Inqilab Logo

মঙ্গলবার ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

বাংলাদেশের পার্লামেন্ট নির্বাচন ভারতের নয়া কূটনীতির পরীক্ষা

সুবীর ভৌমিক (সাউথ এশিয়ান মনিটর) | প্রকাশের সময় : ২০ ডিসেম্বর, ২০১৮, ৬:৫০ পিএম

গত দুই সপ্তাহে দিল্লীর স্নায়ু শীতল হয়েছে এবং নরেন্দ্র মোদি প্রশাসনের শুরুর দিকে শক্তি প্রদর্শনকারী, অতি জাতীয়তাবাদী কৌশলের বদলে নতুন সতর্ক কূটনীতির মধ্যে আস্থা খুঁজে পেয়েছে দিল্লী। এই কৌশলের মূলে আছেন পররাষ্ট্র সচিব বিজয় গোখলে এবং দেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো তাকে সমর্থন দিচ্ছে। এ প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে প্রতিবেশী দেশগুলোতে সরাসরি কোন পক্ষ না নেয়া, গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মধ্য দিয়ে যারাই ক্ষমতায় আসবে তাদের সাথেই কাজ করার মানসিকতা প্রদর্শন। একই সাথে জটিল পরিস্থিতিতে দীর্ঘদিনের পুরনো মিত্রদের সতর্কভাবে পৃষ্ঠপোষকতাও করা হচ্ছে। কিন্তু দীর্ঘ দিনের বন্ধুদের প্রতি তাদের বার্তাটা পরিস্কার: ভারত তোমার জন্য নির্বাচন জিতবে না এবং যে কোন মূল্যে অগ্রহণযোগ্য প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে কাউকে ক্ষমতায় থাকার জন্য পৃষ্ঠপোষকতা দেবে না।

মালদ্বীপের সাবেক প্রভাবশালী প্রেসিডেন্ট আব্দুল্লা ইয়ামিন চীনের অতি ঘনিষ্ঠ হওয়ায় ভারত তাকে পছন্দ করে না। তিনি এখন ক্ষমতার বাইরে এবং নতুন সরকারের নেতৃত্ব দিচ্ছেন যে ইব্রাহিম মোহাম্মদ সলিহ, তিনি ভারতপন্থী জোরালো মনোভাব দেখিয়েছেন। সলিহ বলেছেন যে, ভারত মালদ্বীপের ঘনিষ্ঠতম প্রতিবেশী। তাছাড়া প্রথম বিদেশ সফরে তার গন্তব্যও ছিল ভারত। ইয়ামিনের শাসনামলে ভারত ও মালদ্বীপের মধ্যে যে দূরত্ব তৈরি হয়েছিল, সেগুলো মিটিয়ে ফেলার ঘোষণা দিয়েছেন তিনি।

মোদির সাম্প্রতিক মালদ্বীপ সফরে সলিহ সরকারের প্রতি ভারতের পূর্ণ সমর্থন জানানো হয়েছে এবং সলিহের ফিরতি সফরে মোদির সাথে সাক্ষাতে দিল্লীর সাথে দ্বীপ রাষ্ট্রটির তিক্ত সম্পর্কের ইতি ঘটেছে। সলিহ সুস্পষ্ট কারণে চীন থেকে পুরোপুরি দূরে সরে যেতে পারবে না কিন্তু চীনা-অর্থায়নের কিছু প্রকল্পের ব্যাপারে প্রশ্ন তুলে তিনি দিল্লীর মনজয় করেছেন।

শ্রীলংকায় প্রেসিডেন্ট মৈত্রিপালা সিরিসেনা যখন প্রধানমন্ত্রী রানিল বিক্রমাসিঙ্গেকে দুই মাস আগে বরখাস্ত করেন এবং মাহিন্দা রাজাপাকসাকে নতুন প্রধানমন্ত্রী করার আকাঙ্ক্ষা জানান, তখন ভারত অনেকটা যেন ঘুমের ঘোরে ছিল। রাজাপাকসাকে দিল্লীতে চীনের ঘনিষ্ঠ বিবেচনা করা হয়। ২০১৫ সালের নির্বাচনে পরাজয়ের জন্য তিনি ভারতীয় গোয়েন্দাদের দোষারোপ করেছিলেন। তিনি অভিযোগ করেছিলেন যে, ভারতের ‘র’ তার দলে ভাঙন সৃষ্টি করে সিরিসেনা-রানিল জোট গড়েছিল যেটা তাকে পরাজিত করেছে। তাই রাজাপাকসার ফিরে আসাকে চীনা তৎপরতার বিজয় হিসেবে দেখা হয়েছে, যেহেতু এখানে বেইজিংয়ের বিশাল গোয়েন্দা শক্তি সক্রিয় রয়েছে।

রানিল অনেকটা শেখ হাসিনার মতো – দ্বীপরাষ্ট্রটিতে ভারতের সবচেয়ে বিশ্বস্ত মিত্র সে, পূবদিকে যেমন বিশ্বস্ত বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। একটা পর্যায়ে যখন তিনি তাকে বহিস্কারকারীর বিরুদ্ধে রাজনৈতিক ও আইনি চ্যালেঞ্জ করছিলেন, বিক্রমাসিঙ্গে তখন অনেকটা খোলামেলাভাবেই ভারতের হস্তক্ষেপ প্রত্যাশা করেছেন, কিন্তু ‘শ্রীলংকার গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর উপর পূর্ণ আস্থা’ রাখতে বলা হয়েছে তাকে। তাকে আইনী চ্যালেঞ্জে যাওয়ার পাশাপাশি সড়কে জন বিক্ষোভ এবং পার্লামেন্টে রাজাপাকসার বিরুদ্ধে অনাস্থা ভোটে যাওয়ার ব্যাপারে উৎসাহ দেয়া হয়েছে। ৫১ দিনের অনিশ্চয়তার পর রাজাপাকসা পদত্যাগে বাধ্য হন এবং বিক্রমাসিঙ্গে তার পদে পুনর্বহাল হন। সুপ্রিম কোর্টের দুই বিচারপতির আদেশের পর রাজাপাকসার পক্ষে ক্ষমতায় থাকাটা অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। আর রাজাপাকসার বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব পরিস্থিতি বিক্রমাসিঙ্গের অনুকূলে নিয়ে আসে।

বেইজিং ঘোষণা দিয়েছিল যে শ্রীলংকায় যে কোন নেতার সাথে কাজ করতে তারা প্রস্তুত যিনি ক্ষমতায় থাকবেন। তবে, ভারত গোপনে বিজেপি এমপি সুব্রামানিয়াম স্বামীর মাধ্যমে রাজাপাকসার সাথেও যোগাযোগ রক্ষা করেছিল। রাজাপাকসা ক্ষমতার বাইরে থাকাকালে মোদির সাথে তার সাক্ষাতের পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছিলেন সুব্রামানিয়াম। বৈঠকে তারা ‘যেটা চলে গেছে, সেটা গেছে’ ধরনের একটা ইতিবাচক সিদ্ধান্তেও এসেছিলেন। এর মাধ্যমে দিল্লী একটা খারাপ পরিস্থিতির জন্যও প্রস্তুতি নিয়েছিল – যদি রাজাপাকসা ক্ষমতায় টিকে যান।

গোখলের কৌশল আগামী ৩০ ডিসেম্বরের পার্লামেন্ট নির্বাচনের সময় বাংলাদেশে কিছু পরীক্ষার মুখে পড়বে। মালদ্বীপ ও শ্রীলংকা দুই জায়গাতেই ভারতের বন্ধুরা নৈতিকভাবে একটা শক্ত অবস্থানে ছিল। তারা যাদের বিরুদ্ধে লড়ছিলেন তাদের অবস্থান ছিল দৃশ্যত গণতন্ত্রের বিপক্ষে। বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল এবং সফল গণতন্ত্রের দেশ হিসেবে এই সব ব্যক্তিদের সমর্থন দেয়াটা ভারতের জন্য সহজ ছিল। বাংলাদেশে, শেখ হাসিনার সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কটা ভেস্তে গেছে, কারণ ভারত যে উচ্চ নৈতিক অবস্থান কামনা করে, সেটা এখানে নেই। কারণ পশ্চিমা দেশগুলো হাসিনার বিরুদ্ধে দেশকে একদলীয় রাষ্ট্রে পরিণত করার অভিযোগ করেছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপিয় দেশগুলোকে এটা বোঝাতে ভারতের বেগ পেতে হচ্ছে যে, হাসিনা ক্ষমতায় থাকলে সেটা আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য ভালো হবে। কিন্তু বাংলাদেশে বিজেপি-আরএসএস জুটি বিএনপি নেতৃত্বের সাথে একটা যোগাযোগ রক্ষা করছে এবং তারাও অমিত শাহসহ বিজেপি নেতাদের সাথে সাক্ষাতের জন্য নিয়মিত প্রতিনিধি দল পাঠাচ্ছে। এই সম্পর্ক বিএনপিকে নির্বাচনে প্রতিযোগিতা করার শক্তি যোগাচ্ছে এবং নির্বাচনটাকে কিছুটা গ্রহণযোগ্য চেহারা দিয়েছে।

হাসিনার প্রতি ভারতের বার্তা অত্যন্ত স্পষ্ট – বিরোধীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের আয়োজন করলে আমরা তোমাদের সমর্থন দেবো। দিল্লী গ্রহণযোগ্য প্রার্থীদের মনোনয়ন দেয়ার যে পরামর্শ দিয়েছিল, সেটাতে কোন গুরুত্ব দেয়া হয়নি। সিটিং এমপিদের নিয়েই নির্বাচনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন হাসিনা, যাদের অনেকেরই গ্রহণযোগ্যতা অনেক কম অথবা যাদের অধিকাংশই ২০১৪ সালের জানুয়ারির নির্বাচনে কোন রকম প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছাড়াই বিজয়ী হয়েছিল। কিছু কিছু ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনা হয়েছে। কয়েকজন বিত্তশালী নির্বাচনে মনোনয়ন পেয়েছেন এবং কয়েকজন স্বচ্ছ, মেধাবি এবং সৎ প্রার্থী মনোনয়ন পাননি।

বিশিষ্ট মেডিকেল ব্যক্তিত্ব ড. প্রাণগোপাল দত্ত এবং আরও কিছু প্রতিশ্রুতিশীল তরুণ নেতা আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাননি। বিষয়টি নিয়ে দিল্লী সন্তুষ্ট নয়। কারণ সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের মৃত্যুর পর প্রাণগোপাল দত্ত আওয়ামী লীগের মধ্যে হিন্দু সম্প্রদায়ের গ্রহণযোগ্য প্রতিনিধি হতে পারতো বলে মনে করে তারা। তাই দিল্লী আগের মতো হাত ধরাধরি অবস্থানে নেই: হাসিনা যদি নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে পারে এবং এটাকে গ্রহণযোগ্য চেহারা দিতে পারে, তাহলেই ভালো। যদি তিনি ব্যর্থ হন, তাহলে দুর্বল প্রার্থী দেয়ার দায়-দায়িত্ব তাকেই নিতে হবে এবং যেই ক্ষমতায় আসুক না কেন তার সাথে কাজ করবে দিল্লী। কিন্তু এর অর্থ হাসিনার বিরুদ্ধে কাজ করা নয়, ২০০১ সালে বাজপেয়ি প্রশাসনের সময় যেমনটা হয়েছিল।

আসলে, চীনারা সতর্ক বার্তা দিচ্ছে যে হাসিনা আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য ভালো এবং তার বিজয় বেইজিং এবং দিল্লী উভয়ের জন্যই লাভজনক কারণ (চীনের ইউনান প্রদেশের) কুনমিংয়ের সাথে কলকাতার বিসিআইএম অর্থনৈতিক করিডোর গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তার ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। ২০১৪ সালে, ভারত ও চীন একই অবস্থানে ছিল। তারা উভয়েই তখন হাসিনাকে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছে এবং নির্বাচনকে ‘সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এবার, দিল্লী আশা করছে যাতে বেইজিং বাস্তবতাটা দেখতে পায়। এটা যদি কাজ করে, চীনের সাথে বন্ধুত্ব এবং দক্ষিণ এশিয়ায় প্রভাব বিস্তারের লড়াইয়ে তাদের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা এড়ানোর জন্য গোখলের কৌশল যদি সফল হয় (উহান চুক্তি অনুযায়ী আফগানিস্তানে যৌথ প্রকল্পে কাজ করবে ভারত ও চীন), তাহলে সেটা দিল্লীর বিশ্বস্ত মিত্র শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় টিকে যেতে সাহায্য করবে। কিন্তু প্রার্থী বাছাইয়ে ব্যর্থতা এবং ব্যাপক সরকার-বিরোধী মানসিকতার জন্য তিনি যদি ঝরে পড়েন, তাহলে দিল্লীর হাতে আরো পরিকল্পনা রয়েছে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: জাতীয় সংসদ নির্বাচন

৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ