মাত্র ৪৮ ঘণ্টায় দেউলিয়া হলো যুক্তরাষ্ট্রের ২য় বৃহত্তম ব্যাংক
চলতি সপ্তাহের বুধবারও আর দশটি সাধারণ ব্যাংকের মতো বাণিজ্যিক ও আর্থিক লেনদেন সম্পন্ন করেছে যুক্তরাষ্ট্রের সিলিকন ভ্যালি ব্যাংক (এসভিপি), যা দেশটির দ্বিতীয় বৃহত্তম বাণিজ্যিক ব্যাংক
১৯৪৮ সালে আমেরিকান সমাজবিজ্ঞানী রবার্ট কে মের্টোন ‘সেলফ-ফুলফিলিং প্রফেসিস’ তত্ত্বের প্রস্তাব করেন। এই তত্ত্বের ভিত্তিতেই মোদির আরও পাঁচ বছরের শাসনকালকে ভারতের মুসলিম সম্প্রদায় কিভাবে দেখছে, সেটি ভাবতে হবে। মের্টোন লিখেছেন, ‘সেলফ-ফুলফিলিং প্রফেসি তত্ত্ব অনুসারে শুরুতে পরিস্থিতি সম্পর্কে একটা মিথ্যা সংজ্ঞা দেয়া হয়, যেটা নতুন একটা আচরণের জন্ম দেয়, এবং এই আচরণই একসময় ওই মিথ্যা সংজ্ঞাকে সত্যে পরিণত করে।’
মোদির প্রথম দফা প্রধানমন্ত্রীত্বের সময় ভারতীয় মুসলিমদের হিন্দু-বিরোধী এবং ধর্মীয় কট্টরপন্থী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল, যেখানে তাদের কথার স্বপক্ষে কোন প্রমাণ ছিল না। তারা এখন আশঙ্কা করছেন যে, কেউ কেউ হয়তো এখন এমন পথ বেছে নেবে যাতে করে ‘মিথ্যা সংজ্ঞাটি’ বাস্তব হয়ে উঠতে পারে।
এটা হলে সেটা ভারতকে মের্টোনের তত্ত্বের পরবর্তী ধাপে নিয়ে যাবে। তিনি লিখেছেন, ‘এখানে সেলফ-ফুলফিলিং প্রফেসি একবার সত্য হয়ে উঠলে সেখানে একটা ভুলের রাজত্বের পুনরাবৃত্তি হতে থাকবে। সে ক্ষেত্রে এই সংজ্ঞার প্রবক্তারা সত্যিকারের উদাহরণ দিয়ে বলতে থাকবে যে শুরু থেকেই তারা সঠিক ছিল, সামাজিক যৌক্তিকতার এটাই বৈশিষ্ট্য।’
এরপরও ভারতে যে মুহূর্তে ‘ভুলের রাজত্বের’ সময়টা আসতে শুরু করেছে, মুসলিম ভাষ্যকাররা তখনও মুসলিমদের আশা না ছাড়ার আহ্বান জানাচ্ছেন। এটা করতে গিয়ে তারা অবচেতনে স্বীকার করে নিচ্ছেন যে, মুসলিমদের আশা এখন একটা সুতায় ঝুলে আছে মাত্র।
এটা সহজেই বোধগম্য। গত পাঁচ বছরে ৪৪ জন মুসলিমকে গো রক্ষার নামে হত্যা করা হয়েছে, ভিন্ন ধর্মের দম্পতিদের হয়রানি করা হয়েছে, ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের হিন্দু ধর্মে ধর্মান্তরিতকরণের হুমকি দেয়া হয়েছে, মুসলিম শাসকদের বিরুদ্ধে কুৎসা রটিয়ে ইতিহাস বই বিকৃত করা হয়েছে, মুসলিমদের অতীত মুছে ফেলার জন্য শহরের নাম পর্যন্ত বদলে ফেলা হয়েছে। শুধু তাই নয়, ভারতের নাগরিকত্বের সেক্যুলার ভিত্তির সংজ্ঞা পর্যন্ত বদলে দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে, সিটিজেনশিপ অ্যামেন্ডমেন্ট বিলের প্রচেষ্টার মধ্যে যেটা স্পষ্ট হয়ে গেছে। মুসলিমদের বিচ্ছিন্ন করার প্রবণতাটা প্রতি দিনের কর্মকা-ের মধ্যেই ফুটে উঠেছে।
এটা সাধারণ মুসলিমদের ধৈর্যের প্রকাশ যে তারা এখনও প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে আসেনি। সম্ভবত তারা রাষ্ট্রের কারণে চুপ করে ছিল, যেটা ক্রমাগত হিন্দুত্বের দিকে ঝুঁকছে এবং তাদের উপর আরও খড়্গহস্ত হয়ে উঠছে। অথবা তারা হয়তো আশা করেছিল যে, হিন্দুত্ববাদের বিরুদ্ধে যে সব হিন্দু রয়েছেন, তাদের সাথে হয়তো একসাথে হয়ে ২০১৯ সালের নির্বাচনে বিজেপিকে ক্ষমতা থেকে হটিয়ে দিতে পারবে।
মুসলিমদের এই আশা হতাশায় রূপ নিয়েছে শুধু এই কারণে নয় যে মোদি দ্বিতীয় মেয়াদে নির্বাচিত হয়েছেন, বরং যে ব্যবধানে তিনি জিতেছেন, সেই কারণে। তার বিভিন্ন নীতির কারণে জনগণের দুর্ভোগ বাড়ার পরও বিজেপির আসন সংখ্যা বেড়েছে। ২০১৪ সালে এই দলের আসন সংখ্যা ছিল ২৮২, এবার হয়েছে ৩০৩। ভোটের শতাংশ ৩১% থেকে বেড়ে হয়েছে ৩৭.৫%।
সে কারণেই মুসলিমদের আশা এখনও ভবিষ্যতেই আটকে আছে। এই মানসিকতা আরও প্রবল হবে কারণ আগামী কয়েকটি অ্যাসেম্বলি নির্বাচনেও মোদি এবং তার বিজেপি তাদের মেরুকরণ অব্যাহত রাখবে। তাছাড়া মোদির প্রথম মেয়াদের অনেকগুলো তিক্ত ইস্যু অমীমাংসিত রয়ে গেছে এখনও। এর মধ্যে রয়েছে অযোধ্যা বিতর্ক, তিন তালাককে অপরাধ ঘোষণা এবং আসামের ন্যাশনাল রেজিস্টার ফর সিটিজেন্স চূড়ান্তকরণ।
একথা বলার সুযোগ খুব সামান্যই রয়েছে যে, বিজেপির বিশাল জয়ের কারণে সেই সব হিন্দুরা খুশি হয়ে যাবে, যাদের মধ্যে ঐতিহাসিক ও সাম্প্রতিক বিভিন্ন যন্ত্রণা জমে আছে। নির্বাচনের ফল যখন ঘোষণার সময়টাতেও মধ্য প্রদেশ, হরিয়ানা ও বিহারে মুসলিমদের ব্যাপারে হিন্দুদের বর্বর মানসিকতার বহিপ্রকাশ ঘটেছে।
‘মুসলিমরা হিন্দুদের ব্যাপারে অশ্রদ্ধাশীল, তাদের মধ্যে চরমপন্থা রয়েছে এবং তারা প্রকৃতিগতভাবে রাষ্ট্রের প্রতি দায়িত্বজ্ঞানহীন, এবং তারা সহিংসতাপ্রবণ’- এই সব যুক্তিতে ভবিষ্যতে এসব কর্মকা-কে বৈধতা দেয়া হবে, বৈধতা দেয়া হবে অতীতের ঘটনাগুলোকেও। এই সব কর্মকা- মুসলিমদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করবে, এবং তারা তখন এখান থেকে বেরিয়ে আসার পথ খুঁজবে।
মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বহু মুসলিমই এখন বিদেশে চলে যাওয়ার সুযোগ খুঁজবে। মধ্যপ্রাচ্যে যারা কাজ করছেন, সেখানে নাগরিকত্বের সুযোগ না থাকায়, তারা এখন পশ্চিমে কানাডার দিকে যাওয়ার চেষ্টা করবেন। বিজেপির বিজয়ের পর কাঁপন ধরানো সব প্রতিক্রিয়া পাওয়া যাচ্ছে মুসলিমদের মধ্য থেকে, হিন্দুদের বিয়ে করছে, সন্তানের নাম বদলে দেয়া হচ্ছে যাতে কোন মুসলিম নামের চিহ্ন তাতে না থাকে, ইত্যাদি।
এরপরও এই ধরনের প্রতিক্রিয়া সম্মিলিতভাবে মুসলিমদের এক্যবদ্ধ করবে। হিন্দুত্ববাদের আধিপত্য বাড়ার সাথে সাথে নিজেদের প্রাপ্য চাকরি, পদোন্নতি প্রভৃতি ন্যায্য অধিকার পেতে তারা আরও সক্রিয় হতে পারে। তবে তাদের বিরুদ্ধে যে ঘৃণার জন্ম হয়েছে, নিজেদের সন্তানদের কাছে সেটার ব্যাখ্যা করতে গিয়ে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে তাদের।
মুসলিমদের হিন্দু-বিরোধী ও হিন্দু বিদ্বেষী হিসেবে তুলে ধরাটা জাতীয় আন্দোলনের মতোই পুরনো। কিন্তু এই ধরনের বক্তব্য ২০১৪ সালের আগে খুব একটা বড় হয়ে ওঠেনি কারণ জাতীয় নেতারা সবসময় এই ধরনের বক্তব্যকে চ্যালেঞ্জ করে এসেছেন। মহাত্মা গান্ধী এর বিরোধিতা করেছেন, জওহরলাল নেহরুও সরকার প্রধান হিসেবে এর বিরুদ্ধে নীতি গ্রহণ করেছেন। এরপর ধারাবাহিক বেশ কিছু নেতা নেহরুর সেই ঐতিহ্যকে ধরে রেখেছিলেন।
কিন্তু মুসলিমদের সেই ভ্রান্ত সংজ্ঞাটি গত পাঁচ বছরে শক্ত হয়েছে, কারণ ক্ষমতাসীন দলের আশকারা পেয়েছে তারা। সেই কারণে নির্বাচনের পরে ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক অ্যালায়েন্সের এমপিদের উদ্দেশ্যে মোদি যে কথাটা বলেছেন, তাতে মিডিয়া কিছুটা আশ্বস্ত হয়েছে। তিনি বলেছেন, ‘একটা কল্পিত আতঙ্কের মাধ্যমে সংখ্যালঘুদের প্রতারণা করা হয়েছে, যাতে ভোট পেতে সুবিধা হয়। আমাদেরকে এই প্রতারণা থেকে বের হয়ে আসতে হবে, আমাদের আস্থা অর্জন করতে হবে।’
প্রধানমন্ত্রী যেখানে প্রতিটি রাজ্য অ্যাসেম্বলি নির্বাচন ও সাম্প্রতিক লোকসভা নির্বাচনে সাম্প্রদায়িকতা ও মেরুকরণকে ব্যবহার করে আসছেন, সেখানে সহজেই ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের আতঙ্কের বিষয়টি বোঝা যায়। মিথ্যা সংজ্ঞার ভিত্তিতে যে ‘সামাজিক যুক্তি’ তৈরি হয়েছে, মুসলিমরা এখন সেই বাস্তবতার মধ্যে আটকা পড়তে যাচ্ছে। সূত্র : এসএএম ।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।