Inqilab Logo

মঙ্গলবার ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ফুল ভালোবাসা অশ্রুতে চিরবিদায়

গিটার জাদুকর আইয়ুব বাচ্চুর জানাজায় মানুষের ঢল 0 চট্টগ্রাম বাইশমহল্লা কবরস্থানে মায়ের পাশে দাফন

শফিউল আলম | প্রকাশের সময় : ২১ অক্টোবর, ২০১৮, ১২:০২ এএম

চাটগাঁর দূরন্ত ছেলে আইয়ুব বাচ্চু। দিনে দিনে এলআরবি (লিটল রিভার ব্যান্ড) খ্যাত বাচ্চু। বাংলাদেশের খ্যাতিমান গিটার জাদুকর কিংবদন্তী ব্যান্ডতারকা শিল্পী আইয়ুব বাচ্চু ‘এবি’ হয়ে ওঠা। অতঃপর জন্মের মতোই চরম সত্য মৃত্যু। গতকাল (শনিবার) হেমন্তের শান্ত বিকেলে লাখো ভক্ত আর ‘প্রিয় শহর’ চট্টগ্রামের মানুষের ফুলেল ভালোবাসা আর অশ্রæতে সিক্ত হয়ে পরম মমতায় চিরবিদায় নিলেন আইয়ুব বাচ্চু নিজেরই জন্মস্থানের সবুজ গাছ-গাছালীর ছায়াঘেরা মাটিতে। বন্দরনগরীর কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত চৈতন্যগলি বাইশ মহল্লা কবরস্থানে তার শেষ ইচ্ছে অনুযায়ী মায়ের পাশে দাফন করা হয়। আইয়ুব বাচ্চুর ইন্তেকালে চাটগাঁ পরিণত হয়েছে এক শোকবিধূর শহরে।
বাদ আসর নগরীর জমিয়তুল ফালাহ জাতীয় মসজিদ প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত হয় আইয়ুব বাচ্চুর চতুর্থ ও সর্বশেষ নামাজে জানাজা। উপস্থিত জনতার উদ্দেশে বক্তব্য রাখেন মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন। তিনি আইয়ুব বাচ্চুর রূহের মাগফিরাতের জন্য দোয়া ও ক্ষমা প্রার্থনা করেন। জানাজা শেষে লাশ নিয়ে যাওয়া হয় এনায়েতবাজার চৈতন্যগলি বাইশ মহল্লা কবরস্থানে। রাজধানী ঢাকা হতে বিমানযোগে তার লাশ এসে পৌঁছানো থেকে শুরু করে জানাযা, দাফন-কাফন সবকিছুই নিখুঁতভাবে সম্পন্ন করা হয় মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের সরাসরি তদারকিতে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মাধ্যমে। জানাজায় ইমামতি করেন জমিয়াতুল ফালাহ মসজিদের খতিব সৈয়দ আবু তালেব মোহাম্মদ আলাউদ্দিন।
জানাজায় শামিল হন আইয়ুব বাচ্চুর পিতা মো. ইসহাক, পুত্র আহনাফ তাজোয়ার, চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার মো. আবদুল মান্নান, পুলিশ কমিশনার মো. মাহাবুবর রহমান ছাড়াও বিশিষ্ট নাগরিক ও শিল্পীবৃন্দ, সর্বস্তরের অগণিত মানুষ। জানাযা অভিমুখী জন¯্রােতের কারণে দুপুরের পর থেকে সন্ধ্যা অবধি মহানগরীর বিভিন্ন সড়কে তীব্র যানজট সৃষ্টি হয়। জানাজামুখী ভিড় এবং যানজট সামাল দিতে গিয়ে পুলিশকে হিমশিম খেতে হয়।
বিকেল পৌনে ৩টায় সিটি কর্পোরেশনের লাশবাহী গাড়িতে আইয়ুব বাচ্চুর সাদা কাফনে মোড়ানো লাশ নগরীর দামপাড়া জমিয়তুল ফালাহ মসজিদ প্রাঙ্গণে জানাজার উদ্দেশে আনা হয়। সেখানে বাঁধভাঙা জোয়ারের মতো হাজারো ভক্তের ঢল নামে। নগরী ছাড়িয়ে বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের দূর-দূরান্ত থেকে ছুটে এসে অসংখ্য মানুষ তাদের প্রিয় তারকাশিল্পীকে শেষ বিদায় ও শ্রদ্ধা জানান।
‘বাবার জন্য দোয়া করবেন’
চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে গতকাল দুপুরে নগরীর পূর্ব মাদারবাড়িতে আইয়ুব বাচ্চুর নানার বাড়িতে নেয়া হয় তার লাশ। সেখানে হাজারো মানুষ ভিড় করেন। এ সময় উপস্থিত চাটগাঁবাসীর উদ্দেশে আইয়ুব বাচ্চুর ছেলে আহনাফ তাজোয়ার বললেন, আজ সকলের কাছে আমার একটাই চাওয়া। আর তা হলো আপনারা আমার বাবার জন্য দোয়া করবেন। যাতে তার বেহেশত নসিব হয়। তার ওপর কারো মনে ক্ষোভ-দুঃখ থাকলে মাফ করে দেবেন। আমার বাবা আপনাদের জন্য ভালোবাসা দিয়ে গেছেন’।
এর আগে চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে আইয়ুব বাচ্চুর মেয়ে ফাইরুজ সাফরা কান্নাজড়িত কণ্ঠে সাংবাদিকদের বলেন, ‘কিছু বলার মতো অবস্থা আমার নেই’। আইয়ুব বাচ্চুর লাশ গতকাল সকাল ১০টা ৫৫ মিনিটে চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ইউএস-বাংলার ফ্লাইটে এসে পৌঁছায়। সেখানে লাশ গ্রহণ করেন চট্টগ্রাম সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন। লাশের সঙ্গে ঢাকা থেকে আসেন আইয়ুব বাচ্চুর স্ত্রী ফেরদৌস আক্তার, ছেলেমেয়ে, স্বজনেরা।
পারিবারিক সূত্র জানায়, গত শুক্রবার দিবাগত রাত ১টায় আইয়ুব বাচ্চুর ছেলে আহনাফ তাজোয়ার কানাডা থেকে এবং রাত দেড়টায় মেয়ে ফাইরুজ সাফরা অস্ট্রেলিয়া থেকে ঢাকায় ফিরেন। এরপর রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালের হিমঘরে রাখা পিতার লাশ দেখে ছেলেমেয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন।
আইয়ুব বাচ্চুর নানার বাড়িতে
সকাল থেকেই চট্টগ্রামের সকল সড়ক রাস্তাঘাট যেন মিশে যায় একটি মোহনায়। আর তা হলো আইয়ুব বাচ্চুর নানার বাড়ি নগরীর পূর্ব মাদারবাড়িতে। সবার একটাই ইচ্ছে প্রিয় ব্যান্ডসঙ্গীত তারকাকে শেষবারের মতো এক নজর দেখা আর শ্রদ্ধা নিবেদন। সিটি কর্পোরেশনের বারণ উপেক্ষা করেই হাজারো মানুষ সেখানে ভিড় জমান। কারো হাতে ছিল একগুচ্ছ ফুল, ফুলের তোড়া কিংবা ‘রূপালী’ গিটারের আকৃতির ফুলের তোড়া, ‘গুরু তোমায় সালাম লেখা প্ল্যাকার্ড ব্যানার, চোখে ছিল বিদায়ের বেদনা মাখা অশ্রু আর অমলিন ভালোবাসা। দুপুর ১২টায় নানার বাড়িতে লাশ হয়ে আসেন আইয়ুব বাচ্চু, বেড়াতে নয়। সেখানে মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন লাশ হস্তান্তর করেন আইয়ুব বাচ্চুর মামা মো. আবদুল হালিমের কাছে।
এ সময় বাচ্চুর নিজবাড়ি নগরীর এনায়েত বাজার জুবিলি রোড ও বিভিন্ন স্থান থেকে আগত মানুষ স্মৃতিচারণ করেন আর চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ে পানি। সবার মুখে ছিল একই কথা, চট্টগ্রামের এই কৃতী সন্তান শিল্পী হিসেবে যেমন ছিলেন খ্যাতি ও জনপ্রিয়তার শীর্ষে তেমনি ছিলেন বিনয়ী। ছিলেন নিরবে এক দানবীর মানুষও। সবার সঙ্গেই হাসিমুখে কথা বলতেন। আপন করে নিতেন সহজেই। অনেকেই বলেছেন আইয়ুব বাচ্চুর সবচেয়ে বড় অবদান, হিন্দি-ইংরেজীসহ হরেক বিদেশী গানের আগ্রাসনের বিপরীতে দেশীয় সঙ্গীতের আবেদনকে বিশেষ করে নবীন প্রজন্মের কাছে আরও বেশী আকর্ষণীয় এবং প্রাণময় করে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছেন এই গুণী শিল্পী। তাই তিনি মরেও অমর হয়ে থাকবেন।
গত বৃহস্পতিবার ৫৬ বছর বয়সে আইয়ুব বাচ্চু ইন্তেকাল করেন। জনপ্রিয় এই ব্যান্ডতারকার মৃত্যুতে সারাদেশে শোকের ছায়া নেমে আসে। দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যান্ড এলআরবির দলনেতা আইয়ুব বাচ্চু ছিলেন একাধারে গায়ক, জাদুকরী গিটারবাদক, গীতিকার, সুরকার ও সংগীত পরিচালক। তিনি ১৯৬২ সালের ১৬ আগস্ট চট্টগ্রাম শহরের এনায়েতবাজারে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা মোহাম্মদ ইসহাক ও মা নূরজাহান বেগম। ১৯৭৮ সালে ফিলিংস ব্যান্ডের মাধ্যমে তার পথচলা শুরু। ১৯৮০ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত ছিলেন সোলস ব্যান্ডের লিড গিটারিস্ট। আইয়ুব বাচ্চুর অ্যালবাম এলআরবি বাজারে আসে ১৯৯২ সালে। সুখ, তবুও, ঘুমন্ত শহরে, ফেরারি মন, আমাদের বিস্ময়, মন চাইলে মন পাবে, অচেনা জীবন, মনে আছে নাকি নাই, স্পর্শ, যুদ্ধ এলআরবির জনপ্রিয় অ্যালবাম। তার একক অ্যালবামের মধ্যে কষ্ট, সময়, একা, প্রেম, তুমি কি, দুটি মন, কাফেলা, জীবনের গল্প জনপ্রিয়তার শীর্ষে। বেশ কটি চলচ্চিত্রে প্লে-ব্যাক করেন আইয়ুব বাচ্চু।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: আইয়ুব বাচ্চু


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ