Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ভিআইপি যাত্রী না থাকায়!

চট্টগ্রাম-সিলেট ট্রেনযাত্রায় অশেষ যাতনা : টাইমটেবিল ঠিক থাকে না দুর্গন্ধে টেকা দায় : হিজড়া, গায়েন, ভিক্ষুক ও হকারের উৎপাত

শফিউল আলম | প্রকাশের সময় : ১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯, ১২:০৩ এএম

কথাবার্তায় বোঝা গেল তারা কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে বেড়াতে গিয়েছিলেন। তারা সিলেটি। ব্রিটেনে বসবাসরত বাংলাদেশী একটি বড়সড় পরিবার। বাচ্চা শিশু থেকে শুরু করে মধ্যবয়সী পুরুষ-মহিলারা সিলেট থেকে রেলপথে চট্টগ্রাম হয়ে সড়কপথে কক্সবাজার যান। আবার ফিরছেন চট্টগ্রাম-সিলেট ‘উদয়ন-৭২৩’ ট্রেনে করে। গত ১১ ফেব্রুয়ারি সোমবার রাত ৯টা ৪৫ মিনিটে যথাসময়েই ছাড়লো ট্রেন। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত (স্নিগ্ধা) কোচটিতে আমরাও সিলেটিদের সহযাত্রী। ট্রেন ছাড়ার অল্পক্ষণ পরেই কোচজুড়ে (বগি) অসহ্য দুর্গন্ধ। তা ক্রমেই বেড়ে চললো। দেখা গেল অনেকেই নাকে রুমাল চেপে আছেন।
আবার কোচের শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রটি যে ‘সচল’ আছে যাত্রীদের তা জানান দিতে কল-কারখানার ভারী মেশিনের মতো বিকট আওয়াজ। একটি কোলের শিশু কাঁদছে তারস্বরে। মা শিশুটিকে সামলাতে গিয়ে হিমশিম অবস্থা। প্রচন্ড দুর্গন্ধের উৎস খুঁজতে গিয়ে দেখা গেল, বাথরুমে বমি, মল-মূত্র আর ময়লা-আবর্জনায় ভর্তি। তখনও কোনো অ্যাডেনটেন্ডের খোঁজ মিললো না। যেতে যেতে নিশিরাতে একের পর এক স্টেশন থেকে মামাবাড়ির মতোই উঠছে বিনা টিকিটের যাত্রীরা। আশেপাশে খালি সিট পেলেই বসে যাচ্ছে। তখন কেউ কেউ ফিসফিস করে বলছে ওরা যাত্রীবেশে পাকাচোর অতিশয়! এ অবস্থায় যাত্রীরা মালামাল চুরি যাওয়ার ভয়ে অস্থির। ঘুমাতে পারছে না কেউই। অবশেষে বসন্তদিনে ‘ফুলেল সুবাস’ ভেবে নিয়েই দুর্গন্ধকে সঙ্গী করে সকাল ৭টায় গন্তব্য সিলেটে ফিরেই যেন মিললো শান্তি!
১৪ ফেব্রুয়ারি বৃহস্পতিবার সকাল ১০টা ১৫ মিনিটে সিলেট-চট্টগ্রাম ‘পাহাড়িকা এক্সপ্রেস-৭২০’ ট্রেনের যাত্রী হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত সেই ‘ফুলেল দুর্গন্ধের’ কথা বারবার ভেবে মনে হচ্ছিল এবারও তাই হবে! শত বারণ সত্তে¡ও রেলস্টেশন পর্যন্ত নিজেই পৌঁছে দেবেন বলে ‘কড়া’ সিদ্ধান্ত আগের রাতেই জানিয়ে দিলেন সিলেটের দেশবরেণ্য সাংবাদিক-কলামিস্ট, সমাজহিতৈষী আফতাব চৌধুরী। যিনি সেই ১৯৮৬ সালের মার্চে পরিচয়পর্ব থেকেই বড়ভাইতূল্য এক আদর্শস্থানীয় নির্মোহ মানুষ। তার পাশে বসে গাড়িতে যেতে যেতে ৩৬০ আউলিয়ার পুন্যস্মৃতি-ধন্য আধ্যাত্মিক নগরী সিলেটে জনব্যস্ততার মাঝে কোথাও দেখা গেলো না ‘ভ্যালেন্টাইন দিবসের’ আড়ালে বাণিজ্য কিংবা বাড়াবাড়ি রকমের কোনো অপসংস্কৃতির কান্ডকীর্তি। যদিও পর্যটনের ভর মওসুমে সিলেট এখন দেশী-বিদেশী পর্যটকে ভরপুর।
সুরমা সেতু পার হতেই নিচের দিকে ধু ধু বালুচর দেখে প্রমত্তা নদীটির মতো বুক হাহাকার করে উঠলো। ১২ ফেব্রুয়ারি দৈনিক ইনকিলাবে প্রকাশিত সাংবাদিক ফয়সাল আমিনের ছবিটির সাথে এ দৃশ্যেরই হুবহু মিল। কিছুদূর এগিয়ে বাস টার্মিনাল পার হতেই তীব্র যানজট চোখে পড়লো। তখন সিলেটেরই ‘আদিবাসী’ আফতাব চৌধুরী বলে উঠলেন, ঠিক পথে যাচ্ছি তো? আশ্চর্য হয়ে বলি, কেন? তার জবাবটি আরও আশ্চর্যের। সিলেটের সবখানে ঘোরা হলেও দীর্ঘদিন রেলস্টেশনে যাননি। কারণ সিলেট থেকে ট্রেনে ভ্রমণ তিনিসহ সিলেটিদের আকর্ষণ নয় বরং বিকর্ষণই করে। খুবই কষ্টকর ও বিরক্তিকর ট্রেনভ্রমণ।
বিদায় নিয়ে ট্রেনে পাহাড়িকা ট্রেনে নিজ আসনে বসে পাশের ভদ্রলোক রেলওয়ে স্টাফের সাথে কথা হলো। বললেন, ছাড়ার টাইম যদিওবা সকাল ১০টা ১৫ মিনিট, তবে অধিকাংশ দিনে ট্রেনটি ছাড়ে বিলম্বে। এটাই নাকি ‘নিয়ম’। দুপুর ১২টা ২টাও হয়ে যায়। যাই হোক। প্রায় সময়মতো ট্রেন ছাড়তেই তিনি বললেন আজকে তো ভাগ্য ভালো! এক-দুই ঘণ্টা ধরে দেখা গেল ট্রেন চলছে, কিন্তু গতিটা যেন ‘ঘোড়ায় চড়িয়া মর্দ হাঁটিয়া চলিল’র মতোই। নির্ধারিত ছাড়াও অনির্ধারিত অনেক স্টেশনে থেমে পড়ছে। পাশে আরেক যাত্রী চট্টগ্রামের মাঝারি গোছের ব্যবসায়ী। তিনি জানান, ‘আমি এই রুটে নিয়মিত আসা-যাওয়া করি। চট্টগ্রাম-সিলেট রেলপথে কোনো ভিআইপি যাত্রী চলাচল করেন না। তাই তো ট্রেনের চরম দুর্গতি আর যাতনা। এসব আমাদের গা সওয়া হয়ে গেছে। কারণ উপায় নেই’।
সিলেটের পাহাড়-টিলা আর শ্রীমঙ্গলের লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান ভেদ করে ‘পাহাড়িকা’ ট্রেন ঢিমেতালে চলছে আর যথেচ্ছ থামছে। যখন যে স্টেশনে থামছে সেখানে ওঠানামা করছে যাত্রী বা বিনাটিকিটের যাত্রীরাই শুধু নয়। হিজরা, দোতারা হাতে গায়েন, বাউল, ভিক্ষুক, হকারদের উৎপাতে যাত্রীরা যেন জিম্মি। পশ্চিমা দেশের কয়েকজন পর্যটক যাত্রীও ছিলেন ট্রেনটিতে। অত্যন্ত নিম্নমানের এমনকি বাসি-পঁচা খাবার অযোগ্য খাবার তাও গলাকাটা দামে অবাধে বিক্রি হতে দেখা গেল ট্রেনে। এক্ষেত্রে ক্ষুধা নিরাবরণের জন্য যাত্রীদের কেউ তা চিবোচ্ছেন আবার অধিকাংশ যাত্রী ক্ষুধার্ত থাকাই শ্রেয় পন্থা মনে করছেন। রেলপুলিশ, নিরাপত্তা কর্মী, অ্যাটেনডেন্ট চোখে পড়েনি কোথাও। চট্টগ্রাম-সিলেট ভোগান্তির ট্রেনেযাত্রায় যাত্রীদের অভিযোগ শুনবে কে? নির্ধারিত প্রতিটি স্টেশনে ট্রেনটি থামলো দীর্ঘ বিলম্বে। শেষমেষ ১১ ঘণ্টায় পৌঁছালো গন্তব্য চট্টগ্রাম রেলস্টেশনে। ততক্ষণে যাত্রীরা কাহিল।
সেই ব্রিটিশ আমলে দেড় শতাধিক বছর পূর্বে বন্দরনগরী চট্টগ্রামের সিআরবি ভবনে প্রতিষ্ঠিত অবিভক্ত ‘আসাম-বেঙ্গল রেলওয়ে’র আওতায় চট্টগ্রাম-সিলেট রেলপথে ট্রেন চলাচলের শুরু। গোড়ার দিকে বনেদী অবস্থান বজায় রাখলেও এই রেলপথ এখন যাত্রীদের হরেক রকমের দুর্ভোগ আর যাতনার বাহনে পরিণত হয়েছে। এই রেলপথে অধিকাংশই চট্টগ্রাম ও সিলেট নগরীর যাত্রী। অথচ মেইল ট্রেনের পাশাপাশি চট্টগ্রাম-সিলেট-চট্টগ্রাম রেলপথে একজোড়া আন্তঃনগর এবং অন্তত দিনে একটি বিরতিহীন ট্রেন চালু থাকলে ৩শ’ ৫৮ কিলোমিটারের এই রেলপথ ৭ থেকে ৮ ঘণ্টায় অনায়াসে পাড়ি দেয়া সম্ভব। তাহলে দুই আধ্যাত্মিক নগরীতে দেশী-বিদেশী পর্যটকদের যোগাযোগ, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষার্থীদের আসা-যাওয়া অনেক সহজ হয়ে উঠবে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: রেল

২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ