Inqilab Logo

সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

ফাল্গুনের ঝুমবৃষ্টিতে ফসলের আশীর্বাদ

প্রকৃতিতে এসেছে সজীবতা

রেজাউল করিম রাজু | প্রকাশের সময় : ১ মার্চ, ২০১৯, ১২:১০ এএম

মধ্য ফাল্গুনে আকাশজুড়ে চলছে রোদ্র-বৃষ্টির খেলা। কখনো আকাশ কালো করে মেঘের ঘনঘটা ঝুপঝাপ বৃষ্টি। আবার মেঘ সরিয়ে উঁকি দিচ্ছে সূর্য। বিদায় নিতে বসা শীতকে যেন ফিরিয়ে এনেছে। গত দু’দিন ধরে আবহাওয়ার এমন রকমফের দেখা যাচ্ছে। বৃষ্টি আর্শীবাদ না ক্ষতির কারণ এমন নিয়ে আলোচনা কম নয়। এখন চলছে বোরোর ভর মওসুম। বৃষ্টি বেশ খানিকটা আর্শীবাদ হয়ে এসেছে। সেচের জন্য অবিরাম তোলা পানির উপর চাপ কিছুটা হলেও কমবে। ধানের ক্ষেতগুলো সবুজে সবুজে ভরা। এখন চৈতালী ফসল ওঠার মওসুম। মাঠে মাঠে পাকা গম, সরিষা, কালাই, মশুর, ভুট্টাসহ নানা রকম ফসল। আলু পিয়াজ প্রায় উঠে গেলেও এখন পুরো মাঠ ছাড়েনি। চলছে আলু তোলার কাজ। এরমধ্যে হঠাৎ করে ঝুম বৃষ্টি। দু’তিনদিন এমন রোদ্র বৃষ্টি হলে ক্ষতি নেই। এর বেশি হলে চিন্তার কারণ। আবহাওয়া অফিস বলছে অবিরাম বৃষ্টির সম্ভাবনা নেই। ফলে এই বৃষ্টি আর্শীবাদ বয়ে এনেছে।
এবার আবহাওয়া অনুক‚ল থাকায় শীতকালীন ফসলের আবাদ ভাল হয়েছে। গম সরিষা আর ডাল জাতীয় শষ্যের ক্ষেতগুলো সে কথা জানান দিচ্ছে। এবার রাজশাহীতে গমের আবাদ গতবারের চেয়ে চৌদ্দ হাজার বিঘা জমিতে বেশি হয়েছে। গমের শীষ বের হয়ে পাকতে শুরু করেছে। কদিন পর শুরু হবে কাটা। মশুর ডাল মাসকালাই ডালসহ ডাল জাতীয় শস্য কাটা ও মাড়াই চলছে। এবার রাজশাহী অঞ্চলে ব্যাপক আলুর আবাদ হয়েছে। আলু উত্তোলন প্রায় শেষের পথে। এরমধ্যে বৃষ্টি এখনো মাঠে যাদের আলু আছে তাদের ভাবিয়ে তুলেছে। তবে দু’তিন দিনের বেশি এমন আবহাওয়া না থাকলে ক্ষতির কারণ নেই। বৃষ্টি অব্যাহত থাকলে জমিতে পানি জমে আলু পচে যাবে। গায়ে কালচে দাগ পড়বে। কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ ও কৃষির মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তা কর্মীরা বলছেন এখন পর্যন্ত শঙ্কার কারণ নেই। রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ দপ্তরের উপ-পরিচালক এসএম মুস্তাফিজুর রহমান জানান, এবার রাজশাহী বিভাগের আট জেলা বিশেষ করে বরেন্দ্র এলাকায় আট লাখ হেক্টরের বেশি জমিতে বোরোর আবাদ হয়েছে। যা থেকে চাল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা তেত্রিশ লাখ টনের বেশি চাল। বৃষ্টি বোরো আবাদের জন্য আর্শীবাদ হয়েছে। অন্যান্য ফসল নিয়ে তেমন শঙ্কা নেই।
রাজশাহী অঞ্চল মানেই আম। এখন আমের গাছে গাছে ছেয়ে আছে আমের মুকুল। চারিদিকে মুকুলের মন পাগল করা সুঘ্রাণ। আবহাওয়া অনুক‚ল থাকায় এবারো গাছ ভরে মুকুল ভাল ফলনের স্বপ্ন দেখাচ্ছে। যদি শিলা ঝড়ো হাওয়া আর বর্ষণ চোখ রাঙ্গাচ্ছে। তবে এখনো বড় রকমের ক্ষতির কারণ হয়ে দাড়ায়নি। গত ১৭ ফেব্রুয়ারি (বৃহষ্পতিবার) কোথাও কোথাও শিলাবৃষ্টি আমের মুকুলে বেশ ক্ষতি করেছে। তবে সার্বিক ভাবে তেমন কিছুনা।
চাপাইনবাবগঞ্জের কৃষি কর্মকর্তা মনজুরুল হুদা বলেন, এবারো বিপুল পরিমাণ মুকুল এসেছে। কোথাও কোথাও মটর দানার মত গুটি বেঁধেছে। যে সব মুকুলে পরাগায়ণ হয়ে গেছে বৃষ্টি ও মেঘলা আবহাওয়া তার কোন ক্ষতি করতে পারবেনা। আবার যেগুলোর মুকুল হয়নি আপাতত সেগুলোরও কোন ক্ষতি হবেনা। তাছাড়া যেসব চাষি ইতোমধ্যে ছত্রাকনাশক ব্যবহার করেছেন তাদের আমের ক্ষতি হবেনা। যারা এখনো ব্যবহার করেননি তারা ছত্রাকনাশক ব্যবহার করলে ভাল ফল পাবেন। তিনি বলেন, বৃষ্টিতে গাছের ডাল পাতা ভিজে ধুলো ময়লা ধুয়ে গেছে। প্রকৃতিতে সজীবতা ফিরে এসেছে। ভালই হয়েছে।
রাজশাহী ফল গবেষণা কেন্দ্র সূত্রে জানা যায়, এবার রাজশাহীতে প্রায় সাড়ে সতের হাজার হেক্টর জমিতে আম চাষ হয়েছে। ঠিকঠাক থাকলে উৎপাদন হবে দু’লাখ টনের বেশি।
রাজশাহী আবহাওয়া দপ্তরের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানান, বসন্তকালে দেখা যায়না। ভ‚গর্ভস্থ পানির স্তর নিয়ে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত থেকে মাঠে কাজ করছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক প্রোভিসি ভূতত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. চৌধুরী সারওয়ার জাহান সজল বলেন, ক’বছর ধরে আবহাওয়ায় ভিন্ন আচরণ করছে। শীতকালীন সময় কমেছে। বর্ষা মওসুমে বৃষ্টি না হলেও শীতে বৃষ্টি ঝরছে। এবারো বর্ষা মওসুমে পর্যাপ্ত বৃষ্টি হয়নি। কিন্তু শীত বসন্তে বৃষ্টি হচ্ছে। বর্ষা মওসুমে পর্যাপ্ত বৃষ্টি না হওয়ায় বিগত আমন মওসুমে প্রায় পুরোটা ভ‚র্গভস্থ পানির সেচের উপর নির্ভর করতে হয়েছে। আবার বোরো আবাদ শুরু হয়েছে খাল বিল আর ভ‚গর্ভের পানি ব্যবহার করে। ফাগুনের এই বৃষ্টি বোরো আবাদের ক্ষেতে অন্তত দুটো সেচের খরচ বাঁচাবে। গত আমন মওসুমে অনেক পানি উঠেছে। সবচেয়ে বড় কথা বৃষ্টির পানিকে সংরক্ষণ করতে হবে।
চট্টগ্রাম ব্যুরো জানান, বৃষ্টি ঝরছে সারাদেশে। কখনও ঝুম বৃষ্টি কখনও হালকা থেকে মাঝারি। তবে বর্ষার মতো একটানা দীর্ঘক্ষণের বর্ষণও নয়। গত ২৫ ফেব্রুয়ারি (সোমবার) ভোরবেলায় আকাশ হঠাৎ ঘন মেঘে ছেয়ে গিয়ে দমকা থেকে ঝড়ো হাওয়ার সাথে শুরু হয় বর্ষণ। চট্টগ্রাম, ঢাকা, রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল, ময়মনসিংহ, সিলেট অবশেষে রংপুর বিভাগেও বর্ষেছে। আজ শুক্রবারও দেশের অনেক জায়গায় বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস আছে। পশ্চিমা লঘুচাপের বর্ধিতাংশের সাথে পূবালী বায়ু ও উত্তর বঙ্গোপসাগরের বজ্রমেঘ মিলিত হয়েই বৃষ্টিপাতের আবহ তৈরি হয়েছে। মেঘ না চাইতেই বৃষ্টির মতো ফাল্গুন মাসের মাঝখানে ‘অসময়ের’ এই বর্ষণকে রহমত হিসেবেই দেখছেন ‘সব সাধকের বড় সাধক আমার দেশের চাষা’ কৃষকগণ এবং কৃষি-আবহাওয়া বিশেষজ্ঞমহলও।
গতকাল (বৃহস্পতিবার) কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক কৃষিবিদ মো. আবুল হোসাইন তালুকদার দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, এই বৃষ্টিপাত খুবই উপকারী হয়েছে। এখন বোরো ফসলের টিলারিং (কুশি) অর্থাৎ দ্বিতীয় পর্যায়। বৃষ্টির পানিতে জমির উর্বরা শক্তি বেড়েছে। বৃষ্টিতে বাতাসের নাইট্রোজেনের ছোঁয়ায় বোরোধানের পাতা ঘন সবুজাভ হবে। এরপর তৃতীয় পর্যায়ে ধানের শীষ বের হওয়ার জন্য তা খুবই সহায়ক। বৃষ্টিপাত না হলে এখন কৃষকদের বোরো ফসলের জমিতে পানিসেচ, সম্পূরক সেচ দেয়ার জন্যই আমাদের পরামর্শ দিতে হতো। এখন কৃষিসেচের খরচ বিরাট খরচ বাঁচলো। তিনি মনে করেন, যদি ব্যাপকহারে শিলাবৃষ্টি ও কালবৈশাখী ঝড় না হয় তাহলে এ সময়ের বৃষ্টির উপকারিতা সীমাহীন।
এই কৃষিবিদ আরও বললেন, বৃষ্টিহীন পৌষ-মাঘের শেষে ফাল্গুনে সারাদেশে এই বৃষ্টিপাতের ফলে বোরোসহ সজীব হয়ে উঠেছে কৃষিখাত। আবাদ ও উৎপাদনে এর সুফল আসবে। গত ক’দিনের বর্ষণে আগের সেই শুষ্ক খটখটে নদী-নালা, খাল-বিল অনেকটাই ভরে গেছে। মাটির তলায় পানি রিচার্জ (পুনর্ভরণ) হয়েছে। তিন দিন আগে থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়া সফরের অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ওসব দেশে ভূ-গর্ভস্থ পানি উত্তোলন করা হয়না। বরং যত বেশি সম্ভব ধরে রাখা হয়। তারা ভূ-উপরিভাগের (সারফেস) পানি কৃষি-খামারের উৎপাদনে কাজে লাগায়। আমাদের দেশে জনসংখ্যা বেশি হওয়াসহ নানাবিধ কারণে আমরা তা পারছি না।
এদিকে আবহাওয়া অধিদপ্তরের কৃষি আবহাওয়া মহাশাখার উপ-পারিচালক কাওসার পারভীন সংস্থাটির ওয়েবসাইটে দেওয়া সাপ্তাহিক পূর্বাভাসে (২৪ ফেব্রুয়ারি থেকে ২ মার্চ) জানান, এ সপ্তাহে দৈনিক উজ্জ্বল সূর্য কিরণ কাল সাড়ে ৬ ঘণ্টা থেকে সাড়ে ৭ ঘণ্টাকাল পর্যন্ত স্থায়ী থাকতে পারে। বাষ্পীভবনের দৈনিক গড় ২.৫০ মিলিমিটার থেকে ৩.৫০ মি.মি. থাকতে পারে। এ সময়ে দেশের কিছু কিছু স্থানে দমকা হাওয়াসহ হালকা (৪ থেকে ১০ মি. মি.) থেকে মাঝারি (১১ থেকে ২২ মি. মি.) ধরনের বৃষ্টিপাত, বজ্রবৃষ্টি হতে পারে। এ সময়ে সারাদেশে দিন ও রাতের তাপমাত্রা সামান্য বাড়তে পারে।
আগামী ২৪ ঘন্টার আবহাওয়ার পূর্বাভাস অনুসারে, রাজশাহী, রংপুর, ঢাকা, ময়মনসিংহ, খুলনা, বরিশাল, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের অনেক জায়গায় অস্থায়ীভাবে দমকা থেকে ঝড়ো হ্ওায়াসহ হালকা থেকে মাঝারী ধরনের বৃষ্টি বা বজ্রসহ বৃষ্টিপাত হতে পারে। সেই সাথে দেশের কোথাও কোথাও মাঝারী ধরনের ভারী বর্ষণসহ বিক্ষিপ্তভাবে শিলাবৃষ্টি হতে পারে। আগামী ৭২ ঘণ্টায় সারাদেশে আবহাওয়ার উন্নতি হতে পারে।
গতকাল সকাল পর্যন্ত পূর্ববর্তী ২৪ ঘণ্টায় দেশের সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাতের রেকর্ড খুলনায় ৭৫ মিলিমিটার। এ সময় ঢাকায় ৪৯, ফরিদপুরে ৬৬, গোপালগঞ্জে ৩৪, ময়মনসিংহে ২৫, চাঁদপুরে ৪১, কুমিল্লায় ১৭, ফেনীতে ২০, সিলেটে ১৯, রাজশাহীতে ১৬, বগুড়ায় ১৩, রংপুরে ১৩, দিনাজপুরে ৮, সাতক্ষীরায় ৭২, যশোরে ২০, বরিশালে ২২, ভোলায় ৩ মিলিমিটারসহ সমগ্র দেশে কমবেশি বৃষ্টিপাত হয়েছে। #



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: বৃষ্টি

৫ অক্টোবর, ২০২২
১৪ সেপ্টেম্বর, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ