মাত্র ৪৮ ঘণ্টায় দেউলিয়া হলো যুক্তরাষ্ট্রের ২য় বৃহত্তম ব্যাংক
চলতি সপ্তাহের বুধবারও আর দশটি সাধারণ ব্যাংকের মতো বাণিজ্যিক ও আর্থিক লেনদেন সম্পন্ন করেছে যুক্তরাষ্ট্রের সিলিকন ভ্যালি ব্যাংক (এসভিপি), যা দেশটির দ্বিতীয় বৃহত্তম বাণিজ্যিক ব্যাংক
এক বছর আগে এই দিনে পাকিস্তানের দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর করাচিতে গুলিতে নিহত হয়েছিলেন নকিবুল্লাহ মেহসুদ নামে এক যুবক। প্রথমদিকে পুলিশ দাবি করেছিল যে, মেহসুদ পাকিস্তানি তালেবানের একজন কট্টর সদস্য। সন্ত্রাসীদের গোপন আস্তানায় ঘেরাও দিয়ে অভিযান চালানোর সময় তিনি নিহত হয়েছেন।
কিন্তু তার পরিবার, বন্ধুবান্ধব ও কিছু মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠন এই দাবি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। তারা বলছে, মেহসুদ শুধুই একজন নিরাপদ দোকানি এবং উচ্চাকাঙ্খী মডেল।
সরকার এ নিয়ে তদন্তের নির্দেশ দিলো। তদন্ত শুরু করলো পুলিশি কমিটি। তাতে কোনো গোলাগুলি (শুট আউট) বা সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
ফলে কমিটি নিশ্চিত হলো যে, পুলিশের ভুয়া এনকাউন্টারে নিহত হয়েছেন মেহসুদ। এমন এনকাউন্টারে জড়িত থাকার অভিযোগ পাকিস্তানি নিরাপত্তা রক্ষাকারীদের বিরুদ্ধে মাঝে মাঝেই শোনা যায়। তবে মেহসুদকে হত্যায় জড়িত থাকা অফিসারদের বিচারের আওতায় আনা হয়েছে এবং সেই বিচার এখনও চলমান।
অতীতে এই হত্যাকান্ডের মতো বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডের অভিযোগ কর্তৃপক্ষ নিয়মিতভাবে অস্বীকার করে গেছে। ফলে নিরাপত্তা রক্ষাকারীদের দায়মুক্তির অধীনে তাদের কাজ করতে অনুমতি দেয়া হয়েছে। মেহসুদের ঘটনায় সরকার দ্রুত ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হয়েছে। তাকে নিয়ে তার নিজের শহর মাকিনের ওয়াজিরিস্তানে খুব কম পরিচিত একটি আন্দোলন গড়ে উঠেছে। সেই আন্দোলনের নাম : ‘দ্য পস্তুন তাহাফ্ফুজ মুভমেন্ট’ (পিটিএম)। এর অর্থ হলো পস্তুন সুরক্ষা আন্দোলন।
পস্তুন জাতির নানারকম বঞ্চনার বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পিটিএম আন্দোলন চালু করেছেন মানবাধিকার বিষয়ক কর্মী মানজুর পাসতিন। এই পস্তুন জাতিটি পাকিস্তানে দ্বিতীয় বৃহৎ জাতিগোষ্ঠী। তাদের বেশির ভাগই বসবাস করেন পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে আফগানিস্তান সীমান্ত এলাকার কাছে।
প্রায় দুই দশক ধরে ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের’ ধকল বহন করছে এই পস্তুনরা। ২০০১ সালের ৯/১১ সন্ত্রাসী হামলার পর যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা আফগানিস্তানে আগ্রাসন চালায়। ওই সময় আফগানিস্তানের সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোর সদস্যরা সীমান্ত অতিক্রম করে পাকিস্তানের ভিতরে প্রবেশ করে। পস্তুনদের বসবাস করা এলাকায় আশ্রয় নেয় তারা। এর ফলে পাকিস্তানি সেনারা ওই এলাকাকে সন্ত্রাসীমুক্ত করতে অভিযান চালানো শুরু করে। কিন্তু সেখানে সন্ত্রাসী কর্মকান্ড বন্ধ করার চেয়ে নিরপরাধ সাধারণ মানুষের ওপর সামরিক অভিযান বাড়তে থাকে। পাকিস্তানজুড়ে পস্তুনদের সন্ত্রাসী হিসেবে দেখা শুরু হয়, তারা নিজেরাও সন্ত্রাসের শিকার হওয়া সত্ত্বেও।
করাচিতে মেহসুদকে হত্যার পর ওয়াজিরিস্তান থেকে ইসলামাবাদ পর্যন্ত লংমার্চের ডাক দিলেন মানজুর পসতিন। তার ডাকে শুধু একজন মানুষকে হত্যার বিচার দাবিতে নয়, একই সঙ্গে সব পাস্তুন, যারা পাকিস্তানে বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন, তাদের হাজার হাজার সদস্য ওই লং মার্চে যোগ দিলেন।
এই লং মার্চ দ্রুততার সঙ্গে সারাদেশে অধিকার আন্দোলনে রূপ নিলো। ফলে জন্ম হলো পিটিএম। সারা দেশে র্যালি করে পাসতিন ও তার সমর্থকরা প্রশ্ন তুললেন তাদের এলাকা থেকে সেনাবাহিনী কেন জঙ্গিদের সরাতে ব্যর্থ হচ্ছে? তারা আরো প্রশ্ন তুললেন, পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ কি আসলেই এমন গ্রুপগুলোকে উৎখাত করতে চায় কিনা তা নিয়ে।
এ সময় তারা বেশির ভাগ সময়ে একটি স্লোগান ব্যবহার করেছেন। তা হলো ‘এই সন্ত্রাসের পিছনে কি কোনো ইউনিফর্ম রয়েছে’। এর মধ্য দিয়ে সেনাবাহিনীর দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। অভিযোগ আছে, সন্ত্রাসী ও সেনাবাহিনীর মধ্যে বোঝাপড়া আছে।
সব বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডের নিরপেক্ষ তদন্ত দাবি করে পিটিএম। একই সঙ্গে জোরপূর্বক গুম বন্ধ করার দাবি জানানো হয়। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অপহরণকে এই টার্ম ব্যবহার করে বর্ণনা করা হয়। এ ছাড়াও পাসতিন ও তার সমর্থকরা পাকিস্তান সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করা শুরু করলেন যেন, উপজাতি এলাকা শাসন করতে যেসব কুখ্যাত আইন রয়েছে তা সংস্কার করা হয়। কারণ, এসব আইন মৌলিক মানবাধিকার লঙ্ঘন করে। এমন আইনের অধীনে একজন মাত্র ব্যক্তির অপরাধে পুরো পরিবার, গ্রাম এমনকি উপজাতিগোষ্ঠীকে শাস্তি দেয়া হয়।
এসব ক্রমবর্ধমান দাবির দিকে দৃষ্টি না দিয়ে পাকিস্তান সরকার দমনপীড়নকেই বেছে নেয়।
পিটিএম আন্দোলন নিয়ে রিপোর্ট করা বন্ধ করে দিয়েছে পাকিস্তানি মিডিয়া। এই আন্দোলনের বহু সদস্য ও নেতাকে বার বার গ্রেফতার করেছে পুলিশ। কোথাও র্যালি করতে চাইলে নেতাদের পাকিস্তানের সেই এলাকায় প্রবেশ করা থেকে বিরত রাখা হয়। সম্প্রতি পিটিএমের কিছু সদস্যের পাকিস্তান ছাড়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে।
এক সরকারি ব্রিফিংয়ে সেনাবাহিনীর মিডিয়া বিষয়ক মুখপাত্র পিটিএমকে পাকিস্তান বিরোধী এজেন্ডা নিয়ে কাজ করার দায়ে অভিযুক্ত করেছেন। অভিযোগ করা হয়েছে, পিটিএম বিদেশি শত্রু রাষ্ট্রের সহায়তায় এসব করছে। সমালোচকদের নিন্দা জানাতে পাকিস্তানি সেনারা মাঝে মাঝেই এই ধরনের কৌশল নিয়ে থাকে।
কিন্তু এই কণ্ঠ স্তব্ধ করার ও আন্দোলনকে স্তব্ধ করতে পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় যে প্রচেষ্টা, ঘটেছে তার উল্টো। র্রাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন এমন অভিযান বা দমনপীড়নের ফলে পিটিএম আন্দোলন আরো বেশি মানুষকে আকৃষ্ট করেছে এবং তাদের সভাসমাবেশে যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি মানুষের সমাগম হচ্ছে।
পিটিএম সব সময়ই বলে আসছে তাদের আন্দোলন অহিংস। কিন্তু এখন আতঙ্ক দেখা দিয়েছে যে, এই আন্দোলনকে দমন করতে এমন কঠোর ও অব্যাহত কৌশলের ফলে সংঘাতময় অবস্থার সৃষ্টি করতে পারে, যা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। এমন ঘটনা অতীতেও পাকিস্তানে দেখা গেছে।
অতীতে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) অধিবাসীরা একই রকম অধিকার আন্দোলন শুরু করেছিলেন। যা শেষ পর্যন্ত স্বাধীনতা আন্দোলনে রূপ নেয় এবং ১৯৭১ সালে সৃষ্টি হয় স্বাধীন বাংলাদেশ।
১৯৬০ এর দশকে পূর্ব পাকিস্তানে বসবাসকারী বাঙালি জনগোষ্ঠী, যারা ওই সময়ে দেশের সবচেয়ে বড় জাতিগোষ্ঠী ছিলেন, তাদেরকে জেনারেল আইয়ুব খান নেতৃত্বাধীন পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার অবজ্ঞা করেছিল। তাদের বঞ্চনা ও তারা যে অবিচারের অভিযোগ তুলেছিল তার প্রতি কর্ণপাত করার পরিবর্তে ক্ষুব্ধ সেই জনতার বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেছিল সেনাবাহিনী। এর ফলে সশস্ত্র প্রতিরোধ আন্দোলন শুরু করতে বাধ্য হয় বাঙালিরা। এর ফলে পাকিস্তান ভেঙে যায়।
প্রায় ৫০ বছর পরে দেখে মনে হচ্ছে, পাকিস্তানের অভিজাত শাসক শ্রেণি অতীতের ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে নি। দৃশ্যত তারা আবারও সেই একই ভুল করছে, যা থেকে ১৯৭০ এর দশকে জাতির জন্য বেদনা, রক্তপাত এবং অপূরণীয় ক্ষতি এনে দিয়েছিল।
এখন পিটিএম তার আন্দোলনের এক বছর পূর্ণ করেছে। তাই এখন পাকিস্তানের বেসামরিক ও সামরিক নেতৃবৃন্দের সর্বাগ্রে গুরুত্ব দেয়া উচিত পস্তুন জাতিগোষ্ঠীর বৈধ দাবিগুলোর দিকে দৃষ্টি দেয়া। তাদের দাবি মেনে নেয়া, যা পাকিস্তানের সংবিধানের মধ্যেই আছে। একই সঙ্গে যারা তাদের মৌলিক অধিকারের দাবিতে আন্দোলন করছে অবিলম্বে তাদের বিরুদ্ধে বিচার বন্ধ করা।
যদি তা না হয়, তাহলে এরই মধ্যে বিভক্ত হয়ে পড়া দেশের ভাঙনে একটি অনুঘটকের মতো হয় উঠতে পারে পিটিএম। আর তাতে পাকিস্তান আরেকটি জাতীয় বিপর্যয়ের দিকে এগিয়ে যেতে পারে।
( লেখক তাহা সিদ্দিকী, পুরস্কার বিজয়ী পাকিস্তানি সাংবাদিক। বর্তমানে তিনি ফ্রান্সে নির্বাসিত জীবন যাপন করছেন। অনলাইন আল জাজিরা থেকে অনুবাদ)
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।