Inqilab Logo

বুধবার ২০ নভেম্বর ২০২৪, ০৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জরুরি এক্সিট বন্ধ

এফ আর টাওয়ারের অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র অকার্যকর

আবদুল্লাহ আল মামুন | প্রকাশের সময় : ৩১ মার্চ, ২০১৯, ১২:০৩ এএম | আপডেট : ১২:২৮ এএম, ৩১ মার্চ, ২০১৯

রাজধানীর বনানীর এফ আর টাওয়ারে ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের পর গতকাল তৃতীয় দিনেও ভবনটি ঘিরে ভিড় ছিল উৎসুক জনতার। সবাই নিজের চোখে দুর্ঘটনাস্থল দেখতে ভবনের সামনে এসে হাজির হয়েছেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তদন্ত দলসহ আগুনের ঘটনায় গঠিত আরো কয়েকটি তদন্ত দল দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শন ও প্রাথমিক তদন্ত করেন। অগ্নিনির্বাপন যন্ত্র অকার্যকর ও ইমারজেন্সি এক্সিট বা জরুরি বহির্গমন পথ বন্ধ ছিল বলে জানায়। অগ্নিকান্ড ও নিহতের ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে বনানী থানায় একটি মামলা করেছে।
এদিকে, আগুনের ঘটনায় গতকাল চিকিৎসাধীন আরও একজনের মৃত্যু হয়েছে। ভবনটির ২১ তলা থেকে লাফিয়ে পড়ে আহত রেজোয়ানের এখনো শঙ্কামুক্ত নয়। বিভিন্ন হাসপাতালে এখনো ৩৩ জন চিকিৎসাধীন রয়েছেন। অন্যরা চিকিৎসা শেষে বাড়ি ফিরে গেছেন। এছাড়া আগুনের ঘটনায় ভবনটির পাশে পুলিশের অস্থায়ী কন্ট্রোল রুমের সামনে গণশুনানি হবে বলে জানা গেছে।
গতকাল সরেজমিনে দেখা যায়, ভবনটির সামনে উৎসুক জনতার ভিড়। রাজধানী ছাড়াও আশপাশের জেলা থেকে অনেকে এসেছেন দুর্ঘটনাকবলিত ভবনটি দেখতে। সবার মুখেই কেবল হতাশার সুর। কবে বন্ধ হবে এমন হত্যাকান্ড। কবে সতর্ক হবে রাষ্ট্র ও ভবন মালিকেরা।
আলী আহমেদ নামে ব্যবসায়ী বলেন, গাজীপুর থেকে দুর্ঘটনাকবলিত ভবনটি দেখতে এসেছেন। আগুনের খবর শোনার পর থেকে এখন পযন্ত স্বাভাবিক হতে পারছেন না। অনেক মানুষের প্রাণহানি। জীবন বাাঁচাতে এত উচু থেকে লাফ দেওয়ার বিষয়টি তাকে বেশি কষ্ট দিয়েছে। তিনি বলেন, এত বড় ভবন নির্মাণে এমন অনিয়ম কিভাবে হলো সেটি ক্ষতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
সরেজমিনকালে দেখা গেছে, ভবনটির ভেতরের উৎকুট পোড়া আর ধোয়ার গন্ধ। চারপাশে পুলিশ ঘিরে রেখেছে। আশপাশের এলাকায়ও ছিল পোড়া গন্ধ। গতকাল পর্যন্ত পানি ও বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন ছিল। কবে থেকে ভবনটি ব্যবহারের জন্য হস্তান্তর করা হবে সেটি জানানো হয়নি। তদন্ত শেষে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে সংশ্লিষ্টরা জানান।
পুলিশের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ভাষ্য, তদন্ত শেষ না হওয়া এবং মালিক পক্ষকে বুঝিয়ে দেওয়ার আগ পর্যন্ত তাদেরকে নিরাপত্তায় থাকতে হবে। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নিদের্শ পেলেই তারা চলে যাবেন। কর্মকর্তারা বলেন, সবসময় মানুষের ভিড় থাকে। পাহাড়ায় না থাকলে যে কেউ ঢুকে কোন কিছু নিয়ে যেতে পারে।
অগ্নিনির্বাপন যন্ত্র অকার্যকর ও জরুরি এক্সিট বন্ধ
বনানীর এফ আর টাওয়ারের অগ্নিনির্বাপন যন্ত্র অকার্যকর ছিল বলে জানিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তদন্ত দল। এছাড়া ভবনটিতে যে একটি ইমারজেন্সি এক্সিট বা জরুরি বহির্গমন পথ আছে সেটিও ছিল বন্ধ। তদন্ত দলের আহ্বায়ক অরুণ শিকদার এমনটাই জানিয়েছেন।
গতকাল শনিবার সকালে এফ আর টাওয়ার পরিদর্শনে আসে অগ্নিকান্ডের ঘটনায় গঠিত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তদন্ত দল। গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় এবং ফায়ার সার্ভিস থেকে গঠিত তদন্ত দলকে সঙ্গে নিয়ে তারা ভবনে প্রবেশ করেন।
প্রাথমিক পরিদর্শন এবং তদন্ত করে বেড়িয়ে এসে অরুণ শিকদার বলেন, আমরা প্রাথমিকভাবে দেখেছি। পূর্ণাঙ্গ তদন্ত করতে আরও সময় লাগবে। তবে এখন পর্যন্ত আমরা যেটুকু দেখেছি তার সারমর্ম হচ্ছে- ভবনে থাকা অগ্নিনির্বাপন যন্ত্র অকার্যকর ছিল। আর একটি ইমারজেন্সি এক্সিট আমরা দেখেছি, সেটিও বন্ধ ছিল।
তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলেন, পূর্ণাঙ্গ তদন্ত শেষে, সবাই মিলে একটি বৈঠকে বসবেন। তখন একটি উপসংহারে আসা হবে। এছাড়াও বুয়েট তদন্ত দলের প্রতিবেদন সাপেক্ষে ভবন খুলে দেওয়ার বিষয়টি পুনর্ব্যক্ত করে তদন্ত দল।
অগ্নিকান্ডের ঘটনায় মামলা
এফ আর টাওয়ারে অগ্নিকান্ডের ঘটনায় বনানী থানায় মামলা হয়েছে বলে জানিয়েছেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া। তিনি বলেন, বনানী থানায় মামলা হয়েছে। দায় অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। গতকাল শনিবার দুপুরে পুরান ঢাকার চকবাজার শাহী মসজিদ এলাকার সড়কে ওয়ানওয়ে (একমুখী) যান চলাচলের ট্রাফিক পদ্ধতি উদ্বোধন শেষে এক ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদের এই তথ্য জানান তিনি। তবে মামলার আসামি কতোজন সে বিষয়ে তিনি বিস্তারিত কিছু বলেননি।
বিভিন্ন হাসপাতালে এখনো চিকিৎসাধীন ৩৩
বনানীর এফ আর টাওয়ারে আগুনের ঘটনায় আহতদের ৩৩ জন এখনো রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। তবে আহতদের অনেকেই চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন। গতকাল শনিবার (৩০ মার্চ) স্বাস্থ্য অধিদফতরের কন্ট্রোল রুম থেকে এ তথ্য জানানো হয়েছে। অগ্নিকান্ডের পর ভবন থেকে মোট ১৩০ জনকে উদ্ধার করা হয়। যাদের মধ্যে গতকাল পর্যন্ত ২৬ জন মারা গেছেন।
কন্ট্রোল রুমের তথ্য অনুযায়ী, বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি ৩৩ জনের মধ্যে ঢাকা মেডিক্যালে ৫ জন, কুর্মিটোলা হাসপাতালে ১ জন, সিএমএইচে ২ জন, ইউনাইটেড হাসপাতালে ১৬ জন, অ্যাপোলো হাসপাতালে ৭ জন, উত্তরা ক্রিসেন্ট হাসপাতালে ১ জন ও শাহাবুদ্দিন মেডিক্যালে ১ জন ভর্তি আছেন।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের কন্ট্রোল রুম জানায়, সিএমএইচে সোহেল রানা ও অবসরপ্রাপ্ত মেজর মঈন। অ্যাপোলোতে সুশান্ত রায়, মুশফিকুর রহমান খান, রিয়াদ মাহমুদ আনসারী, ফজলুল হক, এহসানুল হক মামুন, খন্দকার এমডি মঈনুদ্দীন ও শাহরিয়ার ইসলাম। ইউনাইটেডে আছেন আশিকুজ্জামান, মোতাহার হোসেন, কামাল হোসেন মজুমদার, রিপন, আবরারুল আলম, অপরাজিতা বড়ুয়া, রুমানা, নাঈমা তানজিম স্বর্ণা, এটিএম জাহাঙ্গীর হাসনাত, এবিএম আতিকুর রহমান, ইকবাল হোসেন মামুন, নিয়াজ, রায়হান আলী, রায়হান উদ্দিন, মেহেদী হাসান আল নাহিয়ান ও নাজমুল ইসলাম। শাহাবুদ্দিন মেডিক্যালে নাজিমুদ্দিন। উত্তরা ক্রিসেন্টে নাজমুল ইসলাম এবং কুর্মিটোলায় সোহাগ।
এদেিক, ঢামেকের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন অনুপম দেবনাথ, সাব্বির আহমেদ মৃধা, আব্দুস সবুর খান, তৌকির আহমেদের অবস্থা স্থিতিশীল বলে জানিয়েছেন শেখ হাসিনা বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের সমন্বয়ক ডা. সামন্তলাল সেন। এছাড়া রেজওয়ান আহমেদ নামে আরেকজনকে ঢামেকের আইসিইউতে রাখা হয়েছে।
২১ তলা থেকে লাফিয়ে পড়া রেজওয়ান শঙ্কামুক্ত নয়
এফআর টাওয়ারে অগ্নিকান্ডের সময় ২১ তলা থেকে লাফিয়ে পড়ে আহত রেজওয়ানের অবস্থা স্থিতিশীল হলেও শঙ্কামুক্ত নয় বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। তিনি বর্তমানে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের নিবিড় পর্যবেক্ষণ ওয়ার্ডে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন।
গতকাল শনিবার সকালে ঢামেক হাসপাতালের আইসিইউর বিভাগীয় প্রধান প্রফেসর ডা. মোজাফফর হোসেন বলেন, দুর্ঘটনার দিন বিকেলে প্রথমে হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন ছিল। পওে সেখানকার চিকিৎসকরা তাকে জেনারেল আইসিউতে রেফার্ড করেন। তার শারীরিক অবস্থা স্টেবল হলেও শঙ্কামুক্ত নয়। রেজওয়ানের পায়ে ও কাঁধে ফ্যাকচার রয়েছে। এছাড়া শরীরের বিভিন্ন জায়গায় আঘাত ও দগ্ধ রয়েছে। তাকে অক্সিজেনের মাধ্যমে রাখা হয়েছে। এছাড়া বোর্ড গঠন করে তার চিকিৎসা চললে বলেও তিনি জানান।
মুন্সিগঞ্জের সিরাজদীখান উপজেলার মনির হোসেন মিন্টুর চার সন্তানের মধ্যে বড় রেজওয়ান। তিনি স্ত্রী শিথিল মনিকে নিয়ে মিরপুর এক নম্বর উত্তর বিশিল এলাকায় থাকতেন। এফআর টাওয়ারের ২১তলায় একটি প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন। অগ্নিকান্ডের দিন জীবন বাঁচানোর জন্য ওই ভবনের ২১ তলা থেকে লাফিয়ে নিচে পড়ে গুরুতর আহত হন।
এফ আর টাওয়ারে আগুনের ঘটনায় গণশুনানি আজ
আগুনের ঘটনায় আজ রোববার গণশুনানি অনুষ্ঠিত হবে। এফ আর টাওয়ারের পাশে পুলিশের অস্থায়ী কন্ট্রোল রুমের সামনে গণশুনানি হবে বলে জানিয়েছে দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটি। সকাল ১০টা থেকে ১২টা পর্যন্ত এফ আর টাওয়ারের ৮, ৯ ও ১০ তলায় যারা কর্মরত ছিলেন তাদের অভিজ্ঞতার কথা শোনা হবে।
গতকাল শনিবার দুপুর ১২টার দিকে দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ফয়জুর রহমান সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান। এর আগে সকাল ১০টার দিকে দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের গঠিত ৮ সদস্যের তদন্ত কমিটি এফ আর টাওয়ার পরিদর্শনে আসেন। তারা ভবনের ভেতরে ঘুরে দেখেন।
তদন্ত কমিটির প্রধান অতিরিক্ত সচিব ফয়জুর রহমান বলেন, আমরা ঘটনাস্থল পরিদর্শনে এসেছি, তদন্ত চলছে। আগামী ৩ এপ্রিল, কমিটির তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হবে। ভবনের ভেতরে সিঁড়ি সম্পর্কে তিনি বলেন, ভেতরে একটি (এস্কেপ) সিঁড়ি রয়েছে যা ২৮ থেকে ৩০ ইঞ্চি প্রশস্ত ছিল। ভেতরে আমরা কিছু ফায়ার এক্সটিংগুইশার দেখেছি, তবে সেগুলো অব্যবহৃত ছিল। তদন্তের স্বার্থে আমরা ভবনের মালিক ও জমির মালিকের সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা করবো।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: অগ্নিকান্ড


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ