Inqilab Logo

রোববার ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

বাবাকে ওরা মারল কেন

বনানীর সামরিক কবরস্থানে শহীদ সেনা কর্মকর্তার সন্তানের প্রশ্ন

বিশেষ সংবাদদাতা | প্রকাশের সময় : ২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯, ১২:০৩ এএম

বাবার ছবি দেখিয়ে মা বলেন, বাবা অনেক ভালো মানুষ ছিলেন। তাকে কখনও দেখিনি। একজন ভাল মানুষকে ওরা মারলো কেন? বাবাকে নিয়ে অনেক গল্প বলেন মা। তিনি নাকি দেশের জন্য জীবন দিয়েছেন। গতকাল সোমবার সকাল আটটায় রাজধানীর বনানীর সামরিক কবরস্থানে মা, দাদা-দাদী আর ফুফুদের সঙ্গে আসা পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনায় শহীদ মেজর মুমিনুল ইসলাম সরকারের ছেলে সাদাকাত সাবরি বিন মোমিন(১০) এসব কথা বলেন।
মোমিন আরো বলেন, তিনি থাকলে খুব ভাল লাগতো। বন্ধুরা ওদের বাবার সাথে স্কুলে আসে। আমারও বাবার হাত ধরে স্কুল যেতে খুব ইচ্ছে করে। তাকে ভীষণ মিস করি। প্রতিবছর এইদিনে আমি, মা আর পরিবারের সবাই মিলে এই কবরে এসে দোয়া করি। আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে বাবাকে ওরা মারলো কেন? শহীদ মেজর মমিনুলের পরিবারের মত আরও অনেক শহীদ পরিবারের স্বজনরা সোমবার সকালে বনানী কবরস্থানে আসেন। কারও বাবা-মা, কারও সন্তান, কারও স্ত্রী বা ভাই-বোন। এসময় পিলখানা হত্যাকান্ডে নিহত সন্তানের জন্য মুনাজাত ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন বৃদ্ধ অনেক বাবা-মা। কেউ আবার প্রিয়জনের কবরে ফুল দিয়ে দিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়ে সেখানেই নীরবে দাঁড়িয়ে থাকেন অনেকটা সময়।
অন্যদিকে যথাযোগ্য মর্যাদায় গতকাল পিলখানা ট্রাজেডি দিবস পালিত হয়েছে। প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে তাদের সামরিক সচিব, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, তিন বাহিনীর প্রধান, বিজিবির মহাপরিচালক ও স্বজনরা বনানীর সামরিক কবরস্থানে ফুল দিয়ে নিহত শহীদ সেনা কর্মকর্তাদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।
গতকাল বনানী সামরিক কবরস্থানে এক তরুণ ও কিশোরকে সঙ্গে নিয়ে একটি কবরের সামনে দাঁড়ালেন লাঠি হাতে আসা ষাটোর্ধ্ব এক নারী। সেখানে বসে থাকলেন বেশ কিছুটা সময়। কাঁদলেন, দোয়া করলেন তারপর আবার ফিরতে শুরু করলেন প্রধান ফটকের দিকে। ষাটোর্ধ্ব ওই নারীর চোখে তখন পানি। তরুণ ও কিশোর ছেলে দু’টির চোখে-মুখে বেদনার ছাপ। তারা হাঁটছিলেন ধীর পায়ে। কাছে এগিয়ে গিয়ে কথা বলতেই সেই বৃদ্ধার কান্নার যেন বাঁধ ভেঙে গেলো। কাঁদতে কাঁদতেই বললেন, আমি এক দুঃখিনী মা, ১০ বছর ধরে বুকে কষ্ট বয়ে বেড়াচ্ছি। ১০ বছর আগে আমার নিষ্পাপ, নির্দোষ ছেলেকে ওরা মেরে ফেলেছে।
বনানী সামরিক কবরস্থানে শহীদ সেনা কর্মকর্তাদের অনেকেই এ সময় এ নির্মম নিষ্ঠুর হত্যাকান্ডে জড়িত নেপথ্যের নায়কদের খুঁজে বের করার দাবি জানান তারা। নেপথ্যের নায়করা এখনো ধরা ছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছে। তাদেরকে খুঁজে বের করতে সরকারের প্রতি আবেদন শহীদেদের স্বজনদের।
এছাড়া পিলখানা হত্যা মামলায় হাইকোর্টে আপিলের রায় শেষ হলেও ঝুলে আছে বিস্ফোরক মামলা। এর ফলে ন্যায় বিচার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে বিচারপ্রার্থীরা। বহুল আলোচিত পিলখানা হত্যাকান্ডের ১০ বছরেও বিচার প্রক্রিয়া চুড়ান্ত নিষ্পত্তি হচ্ছে না। শহীদ মেজর মুমিনুল ইসলাম সরকারের স্ত্রী সানজানা সনিয়া জোবায়দা সাংবাদিকদের বলেন, ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনায় শহীদ হন সাদাকাতের বাবা েেমজর মুমিনুল ইসলাম সরকার। তার মৃত্যুর ১১ দিন পর আমাদের একমাত্র সন্তান সাদাকাতের জন্ম। আমাদের বিয়ের ৭ বছর পর ওর জন্ম। কিন্তু দুর্ভাগ্য সে তার বাবাকে দেখেনি, তার বাবাও সন্তানের মুখটা দেখতে পারেননি। আমাদের সঙ্গে যে নিষ্ঠুতা হয়েছে তা এখনও স্পষ্ট মনে আছে। এখন সবকিছু ভুলে একমাত্র ছেলেকে আঁকড়ে বেঁচে আছি।
তিনি আরো বলেন, আমার সন্তান আজও জানে না বাবা কেমন হয়। ও এখন ক্লাস থ্রি তে পড়ছে। মাঝেমধ্যেই বাবার সম্পর্কে নানান কথা জিজ্ঞেস করে। আমাদের যে ক্ষতি আর শূন্যতা তা কোন কিছুর বিনিময়েই পূরণ হবার নয়। এ ঘটনায় জড়িতদের সাজা খুব দ্রুত কার্যকরের দাবীও জানান সানজানা।
শহীদ মেজর মমিনুলের মেজো বোন জেবুন্নেসা সরকার সাংবাদিকদের বলেন, ভাই তো চলে গেলেন। কিন্তু তার সন্তানকে জেনো তার মতো মানুষ করতে পারি আমাদের এখন সেই চেষ্টা। আমরা যতই আদর সোহাগ দেই না কেন-তার বাবার অনুপস্থিতি তো পূরণ হবার নয়। তবে এ ঘটনার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি ছাড়া আর কোনো চাওয়া নেই আমাদের।
গতকাল সোমবার সকালে বনানীর সামরিক কবরস্থানে পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহে নিহতদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সাংবাদিকদের বলেন, পিলখানা হত্যাকান্ডের বিচার প্রক্রিয়া শেষ। এরইমধ্যে রায় হয়েছে। দ্রুত এ রায়ের বাস্তবায়ন হবে। পর্যায়ক্রমে অভিযুক্তদের শাস্তির আওতায় আনা হবে। যারা চলে গেছেন, তারা তো আর কোনোদিনও ফিরবেন না। কিন্তু স্বজনরা বিচার দেখে যেতে পারবেন। ন্যায়বিচারের মাধ্যমে এর পরিসমাপ্তি হবে।
পরে বিজিবির মহাপরিচালক বলেন, বিডিআর হত্যাকান্ডের পর এ বাহিনীর নাম ও পোশাক পরিবর্তন করা হয়েছে। সেই সঙ্গে এ দশ বছরে এ বাহিনীর মানসিকতা চেঞ্জ করা হয়েছে। এটি এখন আগের চেয়ে অনেক আধুনিকায়ন হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, বিডিআর আইন পরিবর্তন করে বিজিবি আইন ২০১০ প্রণীত হয়েছে। এ আইন অনুযায়ী এখন বিজিবি পরিচালিত হচ্ছে। বিজিবি এখন সুশৃঙ্খল বাহিনী। বিজিবির উপর অর্পিত দায়িত্ব পালনে বর্ডার সুরক্ষায় সদস্যরা যথেষ্টে আন্তরিক এবং সোচ্চার রয়েছে। উল্লেখ্য, রাজধানীর পিলখানায় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ বা বিজিবির (তৎকালীন বিডিআর) সদর দপ্তরে সংঘটিত হত্যাকান্ডের দশম বার্ষিকী সোমবার। ২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনায় ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জন নির্মম ও নিষ্ঠুরভাবে নিহত হন। বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনায় পৃথক মামলা হয়। এর মধ্যে বিদ্রোহ ও হত্যা মামলার বিচার কার্যক্রম শেষ হয়েছে। পুরান ঢাকার আলিয়া মাদ্রাসা মাঠে স্থাপিত বিশেষ আদালতে ২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর বিডিআর হত্যা মামলার রায় ঘোষণা করা হয়। এ মামলায় ৮৩৪ জন আসামির মধ্যে ১৫২ জনের মৃত্যুদন্ড ও ১৬১ জনকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড ও বাকিদের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেয়া হয়। এ ছাড়া বিদ্রোহের ঘটনায় অভিযুক্ত ৬০৪১ জনের মধ্যে ৫ হাজার ৯২৬ জনের বিভিন্ন দেয়াদে কারাদন্ড দেয়া হয়।



 

Show all comments
  • Ali Akbar ২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯, ১:০৪ এএম says : 0
    বাবা যে ছিল সত্যিকারের দেশপ্রেমিক । তাই তো ভারতের তাবেদারীত্বকারীরা তা সহ্য করতে পারিনি বিধায় মেরে ফেলেছে..
    Total Reply(0) Reply
  • Shepon Hussain ২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯, ১:০৪ এএম says : 0
    হে ৫৭ সেনা অফিসারদের সন্তানেরা, তোমরা বড় হও,শিক্ষিত হয়ে সেনাবাহিনীতে যোগ দাও। নিজ হাতে নিও পিতা হত্যার প্রতিশোধ!
    Total Reply(0) Reply
  • Fatema Akter Rubina ২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯, ১:০৪ এএম says : 0
    ওরা ভাল তাই
    Total Reply(0) Reply
  • Abdullah Ali ২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯, ১:০৫ এএম says : 0
    বাবাকে ওরা মারল কেন? এই শিশুটির মতো ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জন নির্মম ও নিষ্ঠুরভাবে নিহত পরিবারের এই কেন এর উত্তর প্রধানমন্ত্রী কি দিবেন?
    Total Reply(0) Reply
  • Md Shiraji ২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯, ১:০৫ এএম says : 0
    জবাব এক দিন বাংলার মাটিতে দিতে হবে ইনশা আল্লাহ্
    Total Reply(0) Reply
  • Jewel Plowen ২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯, ১:০৫ এএম says : 0
    হৃদয় বিদারক প্রশ্ন। উত্তর দিবে না কেউ। সবাই তো ক্ষমতার মহরে অন্ধ বোবা হয়ে আছে!!
    Total Reply(0) Reply
  • Nazmul Islam Bhuiyan ২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯, ১:০৫ এএম says : 0
    জবাব দেওয়ার মত কেউ থেকেও নাই
    Total Reply(0) Reply
  • Razzaque Ruhani ২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯, ১:০৫ এএম says : 0
    To break backbone of Army
    Total Reply(0) Reply
  • Asif Imtiaz Reza ২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯, ১:০৬ এএম says : 0
    বাবা মানে একজন বীর যোদ্ধার নাম, বাবা মানে একজন মহান অভিনেতার নাম, বাবা মানে চিনের প্রাচিরের চাইতেও বড় কোনো দেয়াল যার দ্বারা অাগলে রাখেন তার সন্তান দের, বাবা মানে মহাকাশের নিচে সবচেয়ে বড় অাশ্রয়স্থল, বাবা মানে অন্ধকার জীবনের সবচেয়ে পাওয়ার ফুল ম্যাগ লাইট যার অালোর শিখায় অালোকিত হয় প্রতিটা সন্তানের জিবন।তবে অামার খেত্রে একটু ভিন্ন।
    Total Reply(0) Reply
  • Nannu chowhan ২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯, ৮:৩৪ এএম says : 0
    Eai soto shishuder pitro hin o mohilader shami vai o potro hin korese jara inshallah eder foriader karone shotto eakdin prokash hobe proshashoner jara eaishob onnaikarider bohal tobiote rekhse ba ase tader mokhosh ommochito hobeInshallah...
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ