Inqilab Logo

শুক্রবার ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২০ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ভয়াল ২৯ এপ্রিল আজ

এখনো অরক্ষিত উপকূল

শফিউল আলম | প্রকাশের সময় : ২৯ এপ্রিল, ২০১৯, ১২:০৫ এএম

বঙ্গোপসাগরে নাগিন সাপের ফণা তুলে এ মুহূর্তে উপকূলের দিকে চোখ রাঙাচ্ছে ঘূর্ণিঝড় ‘ফণি’। আর আজ সোমবার প্রলয়-ভয়াল স্মৃতি বিজড়িত সেই ২৯ এপ্রিল। ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল কালরাতে শতাব্দীর প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস বাংলাদেশের সমুদ্র উপকূল চর দ্বীপাঞ্চলে ছোবল হানে।
সর্বনাশা গর্কির আঘাতে দেশের দক্ষিণ, দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলজুড়ে কক্সবাজার থেকে চট্টগ্রাম-নোয়াখালী হয়ে ভোলা পর্যন্ত বিস্তীর্ণ অঞ্চল বিরান ভূমিতে পরিণত হয়। ২৯ এপ্রিল সেই সোমবার রাত ৯ টা থেকে অন্তত ৭/৮ ঘণ্টা যাবৎ প্রতিঘণ্টায় সর্বোচ্চ ২৫০ কিলোমিটার গতিবেগে ঘূর্ণিঝড় এবং সেই সঙ্গে ২৫ ফুট উঁচু জলোচ্ছ্বাস আঘাত হানে।
ভয়াবহ সেই সাইক্লোনে সরকারি হিসাবে নরনারী শিশুবৃদ্ধসহ ১ লাখ ৩৪ হাজার এবং বেসরকারি হিসাব মতে কমপক্ষে ২ লাখ মানুষ অসহায়ভাবে প্রাণ হারায়। আহত হয় দুই লাখেরও বেশি মানুষ। চিরতরে পঙ্গু হয় কয়েক হাজার। দুই লাখ গবাদিপশু ভেসে যায় সাগরে। ১০ লাখেরও বেশি বসতঘর কম-বেশি বিধ্বস্ত হয়। ভয়াল দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত হয় প্রায় ১ কোটি উপক‚লবাসী। রাষ্ট্রীয় সম্পদ ও জনগণের সহায়-সম্বলের আর্থিক ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় কমপক্ষে ৩০ হাজার কোটি টাকা।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞদের মতে, সময়মতো উপরোক্ত ঘূর্ণিঝড়ের সতর্কতা সঙ্কেত প্রদান, ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে বসবাসরত উপকূলবাসীকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেয়া, দুর্যোগের পূর্ব-প্রস্তুতি ও ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি ক্ষেত্রে সার্বিক ব্যর্থতা-অদক্ষতার কারণেই তখন এতো বেশি প্রাণহানি এবং রাষ্ট্রীয় সম্পদের ক্ষতি ঘটেছিল। ২৮ বছর পর আজও সেই প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ের ধ্বংস চিহ্ন রয়ে গেছে উপকূলের অনেক প্রত্যন্ত জায়গায়।
২৯ এপ্রিলের ভয়াল দুর্যোগের আঘাতে দেশের প্রধান চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর, চট্টগ্রাম মহানগরী ও এর সংলগ্ন পতেঙ্গা বিমান বন্দর, বিমান ও নৌঘাঁটি, পতেঙ্গা, হালিশহর, কাট্টলী মৃতপুরীতে পরিণত হয়। বৃহত্তর চট্টগ্রামের আনোয়ারা, বাঁশখালী, স›দ্বীপ, উড়িরচর, সীতাকুন্ড থেকে কক্সবাজার শহরসহ কুতুবদিয়া, মহেশখালী, চকরিয়া, পেকুয়া, ধলঘাট, মাতারবাড়ি, বৃহত্তর নোয়াখালীর প্রধানত হাতিয়া, নিঝুমদ্বীপ, রামগতি, ভোলার চরফ্যাশন, তজুমদ্দিন, লালমোহনসহ দেশের সমগ্র দক্ষিণ, দক্ষিণ-পূর্ব সমুদ্র উপকূল এবং দক্ষিণাঞ্চলের একাংশ ছারখার হয়ে যায়।
মানুষের লাশের মিছিলে গবাদিপশুর মৃতদেহ ভেসে হয় একাকার। পিতা-মাতা হারিয়ে উপকূলজুড়ে অগণিত শিশু-কিশোর এতিম হয়ে পড়ে। স্বচ্ছল গৃহস্থী লক্ষাধিক পরিবার বেঁচে থাকার অবলম্বন হারিয়ে পথের ফকিরে পরিণত হয়।
সেই গর্কিদূর্গত উপকূলজুড়ে মানবিক ত্রাণ ও পুনর্বাসনের জন্য নগদ অর্থসহ দেশি-বিদেশি সাহায্য সহায়তা আসে বানের স্রোতের মতো। চীন, জাপান, মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপীয় বিভিন্ন দেশ, যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকাসহ বহু দেশ-সংস্থা সাহায্য-সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়। তবে হরিলুট-দুর্নীতি, আত্মসাতের কারণে বিদেশি সাহায্যের তেমন সুফল ভাগ্যে জোটেনি উপক‚লীয় জনগণের।
২৯ এপ্রিল’৯১-এর সেই সর্বনাশা ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসে অগণিত আপনজন হারানোর দুঃসহ শোকে আজও চাপাকান্না বয়ে বেড়াচ্ছেন চর, উপকূল, দ্বীপাঞ্চলে প্রায় প্রতিটি বাড়ির মানুষজন। ভয়াল ও বিয়োগান্ত দিনটি স্মরণে আজ বৃহত্তর চট্টগ্রামসহ উপক‚লীয় অঞ্চলে বিভিন্ন সামাজিক, ধর্মীয়, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন-সমিতি কোরআন খানি, দোয়া ও মিলাদ মাহফিল, বিশেষ মোনাজাত, নিহতদের কবর জিয়ারত, ফাতেহা পাঠ, শোকর‌্যালি, আলোচনা সভা ইত্যাদি কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। উপকূলে ওয়ার্ড-ইউনিয়ন, উপজেলা, জেলাওয়ারী এসব কর্মসূচির পালন করা হবে।
‘৯১-র ২৯ এপ্রিল প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসে ধ্বংসযজ্ঞের তিক্ত অভিজ্ঞতায় দুর্যোগ-প্রবণ সমুদ্র উপকূল চর দ্বীপাঞ্চলবাসীর জানমাল রক্ষায় ‘এম মোকাম্মেল হক কমিটি’ ১৭ দফা সুপারিশমালা পেশ করে। যাতে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয় পরিকল্পিত ও টেকসই বেড়িবাঁধ এবং বহুমুখী সাইক্লোন শেল্টার নির্মাণে। এরপর রয়েছে আবহাওয়া সতর্ক সঙ্কেত সহজ করা, দুর্যোগের বিষয়ে গণসচেতনতা সৃষ্টি, এনজিও কার্যক্রমে সমন্বয়, দুর্যোগকালীন খাদ্যশস্য ও গবাদিপশু রক্ষায় ব্যবস্থা ইত্যাদি। অথচ এসব প্রস্তাব ও সুপারিশা গত ২৮ বছর ধরে হিমাগারে পড়ে আছে।
সমুদ্র উপক‚লভাগে অনেক জেলা-উপজেলা, ইউনিয়নের অধিকাংশ স্থানে বেড়িবাঁধ নড়বড়ে। অনেক জায়গায় বাঁধের চিহ্ন মুছে গেছে। ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্রগুলো প্রায় সর্বত্র ভাঙাচোরা, পুরনো-জীর্ণ এবং ভূতের বাসায় পরিণত হয়েছে। তাছাড়া আশ্রয়কেন্দ্র আছে প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠ ফুঁসে উঠছে। এরফলে নিম্নচাপ-ঘূর্ণিঝড়সহ বিভিন্ন দুর্যোগের ঝুঁকি বেড়ে গেছে। বাড়ছে জলবায়ু উদ্বাস্তুর সংখ্যা। উপক‚লবাসীর জীবনধারণ কঠিন হয়ে পড়েছে।
বঙ্গোপসাগর কোলে বিস্তীর্ণ উপক‚লে বসবাসরত সাড়ে ৪ কোটি বাসিন্দার জানমাল রক্ষায় মজবুত বেড়িবাঁধ, সাইক্লোন শেল্টার ও নিরাপদ অবকাঠামো গড়ে উঠেনি। কৃষি-খামার, চিংড়িসহ সামুদ্রিক মৎস্য, লবণ, মুক্তা, প্রবাল, ঝিনুক, খনিজ ও প্রাকৃতিক সম্পদরাজি, সমুদ্র বন্দর এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ অবাকাঠামো দুর্যোগের ঝুঁকিতে রয়েছে। এ অবস্থায় দেশের প্রাকৃতিক ও খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ উপকূল এবং সেখানকার জনগণ আজো অরক্ষিত।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: বঙ্গোপসাগর

১০ ফেব্রুয়ারি, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ