Inqilab Logo

সোমবার ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৮ আশ্বিন ১৪৩১, ১৯ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরী

চট্টগ্রামে নিত্যনতুন কৌশলে ছিনতাই

প্রকাশের সময় : ১ জুন, ২০১৬, ১২:০০ এএম

রফিকুল ইসলাম সেলিম : উচ্চস্বরে সালাম দিয়ে হঠাৎ মাঝপথে গতি রোধ করে রিকশা যাত্রীর দু’পাশে দাঁড়িয়ে দুই যুবক মুহূর্তে পিস্তল বের করে ঠেকায় যাত্রীর বুকে। কি আছে বের করে দাও না হলে গুলি ছুঁড়ব। প্রাণ বাঁচাতে টাকা-পয়সা মোবাইল ফোন নীরবেই তাদের হাতে তুলে দিতে হচ্ছে।
হাঁটার পথে আকস্মিক কয়েকজন যুবক মামু কেমন আছেন বলে ঘিরে ধরছে পথচারীকে। এরপর অস্ত্র কিংবা ছুরি দেখিয়ে সবকিছু কেড়ে নিচ্ছে। কখনও আবার রিকশা থামিয়ে চালককে মারধর শুরু করছে কয়েকজন যুবক। নিরপরাধ রিকশা চালকের উপর নির্যাতনে বাধা দিতে বন্দুক তাক করা হচ্ছে যাত্রীর দিকে। মুহূর্তের মধ্যে কেড়ে নেয়া হচ্ছে যাত্রীর টাকা-পয়সা।
‘লোকাল’ অটোরিকশা কিংবা টেম্পোতে তুলেও যাত্রীদের সর্বস্ব লুট করা হচ্ছে। আগে থেকেই অটোরিকশায় যাত্রী বেশে বসে থাকে দুই ছিনতাইকারী। একজন যাত্রী উঠার পর কিছুদূর গিয়ে তার গলায় গামছা কিংবা রশি পেঁচিয়ে অথবা চোখে-মুখে মলম লাগিয়ে দিয়ে ছিনতাই করা হচ্ছে। যাত্রীবাহী বাসেও ঘটছে ছিনতাইয়ের ঘটনা। যাত্রীশুদ্ধ রিকশা উল্টে গিয়ে ভয়ঙ্কর কায়দায় কেড়ে নেয়া হচ্ছে টাকা-পয়সা।
চট্টগ্রাম মহানগরীতে এভাবে নিত্যনতুন কৌশলে সমানে ছিনতাই হচ্ছে। একের পর এক কৌশল পাল্টাচ্ছে ছিনতাইকারীরা। পুলিশের হিসেবে মহানগরীর ১৬০টি স্পটে ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে নিয়মিত। এর মধ্যে ২০টি স্পটে রাতে-দিনে ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে। সাম্প্রতিককালে চট্টগ্রাম মহানগরীতে ছিনতাইকারী, মলম পার্টি, সালাম পার্টি, গামছা পার্টি ও টানা পার্টির খপ্পরে পড়ে শিক্ষক, সাংবাদিক, নানা শ্রেণি পেশার মানুষ সর্বস্ব খুইয়েছে।
এসব ছিনতাইয়ের বেশিরভাগ ঘটনায় থানায় মামলা হয় না। কোন কোন ক্ষেত্রে পুলিশ মামলা নিতে চায় না। আবার ভুক্তভোগীরা উল্টো হয়রানির ভয়ে থানায় মামলা করে না। তাছাড়া মামলা করে প্রতিকার মিলেছে এমন ঘটনাও কম। আর এ কারণে ছিনতাইয়ের শিকার লোকজন নীরবেই সবকিছু সয়ে যাচ্ছে। ফলে অধিকাংশ ছিনতাইয়ের ঘটনার কোন রেকর্ড নেই পুলিশের কাছে। পুলিশের তথ্যমতে, এ বছরের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত চার মাসে নগরীতে ছিনতাইয়ের ঘটনায় ৪৮টি মামলা হয়েছে।
ছিনতাইয়ের ঘটনায় সন্ত্রাসীরা গ্রেফতার হলেও ফের জামিনে বের হয়ে যাচ্ছে। জামিন পেয়েই তারা দ্বিগুণ উৎসাহে মাঠে নেমে পড়ছে। কারাগার থেকে বের হয়ে আবার ছিনতাইয়ে জড়িয়ে পড়া বেশ কয়েকজনকে সম্প্রতি গ্রেফতারও করেছে পুলিশ। পেশাদার ছিনতাইকারীর পাশাপাশি গত কয়েক মাসে ছিনতাইয়ের কয়েকটি ঘটনায় গ্রেফতার হয়েছেন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসহ অভিজাত পরিবারের সন্তানেরাও। সর্বশেষ রোববার সকালে নগরীর লাভলেইন মোড়ে ছিনতাইকারীদের কবলে পড়েন চট্টগ্রাম সিটি কলেজের অর্থনীতি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মোঃ হুমায়ুন কবির।
তিনি জানান, কলেজে যাওয়ার জন্য সিআরবির বাসা থেকে রিকশায় উঠেন তিনি। রিকশাটি লাভলেইন মোড় এলাকায় আসতেই দুই ছিনতাইকারী রিকশা থামিয়ে সামনের চাকা ধরে তা উল্টে দেয়। হুমড়ি খেয়ে পড়েন তিনি। আর এ সময় এক ছিনতাইকারী তার মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে তার কাছ থেকে মানিব্যাগ ও মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নেয়। এক মিনিটের মধ্যে ছিনতাই শেষ করার মুহূর্তে একটি অটোরিকশা এসে ওই দুই ছিনতাইকারীকে তুলে নিয়ে যায়। কাজির দেউড়ি মোড় থেকে শুরু করে লাভলেইন পর্যন্ত এলাকায় প্রতিদিনই ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে।
সাধারণত ভোর ও রাতে ছিনতাইয়ের ঘটনা বেশি ঘটলেও এখন দিনদুপুরেও ছিনতাই হচ্ছে। গত ১৯ এপ্রিল দুপুরে নেভাল অ্যাভিনিউ এলাকায় ছিনতাইয়ের শিকার হন দুই সহোদর। এস মাহমুদ তার ছোট ভাইকে নিয়ে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের জুবিলী রোড শাখা থেকে টাকা তুলে রিকশায় করে কাজীর দেউড়ি যাওয়ার পথে কয়েকজন ছিনতাইকারী গতিরোধ করে। অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে ব্যাগভর্তি পাঁচ লাখ টাকা নিয়ে যায় তারা।
গত ২৪ এপিল দুপুরে নগরীর বাদুরতলা এলাকায় একটি রাইডার (যাত্রীবাহী মিনিবাস) থামিয়ে দিদার আলম নামের এক ব্যক্তির কাছ থেকে ১৫ লাখ টাকা ছিনিয়ে নেওয়া হয়।
গত বছরের ১৭ আগস্ট দুপুরে জুবিলী রোডের শাহ আমানত মার্কেটের সামনে ‘কর্ণফুলী এজেন্সি’ নামের টাইলস বিক্রির একটি প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীকে ছুরিকাঘাত করে ১০ লাখ ৮৫ হাজার ৫০০ টাকা ছিনিয়ে নেয় ছিনতাইকারীরা। পুলিশ জানায়, ছিনতাইকারীদের মধ্যে পাঁচজন নগরীর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। তাদের মধ্যে একজন ছাত্রের বাবার মাসিক বেতন চার লাখ টাকা।
নগরীর মুরাদপুরের বাসিন্দা সঞ্জয় মহাজন ১২ মে সন্ধ্যায় রিকশাযোগে বাসায় ফেরার পথে চার-পাঁচজন যুবক তাকে সালাম দিয়ে কথা বলতে চান। পরে তারা অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে মোবাইল ও টাকা নিয়ে চলে যান। বিষয়টি তিনি পুলিশকে জানান, তবে মামলা করেননি। গত ৭ এপ্রিল আন্দরকিল্লা থেকে টাকা নিয়ে চান্দগাঁওয়ের বাসায় ফিরছিলেন রশিদুল হাসান নামের এক ব্যক্তি। আন্দরকিল্লা এলাকায় আট-নয়জন যুবক তাকে ঘিরে ধরেন। ওই যুবকদের একজনের বোনকে তিনি উত্ত্যক্ত করেছেন এমন মিথ্যা অভিযোগ তুলে তাকে মারধর করতে থাকে। পরে তার কাছে থাকা পাঁচ লাখ টাকার ব্যাগ নিয়ে পালিয়ে যান তারা। ১ মে সন্ধ্যায় মুরাদপুর রেলক্রসিং এলাকায় ছিনতাইয়ের শিকার হন প্রবাসী নাসিম আহমেদ।
অনুরূপ ছিনতাইয়ের ঘটনায় সম্প্রতি সর্বস্ব খুঁইয়েছেন বেশ কয়েকজন সাংবাদিক।
একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের জিএম নুরুল ইসলাম পাটোয়ারীর কাছ থেকে অভিনব কায়দায় ছিনতাই করে একদল সন্ত্রাসী। তিনি জানান, নগরীর তিনপোলের মাথা থেকে রিকশাযোগে লালদীঘির পূর্ব পাড় যাচ্ছিলেন তিনি। রিকশাটি নন্দনকানন অপর্নাচরণ স্কুলের কাছে পৌঁছতেই চালক হঠাৎ রিকশা থামিয়ে দেন। এরপর ৩-৪ জন কিশোর এসে রিকশা চালককে মারধর শুরু করে। রিকশায় বসা নুরুল ইসলাম তাদের নিবৃত্ত করতেই একজন তার বুকে পিস্তল ঠেকিয়ে ধরে। অপর একজন গলার কাছে ছুরি ধরে কানে কানে বলে যা আছে দ্রুত বের করে দাও, না হলে শেষ করে দেব। প্রাণভয়ে নিরবে সবকিছু তাদের হাতে তুলে দিয়ে অন্য রিকশায় গন্তব্যে যান এ কর্মকর্তা।
মহানগরীতে টানা পার্টি ও গামছা পার্টির তৎপরতাও বেড়েছে। সম্প্রতি দৈনিক ইনকিলাব চট্টগ্রাম ব্যুরোর স্টাফ রিপোর্টার আইয়ুব আলী এ ধরনের ছিনতাইকারী চক্রের খপ্পরে পড়েন। নগরীর নিউমার্কেটের মোড় থেকে শাহ আমানত সেতু এলাকায় যাওয়ার জন্য একটি অটোরিকশায় উঠে তিনি। আগে থেকেই যাত্রী বেশে দুই ছিনতাইকারী সেখানে বসেছিল। অটোরিকশাটি ফিরিঙ্গিবাজার যেতেই ওই ছিনতাইকারীরা তার গলায় রশি পেচিয়ে টাকা-পয়সা ও মোবাইল ফোন কেড়ে নেয়। এরপর চোখে মলম লাগিয়ে তাকে ফিশারীঘাট এলাকায় রাস্তার পাশে ফেলে যায়। ওই রুটে নিয়মিত এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। একই ধরনের ছিনতাই হচ্ছে নগরীর প্রবেশপথ অক্সিজেন মোড়, কালুরঘাট ও কাট্টলী এলাকায়। গত বৃহস্পতিবার বায়েজিদ বোস্তামী থানার বালুচড়া এলাকায় যাত্রীবেশে ছিনতাইয়ের সময় মলম পার্টির তিন সদস্যকে ধরে পুলিশে দেয় উত্তেজিত জনতা।
প্রায় ছিনতাইয়ের ঘটনায় অপরাধীরা ধরা পড়ছে। তারা আবার জামিনে বের হয়ে যাচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে, ছিনতাইকারীদের থানাভিত্তিক তালিকা নেই। এ কারণে কারা গ্রেফতার হচ্ছে আর কারা জামিনে বেরিয়ে গেছে তার কোন তথ্যও থাকছে না পুলিশের কাছে। ফলে ছিনতাই নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। জানা যায়, ২০১৪ সালে ১০২ জন ছিনতাইকারীর তালিকা প্রস্তুত করে মহানগর পুলিশ। এরপর তালিকাটি আর হালনাগাদ করা হয়নি। ওই তালিকার কতজন গ্রেফতার হয়েছে, কতজন জামিনে আছে, সে তথ্য পুলিশের কাছে নেই।
ছিনতাইয়ের একটি মামলায় আট মাস সাজা খাটার পর গত এপ্রিলে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে ছাড়া পান দুই যুবক। ১৭ মে রাতে একই অপরাধ করতে গিয়ে চট্টগ্রাম নগরীর সিআরবি এলাকায় পুলিশের হাতে আবারও ধরা পড়ে তারা। এর আগে গত ২২ এপ্রিল নগরীর অক্সিজেন এলাকা থেকে ছিনতাইয়ের ঘটনায় গ্রেফতার করা হয় আবদুল খালেক নামের আরও এক যুবককে। কারাগার থেকে জামিনে ছাড়া পেয়ে সে আবারও একই অপরাধে জড়িয়ে পড়ে।
জানা যায়, নগরীর বিভিন্ন এলাকায় পেশাদার অপরাধীদের ছত্রছায়ায় ছিনতাইকারী গ্রুপ গড়ে উঠেছে। এদের বেশিরভাগই বয়সে তরুণ কিংবা কিশোর। ছিনতাইকারীদের বিরাট একটি অংশ মাদকাসক্ত। নেশার টাকা জোগাড় করতেই তারা ছিনতাই, ঝাপটাবাজি করছে। পেশাদার অপরাধীরা মোটা অংকের টাকা ছিনতাই করছে। আর টানা পার্টি এবং গমছা পার্টির সদস্যরা যাকে পাচ্ছে তাকেই তাদের শিকারে পরিণত করছে। এতে করে নগরীতে ছিনতাইকারীদের দৌরাত্ম্য বেড়েই চলেছে। রমজানে এদের তৎপরতা আরও বাড়বে এমন আশংকা সংশ্লিষ্টদের।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: চট্টগ্রামে নিত্যনতুন কৌশলে ছিনতাই
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ