Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

এখন সময় এসেছে নিরাপত্তা চাইবার

স্পোর্টস রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ১৭ মার্চ, ২০১৯, ১২:৪৩ এএম

২০১৫ সালের সেই স্মৃতি আজও দগদগে। টাইগারদের বিপক্ষে দুই ম্যাচ সিরিজের টেস্ট খেলেতে ওই বছরের অক্টোবরে অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট দলের বাংলাদেশ সফরে আসার কথা ছিল। প্রথম ম্যাচটি অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল ৯ অক্টোবর। কিন্তু তার আগে অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটারদের নিরাপত্তা ইস্যুতে ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া বাংলাদেশে এসে যা করে সেটা ছিল নজিরবিহীন।

স্টিভ স্মিথদের নিছিদ্র নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সে বছরের ২৮ সেপ্টেম্বর সারাদিন দফায় দফায় সভা করেন শন ক্যারলের নেতৃত্বাধীন অস্ট্রেলিয়ান নিরাপত্তা পরিদর্শক দল। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী থেকে শুরু করে জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা (এনএসআই), সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা (ডিজিএফআই), এলিট ফোর্স, র‌্যাব এমনকি পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গেও আলোচনা বাদ রাখেনি। বিস্ময়ের ব্যাপার হলো এতগুলো রুদ্ধদ্বার বৈঠকের পরও ওই বছর তারা বাংলাদেশ সফর করেনি। সিরিজ স্থগিত হয়ে যায়। যা মাঠে গড়ায় দুই বছর পর।

২০১৭ সালের আগস্টে মাঠে গড়ানো সেই সিরিজে টিম অস্ট্রেলিয়াকে কী নিরাপত্তাটাই না দেয় বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড! ভিভিআইপি নিরাপত্তা যাকে বলে। পুরো দলকেই নিরাপত্তার চাদরে মুড়ে দেয়া হয় পুলিশ, এপিবিএন ও র‌্যাবকে দিয়ে। সঙ্গে দলটির গাড়ির বহরে ছিল সোয়াট সদস্যরাও। টিম হোটেল রেডিসন থেকে থেকে মিরপুর স্টেডিয়ামে আসার সময় পুরোটা পথে নিরাপত্তা দেওয়া হয়। মোটরসাইকেলে যুক্ত ছিল পুলিশ ও র‌্যাবের চৌকস সদস্যরা। ছিল ফায়ার সার্ভিস ও অ্যাম্বুলেন্স। গুরুত্বপূর্ণ স্থানের ছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।

হোটেলেও নেওয়া হয়েছিল কয়েক স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা। চারপাশ লাইটিংসহ আনা হয়েছিল সিসিটিভির আওতায়। বসানো হয়েছিল আর্চওয়ে, লাগেজ স্ক্যানার, ভিকেল স্ক্যানার। এগুলোর মধ্য দিয়ে প্রত্যেককে চেক করে নিয়ে আসতে হয়েছিল। কোনো ধরনের দর্শনার্থীর প্রবেশের অনুমতি ছিল না। এমনকি কোনো গণমাধ্যম অনিয়মিতভাবে কোনো খেলোয়াড় বা কর্মকর্তাদের সাক্ষাৎকারও নিতে পারেনি। সেক্ষেত্রে বিসিবির যথাযথ অনুমতি নিতে হয়েছিল। একই ব্যবস্থা ছিল দলটি চট্টগ্রামে থাকাকালীনও।

শুধু অস্ট্রেলিয়াই কেন? দ্বিপাক্ষিক সিরিজ খেলতে ২০১৬ সালে যখন ইংল্যান্ড এলো, তার আগের বছর ভারত, পাকিস্তান ও দক্ষিণ আফিকা সফর করে যায়। একই নিরাপত্তা দিয়েছিল বিসিবি। এমনকি জিম্বাবুয়ে এলেও নূন্যতম ভিআইপি নিরপত্তা দিয়ে থাকে লাল-সবুজের ক্রিকের সর্বোচ্চ এই সংস্থাটি। তার আগেও বিভিন্ন সিরিজ ও টুর্নামেন্টে সফরকারী দলগুলোকে নূন্যতম ভিআইপি নিরাপত্তা দিয়েছে। তাহলে বাংলাদেশ কেন পায় না?

প্রশ্নটি উঠতো না যদি বাংলাদেশ ক্রিকেট দল গতপরশু ক্রাইস্টচার্চে অমন রোমহর্ষক বাস্তবতার মুখোমুখি না হতো। চোখের সামনে দেখা ছোপ ছোপ রক্ত, মৃত মানুষ ও গর্জে উঠা হাইটেকি মেশিন গানের শব্দে প্রাণ বাঁচাতে উদভ্রান্তের মতো না ছুটতো। মিনিট চারেক আগে হ্যাগলি ওভালের আল নূর মসজিদে পৌঁছালে তামিম, মুশফিকদের কী হতো ভাবতেই গা শিউরে উঠছে। সামনেই বিশ্বকাপ। এই ট্রমা থেকে বের হতে তাদের কতদিন লাগে সেটাই এখন প্রধান বিবেচ্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বিশ্বাসই হচ্ছে না যে দেশের ক্রিকেট বোর্ড সফরকারীদের জন্য নিছিদ্র নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে থাকে, সেই দেশের ক্রিকেটারদের সঙ্গে নিউজিল্যান্ডের একজন নিরাপত্তা কর্মীও থাকে না! নিরাপত্তাকর্মী দূরে থাক একজন লিয়াজো কর্মকর্তা ছিল না! শুধু নিউজিল্যান্ডেই কেন? বিদেশে কোনো সফরেই টিম বাংলাদেশকে নূন্যতম নিরাপত্তা দেয় না স্বাগতিক দেশগুলো। বিষয়টি দারুণ ব্যথিত করেছে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের সিইও নিজামউদ্দীন চৌধুরী সুজনকে, ‘এটা দুঃখজনক যে দৃশ্যমান কোনো নিরাপত্তা ব্যবস্থা আমরা দেখিনি। আমরা জানি না তাদের নিরাপত্তা ব্যবস্থাটা কী। কিন্তু যখন দুই দেশের সিরিজ বিষয়ক সমঝোতা চুক্তি হয়, তখন কিন্তু জাতীয় পর্যায়ের নিরাপত্তার কথা বলা হয়। কিন্তু একেকটা দেশের নিরাপত্তার মান নির্ধারণ করা হয় নিরাপত্তা পরিস্থিতি মূল্যায়নের মাধ্যমে। আমাদের দেশে যখন কোনো দল আসে, তখন কিন্তু আমাদের নিরাপত্তা বাহিনী নিরাপত্তা পরিস্থিতি মূল্যায়ন করে এবং সে অনুযায়ী নিরাপত্তা পরিকল্পনা প্রণয়ন করে।’

তিনি আরও যোগ করেন, ‘এর সাথে সফরকারী দল যদি আরো কিছু যোগ করার প্রয়োজন মনে করে তাহলে তারা তাদের স্থানীয় হাই কমিশনের সহায়তা নেওয়ার চেষ্টা করে। এটাই হলো সাধারণ অনুশীলন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া বা নিউজিল্যান্ডের মতো দলের সাথে এ রকম করা হয়। উপমহাদেশের দলগুলোর জন্য এ রকম হয় না। তবে বিশেষ পরিস্থিতির কারণে এ রকম হয়ে থাকতে পারে।’

নিউজিল্যান্ডের নিরাপত্তা নিয়ে উদাসীনতা এবং কাণ্ডজ্ঞানহীনতায় বেজায় চটেছেন বাংলাদেশ ক্রিকেটের সাবেক অধিনায়ক ও বিসিবির গেমস ডেভেলপমেন্ট চেয়ারম্যান খালেদ মাহমুদ সুজনও, ‘এখানে যখন ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া কিংবা নিউজিল্যান্ড আসে তখন পুরো সিকিউরিটি দল আসে। আমাদের হোটেল চেক করে, রাস্তাঘাট দেখে। কোন রাস্তা দিয়ে বাস আসবে এবং কোন দিক দিয়ে হোটেলে যাবে প্রত্যেকটি জিনিস দেখে। এমনকি প্রত্যেকটি ভেন্যুতেও যায়। আমার মনে হয় বাংলাদেশেরও এমন করা উচিৎ। কারণ ওরাও আন্তর্জাতিক দল, আমরাও আন্তর্জাতিক দল। নিজেদের মাটিতে যদি এমন একটি ঘটনা ঘটতে পারে, তাহলে বলা যায় বিশ্বের কোথাও এখন নিরাপত্তা নেই আসলে।’

ঘটনার দিনই বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন স্পষ্ট বলে দিয়েছেন, ভবিষ্যতে বিসিবির চাওয়া অনুযায়ী নিরপত্তা না পেলে সিরিজ খেলতে টিম পাঠাবে না। তিনি জানিয়ে দিয়েছেন, ‘আমাদের দেশে কোনো দেশ যখন আসে এবং যে ধরণের নিরাপত্তা নিয়ে ওরা কথাবার্তা বলে আর যে ধরণের নিরাপত্তা আমাদের দিতে হয় এখন পর্যন্ত আমরা সেকরম কিছু পাইনি। সত্যি কথা আমরা এটা নিয়ে জোরাজুরিও করিনি। অন্য দেশও দেখেছি কেউ করে না। তবে অন্যরা কি করে জানি না। এই ঘটনার পরে এটা নিশ্চিত বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড এখন থেকে যে দেশেই দল পাঠাক না কেন, আমাদের নূন্যতম চাওয়া অনুযায়ী নিরাপত্তা দিতে হবে। এটা যারা দিতে পারবে তাদের ওখানেই আমরা খেলতে যাব। এছাড়া নয়।’

বিশ্ব ক্রিকেটে নিউজিল্যান্ডের মতো বাংলাদেশও আন্তর্জাতিক একটি দল। আইসিসির পূর্ণ সদস্য হিসেবে নিউজিল্যান্ড যে মর্যাদার দাবীদার বাংলাদেশ তার কোনো অংশে কম নয়। এখন তাই সময় এসেছে কোনো দেশে সফর করতে গেলে নিজেদের জন্য নিছিদ্র নিরাপত্তা চাইবার।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: নিরাপত্তা চাইবার
আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ