বিশ্বময় যখন মানবজাতি অজ্ঞতা কুসংষ্কার শোষণ-নিপীড়নের উর্মিমালায় ডুবুডুবু হয়ে মুক্তির জন্য ত্রাহি-ত্রাহি রবে হাহাকার করছিল; তখনই অত্যুজ্জল আলোকবাতি মুহাম্মদ (স.) আরব মরুভূমিতে উদ্ভাসিত হন। মুক্তিকামী এ মহামানব জীবনের শুরুলগ্ন থেকেই শিরক-কুফরের অন্ধকারে নিমজ্জিত মানবসত্তাকে মুক্ত করতে প্রাণপন চেষ্টা করেন। জীবনের চল্লিশতম বছর ঐশীজ্ঞান প্রাপ্ত হয়ে মানুষের দ্বারে-দ্বারে হেদায়েতের অমর বাণী পৌঁছাতে গিয়ে বহন করতে হয় লাঞ্চনা-বঞ্চনা, নির্যাতনের স্ট্রীমরোলার। ধবধবে সাদা অপরূপ তনুশ্রী দেহটি রক্তিমবর্ণে সজ্জিত হতে হয়েছে। এ রক্তিম ইতিহাস অধ্যয়নে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের চোখে অশ্রæরভান টলমল করে উঠে।
এমনই একটি হৃদয়স্পর্শী বেদনা মিসৃত মর্মর ইতিহাসের অধ্যায় হলো; তায়েফের রক্তে ভেজা মরুপথ। নবুওয়াতের দশম বছরের শাওয়াল মাসে নবী (স.) ক্রীতদাস যায়েদ বিন হারেস রা. কে সঙ্গে নিয়ে তায়েফ যান। রাসূল (স.) তায়েফবাসীর মধ্যে দশ দিন অবস্থান করেন। এ দিনগুলিতে তিনি তাদের সকল নেতৃস্থানীয় ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে তাদের সামনে দীনের দাওয়াত পেশ করেন। কিন্তু তারা বলল তুমি আমাদের শহর থেকে বেরিয়ে যাও। শুধূ এর ওপরই তারা ক্ষান্ত হননি। শহরের ইতর ছেলে-পেলেকে তাঁর পেছনে কুকুরের মতো লেলিয়ে দিলো। তিনি যখন শহর থেকে বের হয়ে যাওয়ার ইচ্ছা করলেন তখন সেই ইতর ছেলে-পেলে আর গোলামগুলি তাঁর পিছু নিয়ে তাকে বিভিন্ন অশ্লীল গালমন্দ আর চেঁচামেচি করতে লাগল। তাদের আওয়ায পেয়ে সবাই সমবেত হয়ে রাসূল (স.)-র ওপর পাথর মারতে শুরু করল। কটু ভাষায় তাঁর হৃদয় না ভাঙলেও কঠিন পাথরের কঠোর আঘাতে মানবীয় পা মুবারক ঠিকই ফেটে যায়। পায়ে পরিহিত জুতোদুটি তাজা রক্তে লাল হয়ে উঠল। যায়েদ বিন হারেস রা. তাঁকে পাথর বৃষ্টি থেকে রক্ষা করার সকল পন্থা ও প্রচেষ্টা ব্যয় করে যান, আর এতে করে তাঁর মাথায়ও গভীর যখমের সৃষ্টি হলো। এভাবে পাথর বৃষ্টির মধ্যে দৌড়াতে দৌড়াতে তায়েফ থেকে তিন মাইল দূরে রবীআর দুই ছেলে উতবা ও শাইবার আঙ্গুর বাগানের দেয়ালের নিচে আশ্রয় নিলেন।
দেয়ালের নীচ থেকে বের হয়ে রাসূল (স.) মক্কার পথ ধরলেন। তাঁর হৃদয়াকাশে তখন হতাশার কালো মেঘে ছেয়ে গেছে। হাজারো স্বপ্ন আর সাধের সূর্যটা অস্তপাটে বিদায়ের হাতছানি দিচ্ছে। আশার প্রদীপগুলো একে একে সব নিভে গেছে। তাঁর হৃদয়টা ভেঙে চৈত্রের দুপুরের মাটির মতো ফেটে চৌচির হয়ে গেছে। আশার বীণায় তন্ত্রীগুলো এলোমেলো হয়ে গেছে। এভাবে তিনি যখন করনুল মানাযিল নামক স্থানে পৌঁছলেন তখন জিবরাঈল আ. পাহাড়ের ফেরেশতাকে সঙ্গে নিয়ে তাঁর সামনে আবির্ভূত হলেন। এসে বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! অনুমতি দিন! তাদেরকে আবু কুবাইস ও কুআইকিয়ান পাহাড়ের মাঝে ফেলে এক চাপ দিয়ে শেষ করে দিই। রাসূল কারীম (স.) শান্ত কণ্ঠে জবাব দিলেন, না! তাদেরকে মারবেন না। আমার একান্ত আশা; হয়তো আল্লাহ পাক তাদের বংশধরদের মধ্যে এমন অগণিত অসংখ্য মানুষ পাঠাবেন যারা একমাত্র আল্লাহ তা‘য়ালার ইবাদত করবে। যারা তাঁর সঙ্গে কোনো কিছু শরীক করবে না।-আর রাহীকুল মাখতূম, আল্লামা সফিউর রহমান মোবারকপুরী রহ., বুখারী শরীফ।
ইমাম বুখারী র. সহীহ বুখারীতে উরওয়া বিন যুবাইর এর সূত্রে রেওয়ায়েত করেন, আয়েশা রা. তাকে বলেছেন যে, তিনি একবার রাসূল (স.) কে জিজ্ঞাস করলেন যে, উহুদ যুদ্ধের দিনের চেয়েও কোনো কঠিন দিন কি আপনার জীবনের ওপর দিয়ে অতিবাহিত হয়েছে? তিনি জবাবে তায়েফের এই মর্মাহত অবস্থা বর্ণনা করেন।
মহা সত্যের বাণী পৌঁছাতে গিয়ে এরূপ অবর্ণনীয় নিপীড়নের স্বীকার হয়েও তাঁর দয়ার কায়ায় প্রস্ফুটিত হয় ক্ষমা ও আশার বাণী। জিবরাঈল ফেরেশতার প্রশ্নের জবাবে রাসূল (স.)-র এই উত্তর শুনলেই বোঝা যায় কতটা বিশাল ও অনন্য ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন নবীজী আমার! তাঁর আখলাক-চরিত্র ছিল কতটা মহান! এমন এক গভীর দরিয়া যার কূল-কিনারা ও গভীরতা দুনিয়ার কোনো মানুষের পক্ষে তলিয়ে দেখা সম্ভব নয়। পরিশেষে ভগ্ন হৃদয়ের ব্যথাটুকু কবির ভাষায় অশ্রæসিক্ত চোখে নিসৃত হয়...
অন্ধ বধির ভ্রান্ত কাফির
তীর ছুঁড়িলি কার ও গায়!
সে নবীকে করলি আঘাত
মারলি পাথর সর্বগায়।
রক্তে রাঙ্গা নবীর জেসেম
তপ্ত মরু ভেসে যায়।