Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

পোশাকের ক্রয়াদেশ ছুটছে বাংলাদেশে

ট্রাম্পের বাণিজ্যযুদ্ধ

হাসান সোহেল | প্রকাশের সময় : ১০ অক্টোবর, ২০১৮, ১২:০২ এএম

যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে বাণিজ্যযুদ্ধের ফলে মার্কিন পোশাক ক্রেতারা এখন নির্ভরযোগ্য উৎস হিসেবে বাংলাদেশের দিকে ঝুঁকছে। ট্রাম্পের বাণিজ্যযুদ্ধের প্রতিক্রিয়ায় বিশ্ব অর্থনীতিতে যে নতুন পোলারাইজেশন শুরু হয়েছে আর ব্যাপক ওলটপালট দেখা দিয়েছে, তাতে এশিয়ার আঞ্চলিক অর্থনীতি নতুন গুরুত্ব ও প্রভাবশালী ভূমিকা নিয়ে হাজির হচ্ছে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন।
বিজিএমইএ সূত্র জানিয়েছে, নতুন নতুন ক্রেতা পোশাকের ক্রয়াদেশ নিয়ে আসছে যারা যারা আগে কখনোই বাংলাদেশে কার্যাদেশ দেননি। পুরোনো ক্রেতারাও আগের চেয়ে ২০ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত ক্রয়াদেশ বাড়িয়েছে। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে তৈরি পোশাক খাতে রফতানি আয় আরও বাড়বে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাণিজ্যযুদ্ধ শুরুর পর দু-তিন মাস ধরে বাড়তি ক্রয়াদেশ নিয়ে বাংলাদেশের কারখানাগুলোতে আসছে মার্কিন ক্রেতাপ্রতিষ্ঠান। পোশাক মালিকরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতারা মূলত বেসিক আইটেম বা সস্তা পোশাকের ব্যবসা চীন থেকে সরিয়ে আনছেন। বাংলাদেশের উদ্যোক্তারা যদি কোনো সমস্যা না করেন, তাহলে দুই দেশের বাণিজ্যযুদ্ধ শেষ হলেও ক্রেতারা সহজে চলে যাবে না।
ক্ল্যাসিক ফ্যাশন কনসেপ্ট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শহিদুল্লাহ আজিম জানান, বাণিজ্যযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রের ক্রয়াদেশ বাড়ছে। নতুন ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ইনকোয়ারি আসছে। পুরোনো ক্রেতাদের মধ্যে আগে যারা দেড় লাখ পিস পোশাক তৈরি করত, তারা এখন তিন লাখ পিসের ক্রয়াদেশ দিচ্ছে।
বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের একক বৃহৎ বাজার যুক্তরাষ্ট্র। রানা প্লাজা ধসের পর থেকেই বাজারটিতে পোশাক রফতানি কমে যায়। দীর্ঘ ১৫ মাস পর চলতি বছরের জানুয়ারিতে এই বাজারে পোশাক রফতানি ঘুরে দাঁড়ায়। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে সবচেয়ে বেশি পোশাক রফতানি করে চীন। অটেক্সার তথ্যানুযায়ী, চীন গত বছর যুক্তরাষ্ট্রে দুই হাজার ৭০৩ কোটি ডলারের পোশাক রফতানি করে। এটি যুক্তরাষ্ট্রের মোট পোশাক আমদানির ৩৩ দশমিক ৬৭ শতাংশ। চলতি বছরের প্রথম আট মাসে এক হাজার ৭২৭ কোটি ডলারের পোশাক রফতানি করেছে, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে এক দশমিক ০৪ শতাংশ কম।
রফতানি আয় কমার সঙ্গে সঙ্গে চীনের বাজার হিস্যাও কমে ৩২ দশমিক ৯০ শতাংশে নেমেছে। এ বিষয়ে পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, বাণিজ্যযুদ্ধের সুবিধা আমরা একটু একটু করে পেতে শুরু করেছি। যুক্তরাষ্ট্রের অনেক ক্রেতাপ্রতিষ্ঠান চীন থেকে তাদের ব্যবসা সরিয়ে নিয়ে আসছে। পরিসংখ্যানে মনে হচ্ছে বাণিজ্যযুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ৪-৫ শতাংশ হিস্যা হারাতে পারে চীনের পোশাক রফতানিকারকেরা। তিনি বলেন, কারখানাগুলোতে অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানের পোশাক উৎপাদনের ভরা মৌসুম। আগামী দু-এক মাসের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে পোশাক রফতানি আয়ে ইতিবাচক পরিবর্তন দেখা যাবে।
এদিকে রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) সর্বশেষ প্রতিবেদনে দেখা গেছে, গত সেপ্টেম্বরে ৩১৪ কোটি ডলারের পণ্য রফতানি হয়েছে। এটি গত বছরের সেপ্টেম্বরের চেয়ে ৫৪ দশমিক ৬৪ শতাংশ বেশি। ওই সময়ে রফতানি হয়েছিল ২০৩ কোটি ডলারের পণ্য। যা দেশের রফতানি আয়ে বড় প্রবৃদ্ধি। অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি। বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে কখনো এক মাসে রফতানিতে এতো বেশি প্রবৃদ্ধি হয়নি। খাতওয়ারী তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, পোশাক রফতানিতেই আয় ৮১৯ কোটি ডলার। সে হিসাবে, মোট রফতানির প্রায় ৮২ শতাংশই এসেছে পোশাক খাত থেকে। আর এই খাতটিতেও প্রবৃদ্ধি ১৪ দশমিক ৬৬ শতাংশ। তবে অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে এই প্রবৃদ্ধি ছিল চার শতাংশের কাছাকাছি। অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে তৈরি পোশাকে রফতানি আয় ৮১৯ কোটি ডলার, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ১৪ দশমিক ৬৬ শতাংশ বেশি। ২০১৭-’১৮ অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে পোশাক রফতানি হয়েছিল ৭১৪ কোটি ডলারের। আর চলতি অর্থবছরে একই সময়ে গত অর্থবছরের চেয়ে পোশাক পণ্যের রফতানি বেড়েছে ১০৫ কোটি ডলার। এদিকে, অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে (জুলাই-আগস্ট) পোশাক পণ্যে রফতানি আয় ছিল ৫৭৩ কোটি ডলার। তখন আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রবৃদ্ধি ছিল তিন দশমিক ৮২ শতাংশ।
এছাড়া অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে নিটওয়্যার রফতানি হয়েছে ৪২০ কোটি ডলার। খাতটিতে আগের বছরের তুলনায় প্রবৃদ্ধি ১২ দশমিক ২৭ শতাংশ। প্রথম তিন মাসে ওভেন গার্মেন্ট রফতানি হয়েছে ৩৯৮ কোটি ডলারের, প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৭ দশমিক ৩০ শতাংশ। হোম টেক্সটাইলে রফতানি আয় ২০ কোটি ডলার, প্রবৃদ্ধি চার দশমিক ৮০ শতাংশ। বাকি আয় এসেছে বেড কিচেন, টয়লেট ও অন্যন্য খাত থেকে। অর্থাৎ পোশাক রফতানিতে মাস ব্যবধানে প্রবৃদ্ধি বেড়েছে ১০ শতাংশেরও বেশি।
বিজিএমইএ সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ২০১৭ সালে সেপ্টেম্বরে ঈদ ছিল। তাই সে বছরের তুলনায় চলতি বছর সেপ্টেম্বরে রফতানি আয়ে প্রবৃদ্ধি বেশি হয়েছে। তবে রফতানি আয় খুব একটা বাড়েনি।
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই সভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন বলেন, মৌসুমের ওপর নির্ভর করে রফতানি আয়। ফলে প্রথম তিন মাসের রফতানি আয়ে প্রবৃদ্ধিতে সুখবর দেখা যাচ্ছে। প্রবৃদ্ধিটা ভালো হওয়াই স্বাভাবিক। এখন প্রতিযোগিতার জায়গাটা যদি আমরা ধরে রাখতে পারি, তাহলে আমরা আরও ভালো করব।
জানা গেছে, বাণিজ্য যুদ্ধের কারণে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার পাঁচটি দেশের পণ্যে আমদানি শুল্ক কমিয়েছে চীন। বিশ্বের অর্থনৈতিক পরাশক্তি চীনের এই পদক্ষেপকে বাংলাদেশের রফতানি খাতের জন্য শুভ মনে করছেন দেশের ব্যবসায়ীরা। সম্প্রতি সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টের এক প্রতিবেদনে দক্ষিণ কোরিয়া, ভারত, বাংলাদেশ, লাওস ও শ্রীলংকার কিছু পণ্য আমদানিতে চীনের শুল্ক ছাড়ের কথা উঠে আসে। ২০০১ সালে স্বাক্ষরিত এশিয়া প্যাসিফিক ট্রেড এগ্রিমেন্টের আওতায় এই পদক্ষেপ নিয়েছে চীন।
চীনের এ উদ্যোগ বাংলাদেশের রফতানি খাতের জন্য ‘ইতিবাচক’ ভূমিকা রাখবে বলে মনে করেন বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন। বাংলাদেশের পোশাক খাত চীনসহ আরও কয়েকটি দেশে আগে থেকেই ‘ডিউটি ফ্রি’ সুবিধা পেয়ে থাকে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এখন ট্যারিফ নীতিতে ইতিবাচক পদক্ষেপ রফতানির সম্ভাবনাকে আরও বাড়াবে।
চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যিক বিরোধের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র বড় অর্থনীতির দেশ। চীনের পণ্যের ওপর ট্যারিফ আরোপের পদক্ষেপ সেই দেশে তেমন প্রভাব না ফেললেও চীনের বাজারে বেশ প্রভাব পড়বে। চীন থেকে যুক্তরাষ্ট্রে রফতানির আকার বেশ বড়। তাই তারা অন্যান্য দেশের সঙ্গে এ ধরনের পদক্ষেপ নিয়ে বাণিজ্যিক সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা চালাবে।
চলতি বছরের শুরু থেকেই যুক্তরাষ্ট্র ও চীন একে অন্যের পণ্যে একের পর এক শুল্ক আরোপ করছে। বেইজিংয়ের ‘মেধাস্বত্ব চুরিকে’ কারণ দেখিয়ে ১৫ জুন ট্রাম্প চীনা পণ্যে ২৫ শতাংশ হারে শুল্ক বসানোর ঘোষণা দেন।
অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে তুলা ক্রয়ে সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, চীন যুক্তরাষ্ট্রের তুলায় বাড়তি শুল্ক আরোপের ফলে যুক্তরাষ্ট্রের তুলা ক্রয়ে বাংলাদেশ কিছু সুবিধা পেতে পারে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের বৃহত্তম তুলা রফতানিকারক দেশ। চীন ২৫ শতাংশ তুলা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করে। সে দেশ থেকে প্রতি বছর এক বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি তুলা আমদানি করে চীন। কিন্তু বাণিজ্য যুদ্ধের প্রভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তুলার দামে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
আন্তজার্তিক তুলা বাজারের তথ্যনুযায়ী, তুলা আমদানিতে বিশ্বের বৃহত্তম দেশ বাংলাদেশ। প্রতি বছর বাংলাদেশ তিন বিলিয়ন তুলা আমদানি করে। যার মধ্যে ১০ শতাংশ আসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ কটন অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মেহেদী আলী বলেন, মার্কিন-চীন বাণিজ্য যুদ্ধের কারণে ইতোমধ্যে তুলার দাম কমতে শুরু করেছে। তিনি জানান, এ যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে আন্তজার্তিক বাজারে তুলার দাম পড়ে যাবে এবং এ ক্ষেত্রে তুলা আমদানিতে বাংলাদেশের লাভ হবে। মেহেদী আলী বলেন, বাণিজ্য যুদ্ধের কারণে আমরা বিভিন্ন পণ্যে সুবিধা পেতে পারি। যা আমাদের দেশের ব্যবসা বাণিজ্যে সুফল বয়ে আনবে।#



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: পোশাক

২৩ জানুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ