দেশে দেশে রোজার উৎসব
মাহে রমজান আরবী নবম মাসের নাম। চাঁদের আবর্তন দ্বারা যে এক বৎসর গণনা করা হয়,
ইসলাম মানব মর্যাদা প্রতিষ্ঠার সর্বজনস্বীকৃত বিশ্বজনীন ধর্ম। প্রতিবন্ধীরা যেহেতু মানবজাতির অংশ তাই সুস্পষ্টভাবেই একথা ভাবা যায় যে, ইসলাম তাদের ব্যাপারে অবশ্যই বিশেষ ব্যবস্থাপনার কথা বলবে এবং তা বিশেষভাবে পালনের তাগিদ প্রদান করবে। এ কথা খুবই স্বাভাবিক যে, কোনো সভ্য সমাজ প্রতিবন্ধীদের নগণ্য করে কিংবা জীবনযাপনের সম্মানযোগ্য অবস্থান থেকে আলাদা করে রাখার ধারণাও করতে পারে না। একটি বিষয় খুবই স্পষ্ট যে, সামাজিক জীবনে সাধারণ ব্যক্তিবর্গ যেসব অধিকারের যোগ্য সমাজের অংশ হিসেবে প্রতিবন্ধীরাও ঐসব অধিকার লাভের যোগ্যতা অবশ্যই রাখে। তথাপি সাধারণ লোকদের স্বীকৃত অধিকার ছাড়াও ইসলাম প্রতিবন্ধীদের যেসব বিশেষ অধিকার প্রদান করেছে, তা নিম্নে সংক্ষেপে আলোকপাত করা হলো :
এক. সাধারণ সমাবেশ বা সভাতেও তাদের প্রতি বিশেষ দৃষ্টি প্রদান করা।
ইসলামে জীবনের সকল কর্মকান্ডে প্রত্যেক ব্যক্তিকে বর্ণ, বংশ ও সামাজিক অবস্থানের ব্যাপারে পার্থক্যহীনভাবে সমান মর্যাদা দেয়া হয়েছে। সাধারণত আমাদের সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে, প্রতিবন্ধীদের জীবনের সাধারণ লেনদেন ও মেলামেশায় পিছিয়ে রাখা। কিন্তু পবিত্র কোরআনুল হাকিমে মহান আল্লাহতায়ালা এই দৃষ্টিভঙ্গির তীব্র নিন্দা করে মানবাত্মার মাহাত্ম্য ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
একদা আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মাদ (দ:) মুশরিক নেতৃবৃন্দকে ইসলামের দাওয়াত দিচ্ছিলেন, এমতাবস্থায় অন্ধ সাহাবী হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতূম (রা:) তাঁর খেদমতে উপস্থিত হলেন। অন্যদের সাথে কথাবার্তায় ব্যস্ত থাকায় নবীজী (দ:) কর্তৃক হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাকতূমের প্রতি দৃষ্টিদানের সুযোগ হয়নি। আর এ বিষয়কে উপলক্ষ করে নিম্নোক্ত আয়াত অবতীর্ণ হয়, ‘তার চেহারায় বিষন্নভাব প্রকাশ পেল এবং (নূরানী) মুখ ফিরিয়ে নিলেন এ কারণে যে, তার নিকট এক অন্ধ ব্যক্তি উপস্থিত হয়েছে (যে তার কথার মাঝখানে প্রশ্ন আরজ করে বসেছে)। আপনার কি জানা আছে? হয়তো সে (আপনার দৃষ্টিতে আরো) পবিত্র হতো। কিংবা (আপনার) উপদেশ গ্রহণ করত, অতঃপর উপদেশ তাকে (আরো) উপকৃত করত’ (সুরা আবাসা, আয়াত নং-১-৪)
উক্ত বরকতপূর্ণ আয়াতসমূহের মাধ্যমে প্রিয় নবী (দ:)-এর উম্মতদের এ শিক্ষা দেয়া হয়েছে যে, ১. অক্ষম ব্যক্তিরা চলাফেরায় অন্য লোকদের তুলনায় অধিক সাহায্য-সহযোগিতা লাভের অধিকারী। তাদের অন্য লোকদের ওপর অগ্রাধিকার দিতে হবে এবং তাদের এড়িয়ে চলা যাবে না।
২. মানমর্যাদা নির্ধারণ সামাজিক অবস্থান কিংবা চাল-চলন দেখে করা যাবে না বরং এর জন্য ব্যক্তিত্ব, খোদাভীরুতা, আত্মশুদ্ধি ও পুণ্যের আবেগ-স্পৃহার মানদন্ড স্থির করতে হবে।
দুই. মেলামেশায় নীতি ভিন্নতার অধিকার প্রদান :
ইসলাম অন্যান্য বিষয়ের ন্যায় জীবনযাত্রা ও মেলামেশার ক্ষেত্রেও বিশেষ নীতি ও শৃঙ্খলা দান করেছে। দৈনন্দিন লেনদেন, আত্মীয়দের সাথে সদ্ভাব ও প্রিয়জনদের ঘরে আসা-যাওয়ার সুস্পষ্ট বিধান দেয়া হয়েছে। কিন্তু এ বিষয়টি বিশেষভাবে চিন্তাযোগ্য যে, কুরআনুল কারীমে প্রতিবন্ধীদের ঐ নীতিমালা থেকেও স্বতন্ত্র রাখা হয়েছে। পবিত্র কুরআনুল কারীমে বর্ণিত হয়েছে- ‘অন্ধের জন্য বাধা-বিপত্তি নেই, আর না খোঁড়াদের কোনো অসুবিধা আছে, না রুগ্নদের কোনো গুনাহ হবে এবং তোমাদের মধ্যে কারো জন্য (বাধা আছে) এতে যে তোমরা আহার করবে আপন সন্তানদের ঘরে অথবা আপন পিতার ঘরে অথবা আপন মাতার ঘরে অথবা আপন ভাইয়ের ঘরে অথবা আপন বোনদের ঘরে অথবা আপন চাচাদের নিকট অথবা আপন ফুফুদের নিকট অথবা আপন মামাদের নিকট অথবা আপন খালাদের নিকট অথবা যেসব ঘরের চাবিসমূহ তোমাদের হাতের মুঠোয় রয়েছে অথবা আপন বন্ধুদের ঘরে; তোমাদের প্রতি এ ব্যাপারে কোনো গুনাহ নেই একত্রে আহার করলে অথবা পৃথক পৃথকভাবে; অতঃপর যখন তোমরা কোনো ঘরে প্রবেশ করো তখন তোমরা তাদের (পরিবারবর্গকে) সালাম দাও। সাক্ষাতের সময় মঙ্গল কামনা স্বরূপ (যা) আল্লাহর নিকট থেকে কল্যাণময়,পবিত্র। এভাবেই আল্লাহপাক আয়াতসমূহ বিশদভাবে বর্ণনা করেন, যাতে তোমরা (শরয়ী বিধান ও জীবনাচার) বুঝতে পার। (সুরা আন নূর, আয়াত নং-৬১)
তিন. জিহাদ ও প্রতিরক্ষামূলক দায়িত্ব বর্জনের অধিকার প্রদান :
মহা পবিত্র আল-কুরআনে ইসলামী নেতৃত্বের সম্প্রসারণ ও সত্য দ্বীনের বিজয় প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টার লক্ষ্যে জিহাদে অংশগ্রহণকে ঈমান ও ইস্তিকামাত (অটলতা) পরীক্ষার মূল মানদন্ডরূপে বর্ণনা করা হয়েছে এবং এ মৌলিক দায়িত্ব এড়িয়ে চলা ও পরিহার করাকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির কারণ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু অক্ষম বিকলাঙ্গ লোকদের এ মহান মৌলিক জিম্মাদারী থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে।
আল কুরআনে ইরশাদ হচ্ছে, ‘না অন্ধের জন্য কোনো অপরাধ আছে, না খোঁড়া ব্যক্তির জন্য কোনো পাপ রয়েছে, না ব্যধিগ্রস্তের ওপর কোনো জবাবদিহিতা আছে (যে তারা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে পারেনি)। আর যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের (দ:) আনুগত্য করে, আল্লাহ তাকে এমন বাগানসমূহে নিয়ে যাবেন, যেগুলোর নিম্নদেশে নহরসমূহ প্রবহমান এবং যে ফিরে যাবে তাকে বেদনাদায়ক শাস্তি দেবেন। (সুরা আল ফাতাহ, আয়াত নং-১৭)
উল্লিখিত সংক্ষিপ্ত আলোচনার পর এ কথাও বলা যেতে পারে যে, ইসলামী আইন প্রতিবন্ধীদের জন্য দায়িত্ব-কর্ম বর্জনকেই তাদের মৌলিক অধিকার বলে ঘোষণা করেছে। ইসলামের নৈতিক শিক্ষায় নিম্নোক্ত বিষয়গুলো সুস্পষ্ট :
১. ইসলাম প্রতিবন্ধীদের সামাজিক জীবনে একটি সম্মানযোগ্য অংশ হিসেবে বিবেচনার শিক্ষা দেয়।
২. ইসলাম এ ব্যাপারে শিক্ষাদান করে যে, বিকলাঙ্গদের বিশেষভাবে দেখাশোনা করতে হবে এবং জীবনের কোনো ক্ষেত্রে কোনোভাবেই তাদের আলাদা রাখার ধারণাও করা যাবে না।
৩. পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে তাদের ওপর এমন কোনো দায়িত্বের বোঝা চাপানো যাবে না, যা পালন করা তাদের পক্ষে আদৌ সম্ভব নয়।
৪. যাবতীয় অধিকার আদায়ে অক্ষমদের অগ্রাধিকার দিতে হবে যাতে করে জীবনযাপনে তাদের সুবিধাপ্রাপ্তিতে কোনো ধরনের বাধা না থাকে।
আর এগুলোই হলো ইসলামের চিরন্তন শিক্ষা। তাই আসুন আমরা আমাদের পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ও বৈশ্বিক জীবনে এই মহান শিক্ষার বাস্তবায়ন করতে সচেষ্ট হই।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।