Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

অস্থির নারায়ণগঞ্জ : সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়তে যাচ্ছে নারায়ণগঞ্জ পুলিশ ও ব্যবসায়ী সমাজ

স্টাফ রিপোর্টার নারায়ণগঞ্জ থেকে | প্রকাশের সময় : ৫ এপ্রিল, ২০১৯, ৭:২৯ পিএম

নারায়ণগঞ্জবাসী দীর্ঘদিন পর আরো একবার শংকিত, আতংকিত! জনমনে প্রশ্ন একটাই, হঠাৎ করে কেন পুলিশ সুপারের এই মহড়া? একি শুধু হকার উচ্ছেদ, শহরের সার্বিক নিরাপত্তা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ নাকি এর আড়ালে ঘটতে যাচ্ছে অন্যকিছু। গত বছরের ১৬ই জানুয়ারী মেয়র আইভী ও প্রভাবশালী সাংসদ শামীম ওসমান এবং তাদের সমর্থকদের মধ্যকার সংঘর্র্ষের পর বছর খানেক যাবৎ স্বস্তিতেই দিন কাটাচ্ছে জেলাবাসী। তবে হঠাৎ করেই বিশাল গাড়ি বহর নিয়ে এসপি হারুনের শহরময় প্রদক্ষিণের বিষয়টি জেলাজুড়ে নতুন করে আতংকের সৃষ্টি করেছে। আকস্মিক এই মহড়াকে আড়চোখেই দেখছেন সামাজিক ও রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল। তাদের মতে, পুলিশ সুপারের এই মহড়া হকার উচ্ছেদ বা নিরাপত্তাজনিত বিষয়ে না। বরং ব্যবসায়ীদের দেয়া ২৪ ঘন্টার আল্টিমেটামকে পাত্তা না দিতে এবং পুলিশ প্রশাসনের শক্তির জানান দিতেই এসপি হারুনের এই মহড়া। রাজণৈতিক বিশে¬ষক মহলের মতে, সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়তে যাচ্ছে নারায়ণগঞ্জ পুলিশ ও ব্যবসায়ী সমাজ। তবে কোন অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটলে এর দায়ভার নিতে হবে পুলিশ প্রশাসনকেই, কেননা পুলিশের কাজই হলো জনগনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। সেখানে খোদ জেলা পুলিশ সুপার ব্যবসায়ীদের সাথে দ্বন্দে জড়াচ্ছেন বলে মনে করেন এই রাজনৈতিক বোদ্ধারা।
জানা যায়, চেম্বার অব কমার্সের ৩ বারের পরিচালক, ঐতিহ্যবাহী নারায়ণগঞ্জ ক্লাবের ২ বারের সভাপতি, জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক, ঢাকা বিভাগীয় ক্রীড়া সংস্থার সহ-সভাপতি ও নারায়ণগঞ্জের সকল অঙ্গনে সজ্জন ব্যক্তি হিসাবে পরিচিত তানভীর আহমেদ টিটু মাদক ব্যবসার সাথে জড়িত জেলা পুলিশের এমন বক্তব্যের পর জাতীয় ৯টি এবং জেলার ৩৪টি ব্যবসায়ী সংগঠনের ব্যবসায়ীরা একাট্টা হয়ে পুলিশ সুপারকে এ ঘটনার জন্য জনসমক্ষে ক্ষমা চাইতে এবং এ ধরনের বক্তব্য তুলে নিতে আল্টিমেটাম দেয়। এই আল্টিমেটামের ২৪ ঘন্টা না পেরোতেই প্রতিবাদ সভার আয়োজন করে ৪৩টি ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতৃবৃন্দরা। একই সময়ে বিশাল গাড়ী বহর, সাজোয়া যান ও জলকামান নিয়ে শহরময় মহড়া দেয় পুলিশ সুপার মোহাম্মদ হারুন অর রশিদ। আর এই মহড়াকে ঘিরেই জনমনে সৃষ্টি হয়েছে নানা প্রশ্নের। কেউ কেউ বলছেন, হঠাৎ করেই পুলিশ সুপার এতো পুলিশ সদস্য নিয়ে রাস্তায় বের হলেন কেন? এর পেছনের কারণ কি?
চাষাড়াস্থ একটি বিপনী মার্কেটের দোকানদার আজিম মিয়া বলেন, আমরা তো একেবারেই আতংকিত হয়ে পড়েছিলাম, কি হলো শহরে আবার? হঠাৎ করে এতো পুলিশ একসাথে কেন? তিনি আরো জানান, পুলিশ সুপারের এই মহড়ার পর শহর একেবারে ফাকা হয়ে যায়, আমাদের ব্যবসা বাণিজ্যও সাময়িকভাবে কিছুটা লোকসানের মুখে পড়েছিল। কারণ মানুষজন ভয়ে যার যার নিজ বাড়ির দিকে ছুটতে ছিলো।
দুই সন্তানের জনক, ফুটপাতের হকার মকবুল মিয়া এ প্রতিবেদককে জানায়, ভাই আমরা রাস্তায় বইয়া জামাকাপড় বিক্রি করে সংসার চালাই। ছেলে-মেয়ের জন্য দুইবেলা ভাতের ব্যবস্থা করি। আমাগো উডানোর লাইগা এসপি স্যার এতো পুলিশ লইয়া আইছিলো এইডা হুইনা দোকানপাট বন্ধ কইরা দুরে চইলা গেছিলাম। এহন স্যার গেছে গা, আবার দোকান লাগাইছি। দোকান না লাগাইলে খামু কেমনে। আর আমাগো উডাইতে কি এতো পুলিশ স্যারগো আহন লাগেনি। আমরা তো এমনেই পুলিশ স্যারগো দেখলেই দৌড় দেই। তয় হুনছি, অনেকে কইতাছে আমাগো উডানোর লাইগা না, অন্য কোন কারণে বলে এসপি স্যার রাস্তা দিয়া হাটছে? কোন কারণ তা জানতে চাইলে মকবুল মিয়া বলেন, ভাই আপনেরাই তো ভালো জানেন, আমরা তো জানি না। তয় মাইনষে কয় বড় বড় ব্যবসায়ীরা ২৪ ঘন্টার কি জানি দিছে, এই লাইগা এসপি স্যার হেরা রাস্তায় নামছে।
রাজণৈতিক বিশে¬ষক মহলের মতে, মোহাম্মদ হারুন অর রশিদ গেল বছরের ৪ ডিসেম্বর নারায়ণগঞ্জে পুলিশ সুপার পদে যোগদানের পর থেকে মাত্র চার মাসেই নানা বিষয়ে আলোচনা-সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছেন। এর আগেও গাজীপুরে পুলিশ সুপার পদে থাকা অবস্থায় ২০১৬ সালে ইউপি নির্বাচনের তৃতীয় দফায় নির্বাচন কমিশনের নির্দেশনা অনুযায়ী ওই বছরের ২১ এপ্রিল এসপি হারুন অর রশীদকে গাজীপুর থেকে প্রত্যাহার করা হয়েছিল।
নারায়ণগঞ্জে পুলিশ সুপার পদে যোগদানের পর মাদক, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজী বন্ধ করা, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন এবং সর্বোপরি জেলার সার্বিক নিরাপত্তা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার ক্ষেত্রে আলোচিত হয়েছেন বারবার। সম্প্রতি, নারায়ণগঞ্জ প্রশাসনের সর্বোচ্চ নীতি-নির্ধারণী ফোরাম জেলা আইন-শৃঙ্খলা কমিটির সভায় পুলিশ সুপার হারুনুর রশীদ বলেন, ‘উপজেলা নির্বাচনকে ঘিরে কেউ সংসদ নির্বাচন করে যাবেন সেটি ভুলে যান’। তার এই ধরনের বক্তব্যকে “বিতর্কিত” বলে অভিহিত করেছিলেন নারায়ণগঞ্জ-১ আসনের সাংসদ, পাট ও বস্ত্র মন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী বীর প্রতীক। এসপির এই বিতর্কিত বক্তব্যের বিরুদ্ধে তীব্র ক্ষোভও প্রকাশ করেছিলেন তিনি।
এছাড়াও এসপি হারুন বলেছিলেন, ‘নৌপথে চাঁদাবাজি রোধ করার জন্য এক মন্ত্রীর সঙ্গে আমার ঝগড়া করতে হয়েছে।’ এমন মন্তব্য করেও বিতর্কিত হন পুলিশ সুপার হারুন অর রশিদ।
তার এহেন মন্তব্যের বিষয়ে পাট ও বস্ত্রমন্ত্রী আবারো ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছিলেন, বিআইডবি¬টিএ’র টেন্ডার না হওয়ায় তাদের নিজেদের (সরকারী) লোকজন খাস কালেকশন করছিলো। তখন পুলিশ সরকারী লোকদের গ্রেফতার করলে সরকারের পক্ষ থেকে আমাকে প্রশ্ন করা হলে আমি এসপিকে জিজ্ঞেস করি খাস টোল আদায়ের সময় সরকারী লোক ধরেছেন কেন? আমার সঙ্গে তার কোন ঝগড়া হয়নি। পুলিশ সুপার এমন বক্তব্য দিয়ে থাকলে ঠিক করেন নি। শুধু তাই নয়, ওয়ারেন্ট অব প্রেসিডেন্সি বা পদমর্যাদা অনুসারে মন্ত্রী-এমপিদের নিয়ে একজন পুলিশ সুপার কোনো ফোরামে ঢালাওভাবে মন্তব্য করতে পারেন না বলেও জানান মন্ত্রী।
এছাড়াও সম্প্রতি মেরি আন্ডারসন থেকে মদ-বিয়ার সহ বিভিন্ন ধরনের মাদকের সাথে ৬৮ জনকে গ্রেফতারের ঘটনায় প্রভাবশালী সাংসদ একেএম শামীম ওসমানের শ্যালক, বিশিষ্ট ব্যবসায়ী, ক্রীড়ানুরাগী ও সর্বত্র সজ্জন ব্যক্তি হিসাবে পরিচিত তানভীর আহমেদ টিটুকে জড়িয়ে বিভ্রান্তিকর তথ্য পরিবেশন করে আবারো বিতর্কিত কর্মকান্ডের সৃষ্টি দিয়েছেন বলে মনে করছে নারায়ণগঞ্জের ব্যবসায়ী সমাজ ও ক্রীড়াঙ্গনের সঙ্গে সংশি¬ষ্ট ব্যক্তিরা।রাজণৈতিক পর্যবেক্ষক মহলের মতে, সবশেষ শহরময় এসপির মহড়া বর্তমানে আলোচনা-সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দু। শহরের প্রতিটি অলিতে গলিতে, চা দোকান থেকে শুরু করে সর্বত্র একটাই গুঞ্জন কি প্রমাণ করতে চেয়েছেন পুলিশ সুপার হারুন অর রশীদ। যদিও পুলিশ সুপার তার মহড়া শেষে সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের জানান, এটা তার রুটিন পরিদর্শনের অংশ। তিনি মাঝে মাঝেই এভাবে শহর পরিদর্শন করে থাকেন। তবে পুলিশ সুপারের মহড়ার কারণে সাধারণ জনগনের মাঝে যে আতংকের সৃষ্টি হয়েছে তা সহসাই কাটছে না বলে মনে করেন রাজণৈতিক পর্যবেক্ষক মহল।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ