Inqilab Logo

রোববার ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৭ আশ্বিন ১৪৩১, ১৮ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরী

ছাড় দেবে না সরকার

স্টালিন সরকার | প্রকাশের সময় : ২৮ নভেম্বর, ২০১৮, ১২:০২ এএম

‘আমি জিতলে জিতে যায় মা’ টিভির এই বিজ্ঞাপন শিশুদের কাছে খুবই জনপ্রিয়। ’৯০-এর রাজনৈতিক পট-পরিবর্তনের পর কোনো দলীয় সরকারের অধীনে এটাই প্রথম সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন। বিরোধী দলগুলো যখন নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি করে; তখন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ থেকে বলা হয় দলীয় সরকারের অধীনে ‘নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য’ নির্বাচনের আয়োজন করে বিশ্ববাসীকে তাক লাগিয়ে দেয়া হবে। দেশবাসীর বিশ্বাসও ছিল লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড সৃষ্টির মাধ্যমে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ব্যবস্থা করে দেশের মানুষ ও বিশ্ববাসীকে ‘চমক’ দেখানো সম্ভব কেবল শেখ হাসিনার পক্ষ্যেই। সব দলের অংশগ্রহণে নিরপেক্ষ নির্বাচনে ভোটে কে হারলো আর কে জিতলো সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ। কিন্তু সবচেয়ে বড় পুরস্কার পাবে আওয়ামী লীগ। দলটি রাজনৈতিকভাবে বিজয়ী হবে। কিন্তু এখনো নির্বাচনে সব দলের জন্য সমান সুযোগ ঈতরি হয়নি। প্রশাসনযন্ত্র সাজানো এবং ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের বক্তব্য-আচরণে মনে হয় লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড গঠনে কোনো ছাড় দেয়ার চিন্তা সরকারের নেই। ‘আমি জিতলে জিতে যায় মা’ বিজ্ঞাপনের মতো নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হলেই যে আওয়ামী লীগের বিশাল রাজনৈতিক বিজয় ঘটবে সেদিকে ভ্রæক্ষেপ নেই। গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের বদলে নির্বাচনে বিজয়ী হতে যেন তারা জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছে।
চীন, অস্ট্রেলিয়া, ফ্রান্স, কানাডা, সুইডেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের কয়েকজন প্রতিনিধি, কূটনীতিক ও রাষ্ট্রদূত ২৬ নভেম্বর সাবেক প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তারা নির্বাচনী পরিবেশ সম্পর্কে তাঁর মনোভাব জানতে চান। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সঙ্গে নির্বাচনী জোটভুক্ত এই প্রবীণ রাজনীতিক বিদেশী কূটনীতিকদের কাছে নির্বাচনী পরিবেশের চালচিত্র তুলে ধরে বলেন, ‘সংসদ নির্বাচনের পরিবেশ এখনো সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নয়। লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি হয়নি। প্রশাসনের বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ আছে’। তিনি যথার্থই বলেছেন। ঐক্যফ্রন্টের ড. কামাল হোসেন, বিএনপি, বামধারার দল, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, নির্বাচন বিশেষজ্ঞদের এখনো ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ হয়নি অভিযোগ রাজনৈতিক বক্তব্য হিসেবে উড়িয়ে দিলেও ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে নির্বাচনী জোটবদ্ধ বি. চৌধুরীর বক্তব্য উড়িয়ে দেয়ার কোনো সুযোগ নেই। ফলে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের দলীয় মনোনয়নপত্র বিতরণের সময় যে ‘নির্বাচনে আমরা জিতবোই। এখন শুধু ভোটের আনুষ্ঠানিকতা মাত্র’। ইসির স্ববিরোধী কথাবার্তা শুনে ওবায়দুল কাদের ‘যথার্থই’ বলেছেন। মূলত অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য সব পক্ষ নির্বাচনের প্রস্তুতি নিলেও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ কার্যত: এখনো বিজয়ের মুডেই রয়েছে। মানুষের ভোট দেয়ার নিশ্চয়তার পরিবেশ এখনো সৃষ্টি হয়নি। সেটা করার গরজ ইসির দেখা যাচ্ছে না।
প্রশাসনযন্ত্র এখনো ক্ষমতাসীন দলের নিয়ন্ত্রণে। তারা যেভাবে প্রশাসন সাজিয়েছেন সেটাই বহাল। প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদা, কমিশনার কবিতা খানম যে ভাষায় কথাবার্তা বলছেন তাতে ভোটের আগেই আওয়ামী লীগ নেতাদের জিতে যাওয়ার মানসিকতা তৈরি হচ্ছে। আওয়ামী লীগ ও ১৪ দলীয় জোটের মনোনয়ন প্রত্যাশীরাও ‘প্রার্থী হতে পারলেই বিজয় নিশ্চিত’ এই চিন্তা-চেতনা থেকে মনোনয়ন পেতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন।
৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠেয় নির্বাচন উপলক্ষে ইসি ব্যাপক কর্মযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু নিরপেক্ষ পরিবেশ সৃষ্টির দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ নেই। ইসির নিজস্ব কর্মকর্তাদের বদলে জেলা প্রশাসকদের রিটার্নিং অফিসার নিয়োগ দিয়েছে। তিনজন সচিবসহ ৯২ জন ডিসি-এসপির বিরুদ্ধে সুনিদৃষ্ট অভিযোগ তুলে তাদের নির্বাচনী কার্যক্রম থেকে সরিয়ে নেয়ার আবেদন করেছে ক্ষমতাসীন মহাজোটের প্রধান প্রতিপক্ষ ঐক্যফ্রন্ট। ইসি সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ করেনি। বরং রিটানিং অফিসার, প্রিজাইডিং অফিসার-সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে বৈঠক এবং নির্বাচন কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ অনুষ্ঠানে ইসি থেকে বার্তা দেয়া হয়েছে তাতে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরিতে তাদের কোনো আগ্রহ দেখা যায়নি। বরং ইসি সচিব কবিতা খানম বার্তা দিয়েছেন ‘পৃথিবীর কোনো দেশে একশ’ ভাগ নিরপেক্ষ নির্বাচন হয় না’। যারা গ্রাম পর্যায়ে সহকারী প্রিজাইডিং ও পোলিং অফিসারের দায়িত্ব পালন করবেন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা সেই স্কুল-কলেজ-মাদরাসার শিক্ষক-শিক্ষিকাদের রাজনৈতিক পরিচিতির সম্পর্কে খোঁজ-খবর নিয়ে ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করছে। অভিযোগ রয়েছে রাজনৈতিকভাবে অন্যমতালম্বীদের বাদ দিয়ে কিন্ডার গার্ডেনের আওয়ামী লীগপন্থী শিক্ষকদের পোলিং অফিসারের তালিকাভুক্ত করা হচ্ছে। গায়েবী মামলা এমনকি তফসিল ঘোষণার পর মামলা ও গ্রেফতার অব্যাহতে উদ্বেগ প্রকাশ করে বিএনপি থেকে সুনিদৃষ্ট অভিযোগ নির্বাচন কমিশনে জানানো হলেও ইসি নির্বিকার। ইসি থেকে মামলা ও গ্রেফতার না করার জন্য উপদেশ দিলেও সিইসি বলেছেন, ‘পুলিশ যা করছে তা ইসির হয়েই করছে। ইসির বাইরে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী কিছুই করছে না’। ইসি এক বক্তব্য কার্যত আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর নির্বাচনে স্টেকহোল্ডার দলগুলোর নেতাকর্মীদের গ্রেফতার-হয়রানীকে জায়েজ করে নেয়া।
নির্বাচনের সার্বিক পরিস্থিতি যখন এই; তখন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগে নির্বাচনের আগেই বিজয়ের মুডে থাকবে সেটাই স্বাভাবিক। ’৯০ রাজনৈতিক পট-পরিবর্তনের পর সব দলের অংশগ্রহণে এটাই প্রথম রাজনৈতিক দলের নিয়ন্ত্রিত সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচন। নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে রাজনৈতিক দলগুলোর দাবির মুখে সরকারের নীতি-নির্ধারকদের পক্ষ থেকে প্রচার করা হয় দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু-নিরপেক্ষ নির্বাচন করে আওয়ামী লীগ ইতিহাস সৃষ্টি করতে চায়। শেখ হাসিনার মতো বিশ্বমানের নেত্রী যখন এমন আভাস দেন, তখন সবার প্রত্যাশা গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হবেই। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে গণভবনের সংলাপে তিনি সে প্রতিশ্রুতিও দেন। এমনকি নির্বাচনকালীন সরকার ছোট আকারের হবে ঘোষণাও দেয়া হয়। কিন্তু নির্বাচনকালীন সরকার ছোট করা হয়নি। তফসিল ঘোষণার পর নির্বাচনী প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পর ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ সৃষ্টির যে দাবি দেশ ও আন্তর্জাতিক পর্যায় থেকে করা হয় সেটাতেও ভাটা পড়ে যায়। নিরপেক্ষ প্রশাসন গড়ে তোলার বদলে কার্যত দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অধিক তৎপর হয়ে গেছেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে যা ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের মতোই। নিরপেক্ষ নির্বাচনের লক্ষ্যে সব দলকে সমান সুযোগ দিতে নিরপেক্ষ প্রশাসন গড়ে তোলা সময়ের দাবি। দেশ-জাতি এবং আন্তর্জাতিক মহলকে সে প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে।
বিশ্ব সম্প্রদায় তথা দাতাদেশ, সংস্থা ও উন্নয়ন সহযোগী রাষ্ট্রগুলোর দৃষ্টি একাদশ নির্বাচনের দিকে। অথচ ক্ষমতাসীনদের নির্বাচনী জোটের শরীক দলের প্রধান নেতা অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরী বিদেশীদের বলছেন সুষ্ঠু-নিরপেক্ষ নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি হয়নি। নির্বাচনের আর মাত্র এক মাস বাকি। লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরিতে আর কতদিন লাগবে? মনে হচ্ছে রাজনৈতিক বিজয়ের চেয়ে সরকারি দল নির্বাচনে বিজয়কে অধিক গুরুত্ব দিয়ে আরো কঠোর হচ্ছে। কিন্তু ইসির দায়িত্ব নিরপেক্ষ রেফারিং। ইসি সেটা করছে কি? নির্বাচনী মাঠ যে নিরপেক্ষ হয়নি এবং সরকার যে নির্বাচনী ফলাফল অনুকূলে নেয়ার ব্যাপারে দৃঢ় তা আওয়ামী লীগ অনুসারী বুদ্ধিজীবীদের চোখ এড়ায়নি। আওয়ামী লীগ অনুসারী বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউটের সাবেক সভাপতি স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন বলেছেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন- এবার নির্বাচন হবে সুষ্ঠু, সুন্দর ও গ্রহণযোগ্য। আমরা জানি, দেশের প্রধান যখন কিছু বলেন, সবকটি বিভাগ তাকে সাপোর্ট দিতে বাধ্য। বাস্তবে আমরা কী দেখতে পাচ্ছি? সাপোর্ট হচ্ছে না। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, বিনা কারণে জেলে নেয়া হবে না। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যের পরে অহরহ গায়েবী কেস হয়েছে, গ্রেফতার হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর কথাগুলো কোন বিশেষ ব্যক্তিবর্গ মানতে দিচ্ছে না, মানাতে চাচ্ছে না’।



 

Show all comments
  • Kazi Jamal ২৮ নভেম্বর, ২০১৮, ১:৩৯ এএম says : 0
    ...হাসিনা নিপাত যাক গনতন্ত্র মুক্তি পাক।
    Total Reply(0) Reply
  • S M Mizanur Rahman ২৮ নভেম্বর, ২০১৮, ১:৪০ এএম says : 0
    so Sad
    Total Reply(0) Reply
  • এ.এস শমির ২৮ নভেম্বর, ২০১৮, ১:৪১ এএম says : 0
    আবারও ভূল করছে বিএনপি।নতুন চাল দিচ্ছে সরকার।
    Total Reply(0) Reply
  • Kamrul Hasan Sarkar ২৮ নভেম্বর, ২০১৮, ১:৪১ এএম says : 1
    যাই হোক এবার বিএনপি কঠোর অবস্থানেই আছে। সময় কথা বলবে
    Total Reply(0) Reply
  • Ameen Munshi ২৮ নভেম্বর, ২০১৮, ১:৪৪ এএম says : 0
    আবারও সেই অতি পুরনো প্রবাদ বাক্য বলতে হয়- বিচার মানি তালগাছ আমার। আওয়ামিলিগের যতক্ষণ প্রাণ আছে ততক্ষণ তালগাছ ছাড়বে না।
    Total Reply(0) Reply
  • Nannu chowhan ২৮ নভেম্বর, ২০১৮, ৮:৫৬ এএম says : 0
    Eai Awamiliger neta kormider gontontrer proti kono sroddaa nai, taderoi lok EC,ebong eai EC shob kisu korse Aowamiliger jetar jonno. shottikar orthe eder dara kono shushto nirbachon asha kora jaina...
    Total Reply(0) Reply
  • Islam ২৮ নভেম্বর, ২০১৮, ১:০১ পিএম says : 1
    শেখ হাসিনাকে তেল দিয়ে লাভ হবেনা। আওয়ামীলীগের পরাজিত হলে দেশে বিএনপি জামাত যে কি তান্ডব চালাবে শেখ হাসিনা তা ভালো করেই জানেন। তারেক জিয়ার দাপটে ড: কামাল তো বঙ্গোপসাগরে ঝাপ দিবে ।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: জাতীয় সংসদ নির্বাচন


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ