্রতিটি তুলির টান যেন জীবনের বাস্তবময় প্রতিচ্ছবি। তিনি নিজের দেশকে, জাতিকে টেনে তুলেছেন মহান বিশ্বের শাশ্বত দোলায়। নিজের দেশের দীর্ণ-জীর্ণ-রুগ্ন কৃষককে সুঠাম সাবলীল দেহের অধিকারী করেছেন। গ্রামবাংলার যে নারী অপুষ্টি অনাহারে ভোগে, তার শরীরকে করে তুলেছেন শক্তিশালী, কর্মঠ, বেশ কিছুটা লাবণ্যময়, আর ভরাট পুরু বক্ষের সৌন্দর্যে স্বপ্নকে সত্য করে তোলার চেষ্টা করেছেন। তাঁর প্রকৃতি প্রাণে আনে সঞ্জীবিত ধারা। ‘প্রথম বৃক্ষ রোপণ’, ‘মাছ ধরা, ‘কাপড় ধোয়া’ ‘ধান ভানা ১ ও ২ , ‘জমি কর্ষণে যাত্রা’, ‘গুণ টানা, ‘কর্ম ও জীবন’, ‘গণহত্যা-১৯৭১’, ‘গ্রাম্য পথ’, ইত্যাদি তার চিরন্তন সৃষ্টি। যে মোমবাতি নিজে জ্বলে অন্যকে আলো দেয়, সে মোমবাতিই তো এস এম সুলতান। বহু দেশে বিচিত্র অভিজ্ঞতার ডালি নিয়ে পসরা সাজিয়েছেন যশোর থেকে মাত্র বিশ কি.মি. দূরে চিত্রার পাড় সংলগ্ন নড়াইলের শিশু স্বর্গে। মৃত্যুর পূর্বমুহূর্তে যখন বিদেশে চিকিৎসার জন্য সরকারি সব রকম প্রটোকল পৌঁছাল তার কাছে, তিনি বিনয়ের সাথে বলেছিলেন, ‘নিজের জন্য আমি কিছুই তো চাই না কখনো, যা কিছু চাইবার আমার, তা চাই শুধু শিশু স্বর্গের জন্য।’
শিশুদের জন্য তার অপার ভালোবাসা ছিল। এমন অভাবনীয় মানুষ কিভাবে মরে যেতে পারে, চলে যেতে পারে বহুদূর, তা এক বিস্ময়। যে জীবন আপনি ক্লান্ত ব্যথাতুর অন্য মানুষের জন্য, সে অবশ্যই বেঁচে থাকে হাজারো মানুষের ভেতর। শরীর ক্ষয়ে যায়, কিন্তু চেতনা প্রবাহ ক্রমেই পদ্মার জোয়ার হয়ে ওঠে। যে জীবন শুরু হয়েছিল ১৯২৮ সালের ১০ আগস্ট, ৭১ বছরের ন্যুব্জ দেহ নিয়ে সে জীবন চলে যায় ১৯৯৪ সালের ১০ অক্টোবর। পৃথিবীব্যাপী চারণ করে দেশি ও বিদেশি বহু পুরস্কার পেয়েছেন। কিন্তু একজন প্রকৃত শিল্পী তো পুরস্কারের দাস বা আজ্ঞাবহ নন। তিনি বেঁচে থাকেন তার সৃষ্টির ভেতর। ক্ষণস্থায়ী এ জীবনে অন্যকে কিছুটা আনন্দ দিতে পারা, কিছুটা অপূর্ণতাকে পূর্ণতা দান করতে পারাই শিল্পীর চরম সার্থকতা। শিল্পী নিজে অপূর্ণ, তবু তার সাধ জাগে অন্যকে পূর্ণতা দান করার। আর সে উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই তিনি বীর বিক্রমে এগিয়ে চলেন। শত বাধাও তার সামনে শুকনো তৃণের মতোই উড়ে চলে। গতি তার সমস্ত ধমনি-শিরায়, চোখে ভরাট স্বপ্ন। একদিন যে ঠিক ছিনিয়ে আনবে প্রখর সূর্যকে। সফেদ হাতের ছোঁয়ায় পু®প বিকশিত হবে, পাখি গান গেয়ে উঠবে সুমধুর স্বরে আর টুপটাপ করে বৃষ্টি পড়বে প্রকৃতির স্বচ্ছতায়। এই তো শিল্পী। মহান জাদুকর। প্রহেলিকাময় রহস্য গ্রাস করে সমস্ত বিশ্ব, অনন্ত-ব্রহ্মাÐ। এস এম সুলতানের চিত্রে দেশজ আধুনিকতা, রোমান্টিসিজমের বদলে রিয়ালিস্টিক রূপ, ক্ষয়মান দেহের বদলে পুরু-ভরাট শরীর তাকে নিয়ে যায় মাটি ও মানুষের কর্ষিত হৃদয়ে, একান্ত স্বপ্ন ও সত্যের কাছাকাছি। এস এম সুলতান এক অফুরন্ত নাম, এক অনিন্দ্য অপার বিস্ময়, এক কুয়াশাঘেরা রহস্য। উজ্জ্বল আলো যেখানে ক্রমেই ঘনীভূত হয়ে ওঠে। দু’চোখের তারায় নয়, অন্য কোনো খানে। কেবলই প্রকট থেকে প্রকটতর, কেবলই সুমহান এক অনন্ত যাত্রা। চার দিকে চুপচাপ নিঝুম। জোনাকিরা খেলা করে। নিঃশব্দতার শব্দে ভারী হয়ে ওঠে সমগ্র প্রকৃতি, এই রহস্য ঘেরা অপার অন্ধকারে, কেবলই এক অনন্ত নক্ষত্র পূর্ণতার রূপ পেতে থাকে।
তথ্যসূত্র :
* শিল্পী এস এম সুলতান- আসাদুজ্জামান আসাদ সম্পাদিত
* এস এম সুলতান : কর্ম ও জীবন- আবুল হুসাইন জাহাঙ্গীর
* হারুনুর রশীদ (সেপ্টেম্বর ১৯৯২)। ‘সাক্ষাৎকার : অন্তরঙ্গ আলোকে শিল্পী এস এম সুলতান’। নতুন ঢাকা ডাইজেস্ট । ঢাকা। পৃষ্ঠা ৩৩-৩৮
* সাদেক খান (জুন ২০০৩)। ‘জীবনবৃত্তান্ত’। এস. এম. সুলতান (জুন ২০০৩ সংস্করণ)। ঢাকা : বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি। পৃষ্ঠা ১৩৫।
* সাদেক খান (জুন ২০০৩)। ‘পটুয়া-বাউল শেখ মুহাম্মদ সুলতান’। এস. এম. সুলতান (জুন ২০০৩ সংস্করণ)। ঢাকা : বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি। পৃষ্ঠা : ৩১।
* বাংলাপিডিয়ার নিবন্ধ।
* তারেক মাসুদ (ফেব্রæয়ারি ২০১২)। ‘যেভাবে আদম সুরত’। চলচ্চিত্রযাত্রা। ঢাকা : প্রথমা প্রকাশন। পৃষ্ঠা ১৫।
* ‘এস এম সুলতানের ওপর প্রামাণ্যচিত্র’। দৈনিক প্রথম আলো। ঢাকা। জানুয়ারি ২৭, ২০১০।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।