দেশে দেশে রোজার উৎসব
মাহে রমজান আরবী নবম মাসের নাম। চাঁদের আবর্তন দ্বারা যে এক বৎসর গণনা করা হয়,
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
ইসলামী আইনের সাথে ডঞঙ এর ব্যবস্থাপনার মূলনীতির কোন বৈপরত্যি না থাকলে তা প্রতিপালনে কোন আপত্তি নেই। তাছাড়া অঙ্গীকার পালনে ইসলামের নির্দেশনা রয়েছে। মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে বলেছেন: হে ইমানদার গণ! তোমাদের সকল চুক্তি পূর্ণ করো। এছাড়া কুরআনের অনেক আয়াতে এ নির্দেশ এসেছে, যা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, অঙ্গীকার রক্ষা করা প্রতিটি মুসলিমের জন্য আবশ্যক। তাছাড়া মহনবী স. স্বয়ং ব্যক্তিগত কাজকর্ম ও নসিহতের মাধ্যমে ও অঙ্গীকার সংরক্ষণের গুরুত্বরোপ করেছেন। তিনি বলেন: যে আমানাতদারি রক্ষা করে না, তার ঈমান নেই। আর যে প্রতিশ্রæতি রক্ষা করে না, তার কোন ধর্ম নেই। অর্থ্যাৎ একজন মুমিনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল অঙ্গীকার রক্ষা করা। চুক্তির পর্যায়ে নয় এমন প্রতিশ্রæতি ও ঘোষণা ও ইসলামী আইনে অবশ্য পালনীয়। যেমন সূরা মুমিনূনে বলা হয়েছে: এবং যারা আমানত ও অঙ্গীকার সম্পর্কে হুশিয়ার থাকে। অর্থ্যাৎ আমানত ও অঙ্গীকরের ব্যাপারে যারা সচেতন তারাই সত্যিকারের মুমিন ও সফলতা লাভ করবে। একইভাবে সূরা মা’আরিজের ও বলা হয়েছে যে: এবং যারা আমানাত ও অঙ্গীকার রক্ষা করে। আমানত ও অঙ্গীকার রক্ষা করা মুমিনদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। রাসূল স. এর বাণী ও একই নির্দেশনায় অণুপ্রাণিত করেছে। তিনি বলেন: ক্রেতা বিক্রেতা (বেচাকোন শেষ করে) যতক্ষণ না তারা পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়, ততক্ষন তাদের(ভালোমন্দ বিচার করে বেচাকেনা বাতিল করার) ইখতিয়ার থাকে। যদি তারা সত্য কথা বলে এবং বস্তুর বাস্তব অবস্থা বর্ণনা করে, তবেই এ ক্রয়বিক্রয়ে দুজনকেই কল্যাণ দান করা হয়। পক্ষান্তরে যদি তারা মিথ্যা কথা বলে এবং বস্তুর গুণাগুণ গোপন করে, তবে তাদের ক্রয়বিক্রয়ের কল্যাণ নষ্ট হয়ে যায়।
অতএব ব্যবসা বাণিজ্যে অসদুপায় অবলম্বন করলে রহমত ও বরকত দূরীভূত হয়, বিশেষত যখন কোন মিথ্যা বা চুক্তির দ্বারা কোন ব্যবসায়িক পন্যের তথ্য লুকানো হয়। বিক্রয়ের প্রতারণার ব্যাপারে তিনি আরও বলেন: যারা আমাদের ধোঁকা দেয় তারা আমাদের কেউ নয়। ধনাট্য টালবাহনাকারী ব্যক্তি সম্পর্কে নবী স. আরও স্পষ্টভাবে বলেন: ধনী ব্যক্তির ঋণ পরিশোধে টালবাহানা করা যুল্ম (চরম অন্যায়)
উপরোল্লিখিত আয়াত ও হাদীস দ্বারা প্রতীয়মান হয়, প্রতারণা জালিয়াতি এবং অন্যান্য সকল প্রকার শঠতা শরীয়াহ পরিপন্থি এবং ওয়াদা পূরণ করা অপরিহার্য। কেননা ধর্মীয় দৃষ্টিকোন থেকে একজন মুসলিম যেসব বৈষিষ্ঠ্যের ভিত্তিতে মুনাফিক থেকে পৃথক হয় এটি তার অন্যতম। এ অপরিহার্যতা আরও জোরালো হয়, যদি উক্ত প্রতিশ্রæতি কোন কিছুর সংঘটক হয় এবং প্রতিশ্রæতি ব্যক্তি এর উপর ভিত্তি করে কোন কাজে প্রবেশ করেন। এ ক্ষেত্রে যদি উক্ত ওয়াদা পূরণ করা না হয়, তবে প্রতিশ্রæতি গ্রস্থ হবেন। অথচ ক্ষতিগ্রস্থ করা ও নিজে ক্ষতিগ্রস্থ হওয়া ইসলাম সমর্থণ করেনা।
উন্নয়নশীল দেশগুলোকে ডঞঙ চুক্তির ব্যবস্থাপনা খাপ খাইয়ে নিতে এবং তাদের দায়িত্ব ও অঙ্গীকারসমূহ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সময়সীমা বৃদ্ধি করার সাথে ইসলামি আইনের কোন প্রকার বৈপরীত্য নেই, বরং সামঞ্জস্য রয়েছে। এ বিষয়ে রাসূল স. এর কিছু বাণী রয়েছে, যাতে দূর্বলের ঋণের পরিমাণ কমানো বা পাওনা পরিশোধ অক্ষমকে পাওনা পরিশোধ হতে নিস্কৃতি দানে উৎসাহিত করা হয়েছে। যেমন হুযাইফা র. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ স. বলেছেন: তোমাদের পূর্ববর্তী কোনো এক ব্যক্তির রূহের সাথে ফেরেশতারা সাক্ষাত করে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি কোনো কাজ করছো? লোকটি জবাব দিলো, আমি আমার কর্মচারীদেরকে নির্দেশ দিতাম যে, তারা যেন সচ্ছল ব্যক্তিকে (যদি সে ঋণগ্রস্থ হয়) অবকাশ দেয়, (এমনকি সে অব্যাহতি চাইলেও) অব্যাহতি দেয়। রাবী হুযাইফা রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ স. বলেছেন, এ কথা শুনে ফেরেশতারাও তাকে অব্যাহতি দিলেন।
এ মূলনীতি অসচ্ছলদের প্রতি সহযোগিতার উৎসাহ দেয়, যাতে তারা তাদের মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে সক্ষম হয়। অতএব ডঞঙ কর্তৃক অনুন্নত দেশগুলোর জন্য চুক্তির বাধবাধকতা পূরণে নমনীয় আইন প্রণয়নের সাথে ইসলামী মূলনীতি একমত পোষণ করে।
ট্রিপস (ঞজওচং) চুক্তি দ্বারা বিভিন্ন ধরণের মেধাস্বত্ব সুরক্ষিত ও সংরক্ষিত হয়। বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তির বিভিন্ন ধরণের সুরক্ষা শরীয়াহ নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কিনা প্রশ্নে সমকালীন আলিমগণের মধ্যে ব্যাপক আলোচনা পর্যালোচনা অনুষ্ঠিত হয়েছে। ১৯৮৮ সালোর ১৫ ইং ডিসেম্বর কুয়েতে ইসলামী জুরিস্টস কাউন্সিল এর পঞ্চম সভায় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়, উদ্ভাবক বা স্বত্বাধীকারীদের সৃষ্টিকর্ম যথাযথ মূল্যায়নের লক্ষ্যে এ অধিকারসমূহের শরিয়াহ নীতি অনুসারে সংরক্ষিত ও সামঞ্জস্যপূর্ণ। সৌদি আরবের সর্বোচ্চ আলিমদের সংস্থায় কম্পিউটার সংক্রান্ত এক প্রশ্ন উত্থাপিত হয় যে, তা মূল প্রবর্তকের সম্মতি ছাড়া কপি, লেখা, বা বিক্রয় করা যাবে কিনা?। শেখ আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহমান আল জীবরীন তার জারিকৃত ফতোয়ায় উল্লেখ করেছেন, শরীয়ার আইন অনুযায়ী তা নিষিদ্ধ। স¤প্রতি বাংলাদেশ ইসলামিক ল রিসার্চ এন্ড লিগ্যাল এইড সেন্টার প্রকাশিত ইসলামি আইন ও বিচার গবেষণা জার্নালেপ্রকাশিত এক প্রবন্ধে এ বিষয়ে আলিমগণের মতামত উল্লেখ পূর্বক এ সিদ্ধান্ত প্রদান করা হয়েছে যে, মেধাস্বত্ব এক ধরণের সম্পদ। একজন সৃজনশীল ব্যক্তি তার মেধা ব্যয় করে এ সম্পদ অর্জন করেন। অতএব, এর মালিকানা পাওয়ার অধিকার তারই। কেননা এ জাতীয় নিরেটস্বত্ব ফিকহী পরিভাষায় ব্যবহৃত মাল এর পর্যায়ভুক্ত।
ইসলামি মূলনীতিতে বিরোধ নিষ্পত্তি বিষয়ে একটি পরিস্কার রূপরেখা প্রদান করা হয়েছে। এ আইনে প্রথমত বিরোধ সৃষ্টির যাবতীয় উপায় রুদ্ধ করা হয়েছে। দ্বিতীয়ত, কোন কারণে বিরোধ সৃষ্টি হলে তার ন্যায়সঙ্গত নিষ্পত্তির ব্যবস্থা প্রণয়ন করা হয়েছে। ইসলামী নীতিমালা অনুযায়ী বিরোধ নিষ্পত্তির দিক নিম্নরূপ: কোন ব্যক্তি, জাতি বা রাষ্ট্রের পক্ষে অন্যায় সাক্ষ্য প্রদান বা ফয়সালা নিষিদ্ধ। আল্লাহ বলেন: হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহর উদ্দ্যশ্যে ন্যায় সাক্ষ্যদানের ব্যাপারে অবিচল থাকবে এবং কোন স¤প্রদায়ের শত্রæতার কারণে কক্ষনো ন্যায়বিচার পরিত্যাগ করো না। সুবিচার করো, এটাই খোদাভীতির অধিক নিকটবর্র্তী। আল্লাহকে ভয় করো। তোমরা যা করো নিশ্চয়ই আল্লাহ সে বিষয়ে খুব অবগত।
সাক্ষ্য প্রদানের ক্ষেত্রে নিজের বিপক্ষে হলেও তাতে স্থির থাকতে হবে। আল্লাহ তাআলা বলেন, হে ইমানদার গণ! তোমরা ন্যায়ের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকো, আল্লাহর ওয়াস্তে ন্যায়সঙ্গত সাক্ষ্য দান করো, তাতে তোমাদের নিজের বা পিতা মাতার অথবা নিকটবর্তী আত্মীয় স্বজনের যদি ক্ষতি ও হয় তবু। কেউ যদি ধনী কিংবা দরিদ্র হয়, (এটা কখনো দেখবে না, কেননা), তাদের উভয়ের চেয়ে আল্লাহর অধিকার অনেক বেশি। অতএব, তোমরা বিচার করতে যেয়ে রিপুর (মনের ইচ্ছার) কামনা বাসনার অনুসরণ করো না। যদি তোমরা ঘুরিয়ে পেচিয়ে কথা বল কিংবা পাশ কেটে যাও, তবে আল্লাহ তোমাদের যাবতীয় কাজকর্ম সম্পর্কে অবগত।
উভয় পক্ষের সমঝোতাই উত্তম পদ্ধতি হিসেবে গণ্য। যেমন ইরশাদ করা হয়েছে: সন্ধি বা সমঝোতাই উত্তম শরীয়াহ আইনের দৃষ্টিতে বিচার দ্রæত গতিতে সম্পন্ন করাই স্বাভাবিক অবস্থা বা সাধারণ নীতি। বিলম্বিত বিচার প্রক্রিয়া একটি বিকল্প ব্যবস্থা মাত্র। শরীয়তসম্মত কারণ ছাড়া বিচারকার্য বিলম্বিত করা বিচারকের জন্য অনুমোদিত নয়। পূর্বসূরি আলিমগণ, বিশেষত যারা ইসলামী আইন ও বিচার ব্যবস্থা বিষয়ক গ্রন্থাদি রচনা করেছেন বা বিচারব্যবস্থার সাথে সরাসরি সংশ্লিষ্ট ছিলেন তারা বিলম্বিত বিচারে ক্ষেত্র নির্ধারণ করেছেন এবং এ সম্পর্কিত বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। এ থেকে প্রমাণিত হয়, ইসলামি আইনে দ্রæত বিচারই কাম্য।
রাসূল স. এর হাদীস ও তার জীবনী হতে দুই পক্ষের বিরোধ মীমাংসার ক্ষেত্রে সমতার বিধান সংশ্লিষ্ট প্রচুর ঘটনা বিদ্যমান। সাইয়িদুনা উমার রা. বিচারপতি আবু মুসা আল আশআরী রা. এর কাছে বিচার সংক্রান্ত কিছু উপদেশ সম্বলিত একটি ঐতিহাসিক পত্র প্রেরণ করেছিলেন যাতে, উল্লেখ ছিল, বিচারপ্রার্থীরা আপনার উপস্থিতিতে এবং সামনে সমানভাবে অংশগ্রহণ করবে, যাতে একটি সুবিধাভোগী বিচারপ্রার্থী আপনার সরলতা ও অসচেতনতার সুযোগে তার পক্ষে প্ররোচিত করতে না পারে, বা কোন হীন দরিদ্র লোক যেন তার অমঙ্গলের জন্য আপনার অবিচারকে ভয় না করে। অর্থ্যাৎ বিচার মীমাংসা হবে উভয় পক্ষের উপস্থিতিতে, যাতে কোন পক্ষ তার অপর পক্ষের অনুপস্থিতিতে বিচারকে পক্ষপাতদুষ্ট করতে না পারে। একইভাবে এমন আচরণ না করা, যার ফলে বিচার প্রার্থীরা বিচার প্রার্থনায় অনীহা পোষণ করতে পারে।
উপরিউক্ত আলোচনা থেকে স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার নীতিমালা থেকে আলোচিত সাতটি মৌলিক নীতির সাথে তাত্তি¡ক দৃষ্টিকোণ থেকে ইসলামি আইনের দৃশ্যমান কোন বিরোধ নেই। তবে প্রায়োগিক ক্ষেত্র ও গৌণ বিষয়ে বিরোধ থাকা অস্বাভাবিক কাজ। উপরন্ত, মানব রচিত আইন হিসেবে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার মূলনীতিতে অপূর্ণতা এবং আল্লাহ প্রদত্ত আইন হিসেবে শরীয়াহর মূলনীতির পূর্ণতা স্বীকৃত।
অতএব প্রমাণিত হলো যে, ডঞঙ চুক্তির অন্তর্ভুক্ত মূলনীতি ও অঙ্গীকারসমূহ শরীআহ মূলনীতির সাথে সামঞ্জস্য পূর্ণ। এর মূলনীতির আলোকে প্রণীত বিধিবিধান ও প্রয়োগ করা হচ্ছে না বিভিন্ন সমস্যার অজুহাতে, মূলত এর বিধি বিধান বাস্তবায়নের রয়েছে সদিচ্ছার অভাব। প্রণীত বিধান কাগজে কলমে সীমাবদ্ধ না রেখে বাস্তবায়ন করা উচিত। অন্যথায় পূর্ববর্তী সংস্থা এঅঞঞ এর মতো ডঞঙ অকার্যকর হয়ে পড়বে। উন্নয়নশীল দেশসহ সকল সদস্য দেশগুলোর অর্থনৈতিক উন্নয়নে এর মূলনীতির আলোকে বিরোধ নিষ্পত্তির ব্যবস্থাপনায় বিধি প্রণয়ন ইসলামী মূলনীতি অনুমোদন করে। (সমাপ্ত)
লেখকঃ পাঠানপাড়া (খান বাড়ি), কদমতলী, সদর, সিলেট-৩১১১।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।