Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

পথশিশুরা মাদকে আসক্ত

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা

আবদুল্লাহ আল মামুন | প্রকাশের সময় : ১২ মার্চ, ২০১৯, ১২:০৪ এএম

আরশাদুল হাসান (ছদ্ম নাম)। চেহারা দেখে বয়স ১৩-১৪ বছর মনে হবে। যদিও তার কথায়- বয়স ১৬। বছর চার-পাঁচ আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ফুল বিক্রি করলেও এখন গাঁজা, ইয়াবাসহ বিভিন্ন মাদক বিক্রি করে। নিজের ইচ্ছায় এ পেশাতে আসেনি। এক সময় বন্ধুদের সাথে মিশতে গিয়ে সিগারেটের নেশায় জড়িয়ে পড়ে। ধীরে ধীরে পুরোপুরি আসক্ত হয়ে পড়ে গাঁজা আর ইয়াবায়। 

এক পর্যায়ে নেশার টাকা জোগতে নিজেই শুরু করে মাদক কেনাবেচা। প্রথমে ভাসমান রিকসা চালক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অল্প কিছু ছাত্র তার কাছ থেকে গাঁজা কিনতো। এক সময় ক্রেতা আর নেশা দ্রব্যের চাহিদা বাড়ে। এখন শুধু সেবনই করে না, বিক্রির পাশাপাশি ফরমায়েশ মতো বিভিন্ন জায়গায় গাঁজা আর ইয়াবাও পৌঁছে দেয় এই কিশোর।
আরশাদ জানায়, শুধু সে নয়, তার মতো ভাসমান অনেক শিশু-কিশোর এখন মাদক সেবন ও বিক্রির সাথে জড়িত। বড় ভাইরা (তাদের ভাষায়) মাদক বিক্রি ও বহনের কাজে শিশু-কিশোরদের বেশি নিরাপদ মনে করে। তাই তাদেরকে দলে ভেড়ানো হচ্ছে। যার কারণে দিন দিন এ কাজে শিশু-কিশোরদের চাহিদা বাড়ছে। আরশাদ আরো জানায়, আগে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় মাদক নিয়ে গেলে ছোটদের ৫০ টাকা দিলেই হতো। এখন ১০০ থেকে ২০০ টাকা দিতে হয়। বয়স একটু বেশি হলে আরও বেশি টাকা দিতে হয়। যে সব শিশুরা দেখতে খুবই সহজ সরল, কিন্তু আচরণে অনেক চালাক-চতুর তাদেরই চাহিদা বেশি। এসব শিশু কিশোররা নিরাপদে মাদক বিক্রি ও বহন করতে পারে। খুব সহজে ধরা পরে না। তবে কখনো ধরা খেলে দু’চারটি থাপ্পর ও লাথি মেরে ছেড়ে দেয়।
দেশে কি সংখ্যায় ভাসমান শিশু-কিশোর মাদকে আসক্ত তার নির্দিষ্ট তথ্য নেই। তবে বিভিন্ন সূত্রে বলা হয়ে থাকে, দেশে ৭০ থেকে ৮০ লাখের মতো মাদকাসক্ত রয়েছে। প্রকৃতপক্ষে এ সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে। পথশিশুদের নিয়ে কাজ করে এমন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর তথ্যমতে, ঢাকায় পাঁচ লাখের মতো পথশিশু রয়েছে। এর মধ্যে ৮০ থেকে ৮৫ ভাগ মাদকাসক্ত। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ২০০২-০৩ সালের এক গবেষণায় বলেছে, পথশিশুদের ৪৪ শতাংশ মাদকাসক্ত।
আইসিডিডিআরবি সর্বশেষ ২০১১ সালের এক গবেষণায় ৫১ শতাংশ পথশিশুর মাদকাসক্তের কথা বলা হয়েছে। বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের তথ্যানুযায়ী, পথশিশুদের ৮৫ ভাগই কোনো না কোনোভাবে মাদক সেবন করে। গত কয়েক বছর আগে তাদের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, মাদকাসক্ত পথশিশুদের মধ্যে ১৯ শতাংশ হেরোইন, ৪৪ শতাংশ ধূমপান, ২৮ শতাংশ বিভিন্ন ট্যাবলেট ও ৮ শতাংশ ইনজেকশনের মাধ্যমে নেশা করে। এর বাইরে বিরাট একটি অংশ ড্যান্ডির (সলিউশন গাম) নেশায় আসক্ত।
শিশুদের নিয়ে কাজ করেন এমন বিশেষজ্ঞরা বলেন, পথশিশুদের বেশিরভাগই পরিবারের সাথে কোন যোগাযোগ রাখে না। তবে বেশিরভাগ পরিবার সন্তানদের অবস্থা সম্পর্কে অবগত। গুটি কয়েক পরিবার আছে যারা মাঝে মধ্যে এসব মাদকাসক্ত শিশু কিশোরদের বাড়ি ফিরিয়ে নিতে চায়। বিশেষজ্ঞদের মতে, পথশিশুরা প্রথমে সিগারেট ধরে। এরপর ড্যান্ডি ও গাঁজা সেবন শুরু করে। পর্যায়ক্রমে ইয়াবা ও হেরোইনসহ অন্যান্য মাদকে আসক্ত হয়ে পড়ে। এক সময় এসব শিশুদের ব্যবহার করে বড় ধরণের অপরাধমূলক কর্মকান্ড করানো হয়।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, ভাসমান বেশিরভাগ ছেলে মেয়ে নানা ধরণের অপরাধে জড়িত। তাদের ভেতরে সব সময় অপরাধমূলক প্রবণতা কাজ করে। তাই বাড়িতে থাকলেও তারা পরিবারের সদস্যদের সাথে সর্বদা ঝামেলায় জড়িত থাকে। এছাড়া বাড়ির টাকা ও গুরুত্বপূর্ণ জিনিস চুরি ছাড়াও প্রতিবেশীদের বাসায় চুরি করে থাকে। এ জন্য তাদের বাড়িতে ফিরিয়ে নিলে পরিবার আরও বেশি ঝামেলায় পড়ে। যার কারণে তারাও সন্তানদের বিষয়ে উদাসীন।
শহীদ মিনার এলাকায় থাকা কুলসুম নামে এক কিশোর জানায়, এক সময় ফুল আর চকলেট বিক্রি করতো। পরে বন্ধুদের সাথে ড্যান্ডি খাওয়া শুরু করে। এখন মাঝে মধ্যে গাঁজা আর ইয়াবা খায়। তবে ইয়াবার আসক্তি অনেক বেড়ে গেছে। এখন প্রতিদিন সন্ধ্যায় গাঁজা খেতে হয়। নয়তো মাথা ঠিক মতো কাজ করে না। তার ভাষ্য, গাঁজা খেতে না পারলে মাথা আর শরীর অবশ হয়ে যায়। কোন কিছু চিন্তা করতে পারে না। খুবই খিট খিটে মনে হয়। এছাড়া তখন অন্যান্য বন্ধুদের সাথে খুব ঝগড়া হয়।
পলাশীতে থাকা লাকী নামের আরেক ভাসমান কিশোরী জানায়, ছেলে বন্ধুরাই দুষ্টমির ছলে তাদেরকে ড্যান্ডি আর গাঁজা খাওয়া শিখিয়েছে। এখন সপ্তাহে দু’দিন ইয়াবাও খায়। তাদের ছেলে বন্ধুরা শাহবাগ, আজিমপুর ও নীলক্ষেতসহ আশপাশের এলাকায় মহিলদাদের ভ্যানিটি ব্যাগ ও মোবাইল ছিনতাই করে। যেদিন বেশি টাকা আয় হয় সেদিন সবাইকে ইয়াবা খাওয়ায়। অন্যান্য দিন সবাই টাকা ভাগ করে ইয়াবা কিনে খায়।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. আ স ম আমানুল্লাহ বলেন, পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন থাকায় ভাসমান শিশু-কিশোররা সব সময় হতাশাগ্রস্ত থাকে। এছাড়া রাষ্ট্র বা সমাজ এসব বিচ্ছিন্ন শিশু-কিশোরদের যথাযথভাবে গ্রহণ করতে চায় না। এসব কারণে ভাসমান শিশু-কিশোররা মানসিকভাবে নানা জটিলতায় ভুগে মাদকে জড়িয়ে পড়ছে।
তিনি বলেন, এককভাবে তাদেরকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। পরিবার ও রাষ্ট্র উভয়ই এ সমস্যরার জন্য দায়ী। এসব শিশু-কিশোরারা দু’বেলা খাবারের জন্য অনেক সময় বড় অন্যায় করে বসে। যার কারণে সরকারিভাবে এসব শিশু-কিশোরদের দেখভালের ব্যবস্থা করতে হবে। তবেই তাদেরকে নেশা ও অপরাধ থেকে ফিরিয়ে মূল স্রোতে অন্তর্ভূক্ত করা সম্ভব।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ