Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সড়কে প্রাণহানি বাড়ছেই

বেপরোয়া গতি ও চালকদের প্রতিযোগিতা

আবদুল্লাহ আল মামুন | প্রকাশের সময় : ১৩ এপ্রিল, ২০১৯, ১২:০৪ এএম

সড়কে বিরতিহীনভাবে মৃত্যুর ঘটনা ঘটেই চলছে। এমন একটি দিনও পার করা যাচ্ছে না যেদিন দুর্ঘটনা বা প্রাণহানি ঘটছে না। অথচ মৃত্যু ও দুর্ঘটনারোধে সরকার ও সড়ক সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের কার্যকর কোন পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না। গুটি কয়েক পদক্ষেপ নিলেও ঢিলেমি আর দীর্ঘসূত্রিতায় তাতে কার্যকর কোন সাফল্য আসেনি। যার কারণে প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনা ঘটেই চলছে। গত ১২ দিনে সড়ক দুর্ঘটনায় সারাদেশে শ’খানিক মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। এর মধ্যে গতকালই নারী শিশুসহ মারা গেছে অন্তত ১১ জন। এছাড়া গত তিন মাসে ঢাকাসহ সারাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় ১ হাজার ২১২ জনের মৃত্যু ঘটে। গত বছর সড়কে প্রাণহানির সংখ্যা ছিল ৭ হাজারের বেশি।
আন্দোলনকারী ও সড়ক সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো, চালকের পরিবর্তে হেলপার দিয়ে গাড়ি চালানো, আগে যাওয়ার প্রতিযোগিতা, পরিবহন সেক্টরের অনিয়ম-দুর্নীতি, দোষী চালক-মালিক ও পরিবহন মোঘলদের শাস্তি না হওয়া এবং জনসচেতনার অভাব সড়ক দুর্ঘটনার বড় কারণ। এছাড়া প্রভাবশালীদের হাতে পরিবহন সেক্টর কুক্ষিগত থাকায় কোনভাবেই সড়কে প্রাণহানি বন্ধ ও শৃঙ্খলা ফেরানো যাচ্ছে না। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আইনের যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে অভিযুক্ত চালক-মালিকদের শাস্তির আওতায় আনাসহ পরিবহন সেক্টরের দুর্বৃত্তায়ন বন্ধ করতে হবে। একইসাথে স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীগুলোকে চিহ্নিত করে তদারকি ও আইনের আওতায় আনা গেলে সড়ক দুর্ঘটনা কমবে এবং সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানো সম্ভব হবে।
বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু ও আহতের সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই। সড়ক আন্দোলন নিয়ে কাজ করা সংস্থাগুলোর সংস্থাগুলোর তথ্যমতে, চলতি মাসের গত ১২ দিনে সড়ক দুর্ঘটনায় অন্তত শ’খানিক মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। শুধু গতকালই মারা গেছে অন্তত ১১ জন। প্রতিদিন গড়ে অন্তত ১০ মানুষের প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে।
গতকাল জয়পুরহাট সদর উপজেলার বানিয়াপাড়া এলাকায় যাত্রীবাহী একটি বাস নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে খাদে পড়ে গেলে শিশু-নারীসহ ৮ জন নিহত হয়েছেন। এ ঘটনায় অন্তত ২৮ জন আহত হয়েছেন। দুপুরে বগুড়া থেকে ছেড়ে আসা এমপি পরিবহনের একটি বাস জয়পুরহাটের দিকে যাওয়ার পথে জয়পুরহাট-বগুড়া সড়কের বানিয়াপাড়া এলাকা এ দুর্ঘটনা ঘটে। গতকাল ভোরে নারায়ণগঞ্জের বন্দর এলাকায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে কাভার্ড ভ্যানের চাপায় হাইওয়ে পুলিশের এসআই ফরিদ আহমেদ নিহত হয়েছেন। দায়িত্ব পালনকালে পেছন থেকে আসা কাভার্ড ভ্যানটি তাকে চাপা দিলে ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়। গতকাল বেলা পৌনে ১১টার দিকে মেহেরপুরের গাংনী উপজেলার হাড়িয়াদহ গ্রামে ট্রাকচাপায় সিদ্দিক হোসেন (৬০) নামে এক কৃষক নিহত হয়েছেন। ট্রাকটি হেলপার চালানোর কারণে এ দুর্ঘটনা ঘটে বলে স্থানীয়রা জানান। হবিগঞ্জের শায়েস্তাগঞ্জে ট্রাকের চাপায় আরফাজ আলী (৬০) নামের এক ব্যবসায়ী নিহত হয়েছেন। দুপুরে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে শায়েস্তাগঞ্জ থেকে সুতাংগামী একটি সিএনজি অটোরিকশাকে বেপরোয়া গতির একটি ট্রাক ধাক্কা দিলে অটোরিকশাটি দুমড়ে মুচড়ে পার্শ্ববর্তী খাদে পড়ে যায়। গুরুতর আহত অন্য যাত্রীদের হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এর আগে গত ৬ এপ্রিল গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে চালকের পরিবর্তে হেলাপার গাড়ি চালানোয় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে মহাসড়কের পাশে পড়ে গিয়ে ৬ জন নিহত হন। গাড়িটি ধুমড়ে মুচড়ে উপরের অংশ পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
নৌ, সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটির তথ্যমতে- জানুয়ারি থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত তিন মাসে ১ হাজার ১৬৮টি সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ১ হাজার ২১২ জন। রোড সেইফটি ফাউন্ডেশনের তথ্যমতে, গত তিনমাসে সারাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারায় ১ হাজার ১৬৩ জন।
দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি ঘটলেও সরকারসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের টনক নড়ছে না। তারা এতদিনেও কার্যকর কোন পদক্ষেপ নেয়নি। গুটি কয়েক পদক্ষেপ নিলেও ঢিলেমি ও দীর্ঘসূত্রিতার কারণে সেগুলোতে আশানুরূপ কোন সফলতা আসেনি।
নৌ, সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটির তথ্যমতে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে ১ হাজার ১৬৮টি। এতে প্রাণ হারিয়েছেন ১ হাজার ২১২ জন। সড়কে অব্যবস্থাপনাকেই এসব দুর্ঘটনার জন্য দায়ী করা হয়েছে সংগঠনটির পক্ষ থেকে।
সংস্থাটির তথ্যমতে, গত তিন মাসে ১ হাজার ১৬৮টি সড়ক দুর্ঘটনায় ১ হাজার ২১২ জন নিহত এবং ২ হাজার ৪২৯ জন আহত হয়েছেন। নিহত ব্যক্তিদের তালিকায় ১৫৭ জন নারী ও ২১৫ শিশু রয়েছে। তাদের তথ্যমতে, এসব দুর্ঘটনার মধ্যে সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ঘটেছে ফেব্রুয়ারি মাসে। ওই মাসে ৪০১টি দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৪১৫ জন এবং আহত ৮৮৪ জন। এ ছাড়া জানুয়ারি মাসে ৩৮৩টি দুর্ঘটনায় ৪১১ জন নিহত হন এবং আহত হয়েছেন ৭২৫ জন। এছাড়া গত মার্চ মাসে ৩৮৪টি দুর্ঘটনায় ৩৮৬ জন নিহত ও ৮২০ জন আহত হয়েছেন।
নৌ, সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটি সড়ক দুর্ঘটনার জন্য ১০টি কারণ চিহ্নিত করেছে। এর মধ্যে- চালকদের প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব ও বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো, দিনভিত্তিক চুক্তিতে চালক-কন্ডাক্টর অথবা হেল্পারের কাছে গাড়ি ভাড়া দেয়া, অদক্ষ ও লাইসেন্সবিহীন চালক নিয়োগ, সড়কে চলাচলে পথচারীদের অসতর্কতা, বিধি লঙ্ঘন করে ওভারলোডিং ও ওভারটেকিং, দীর্ঘক্ষণ বিরামহীনভাবে গাড়ি চালানো, ত্রুটিপূর্ণ গাড়ি চলাচল বন্ধে আইনের যথাযথ প্রয়োগের অভাব, জনবহুল এলাকাসহ দূরপাল্লার সড়কে ট্রাফিক আইন যথাযথভাবে অনুসরণ না করা, সড়ক-মহাসড়কে মোটরসাইকেলসহ তিন চাকার যানবাহন চলাচল বৃদ্ধি এবং স্থানীয়ভাবে তৈরি ইঞ্জিনচালিত ক্ষুদ্রযান তথা নসিমন-করিমনে যাত্রী ও পণ্য পরিবহন।
সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক আশীষ কুমার দে বলেন, সড়ক দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি দিনদিন বাড়ছে। শুধু আইন দিয়ে নয়, সড়কে দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি হ্রাসে জাতীয় জাগরণ দৃষ্টি করতে হবে। এ ছাড়া সড়কের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে নৌ ও রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা সম্প্রসারিত ও আধুনিকায়ন করতে মত দেন তিনি।
নিরাপদ সড়ক চাইয়ের (নিসচা) তথ্যানুসারে, ২০১৮ সালে ৩ হাজার ১০৩টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৪ হাজার ৪৩৯ জন নিহত হয়েছেন। আর এসব ঘটনায় আহত হয়েছেন ৭ হাজার ৪২৫ জন। নিহতদের মধ্যে গাড়ি চাপায় ১ হাজার ৩৮৫ জন, মুখোমুখি সংঘর্ষে ৫৮৫ জন, উল্টে গিয়ে ২৫৩ জন, খাদে পড়ে ১৩৩ জন এবং অন্যান্যভাবে ৬৬৩ জন নিহত হয়েছেন। দুর্ঘটনা কবলিত পরিবহনের মধ্যে রয়েছে- ৮৭৯টি বাস, ৭৯৩টি ট্রাক, ৬৩৪টি মোটরসাইকেল, কাভার্ডভ্যান ১১৯টি, মাইক্রোবাস ৬৭টি, নসিমন ৫০টি, প্রাইভেটকার ৪৭টি ও মাহেন্দ্র ৩৮টি। নিসচার পরিসংখ্যান মতে ২০১৬ সালে ২ হাজার ৩১৬টি দুর্ঘটনায় ৩ হাজার ১৫২ জন ও ২০১৭ সালে ৩ হাজার ৩৪৯টি দুর্ঘটনায় ৫ হাজার ৬৪৫ জন মানুষের প্রাণহানি ঘটে।
এদিকে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির তথ্যানুসারে, গত বছর ৫ হাজার ৫১৪টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৭ হাজার ২২১ জনের মৃত্যু হয়েছে। ২০১৮ সালে সড়ক দুর্ঘটনা বাড়লেও হতাহতের সংখ্যা আগের বছরের তুলনায় কিছুটা কম ছিল। ২০১৭ সালে বাংলাদেশে ৪ হাজার ৯৭৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৭ হাজার ৩৯৭ জনের মৃত্যু হয়েছিল। আহত হয়েছিলেন ১৬ হাজার ১৯৩ জন। অন্যদিকে গত বছর সড়ক-রেল-নৌপথ ও আকাশপথে দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ৭ হাজার ৭৯৬ জন। এসব দুর্ঘটনায় আরও ১৫ হাজার ৯৮০ জন আহত হয়।
নিসচার চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, দুর্ঘটনার সাথে জড়িত চালক-মালিকদের শাস্তির আওতায় না আনা এবং জনগণের অসচেতনতা দুর্ঘটনার জন্য অন্যতম দায়ী। তিনি আইনের যথাযত প্রয়োগ এবং পরিবহন সংশ্লিষ্টদের নিয়মিত তদারকির পাশাপাশি অসচেতন নাগররিকদের লঘু দন্ডের বিধানের কথা বলেন।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, সড়ক দুর্ঘটনায় অন্তত ১১৫টি কারণ জড়িত। এর মধ্যে পাঁচটি বড় কারণ হল-দক্ষ চালকের অভাব, ফিটনেসবিহীন যানবাহন, বেপরোয়া গতি, সড়কের বেহাল দশা ও আইনের অপপ্রয়োগ।
তিনি বলেন, সরকার যাত্রীবান্ধব উদ্যোগ না নিয়ে পরিবহন মালিক ও শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষা করে চলে। যার কারণে তারা অপরাধ করলেও শাস্তির মুখোমুখি হতে হচ্ছে না। তার মতে, দুর্ঘটনা রোধে এ পাঁচটির সমাধান হলে সড়ক দুর্ঘটনা একটা সহনীয় পর্যায়ে চলে আসবে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, সড়ক সংক্রান্ত পরিকল্পনায় গলদ রয়েছে। সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে হাজার হাজার কোটি টাকার প্রকল্প গ্রহন করা হলেও তাকে কার্যকর কোন সফলতা আসেনি। এছাড়া বিভিন্ন সংগঠন ও সংস্থার দেওয়া প্রস্তাব ও সুপারিশ বাস্তবায়নে ঢিলেমি ও দীর্ঘসূত্রিতার কারণে সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানো যাচ্ছে না।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: দুর্ঘটনা


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ