Inqilab Logo

মঙ্গলবার ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

অবৈধ অস্ত্রের কারবারিরা চট্টগ্রামে ফের সক্রিয়

রফিকুল ইসলাম সেলিম | প্রকাশের সময় : ৮ অক্টোবর, ২০১৮, ১২:০৪ এএম

চট্টগ্রামে জঙ্গি আস্তানায় তিনটি পিস্তল, একটি একে-২২ রাইফেল এবং এক সন্ত্রাসীর কাছ থেকে ১০টি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধারের কয়েক ঘণ্টার মাথায় ঢাকায় নেয়ার পথে ধরা পড়লো আরও ৮টি আগ্নেয়াস্ত্র। মাত্র ৬০ ঘণ্টার ব্যবধানে ২২টি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধারের ঘটনায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারি বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তারা মনে করছেন এ অঞ্চলে কালো অস্ত্রের কারবারিরা এখন বেশ সক্রিয়। জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে মাঠ দখলের প্রস্তুতি হিসেবে অবৈধ অস্ত্রের আনাগোনা বাড়ছে বলেও ধারণা তাদের। এ অঞ্চলে আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহারও বেড়ে গেছে। নানা অপরাধ, রাজনৈতিক সহিংসতা বিশেষ করে সরকারি দলের কলহ-বিবাদেও প্রকাশ্যে অস্ত্র উঁচিয়ে গুলি ছোঁড়ার ঘটনা ঘটছে। র‌্যাব-পুলিশের নিয়মিত অভিযানে কিছু চালান ধরা পড়লেও অক্ষত থেকে যাচ্ছে অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীদের গোপন অস্ত্রের ভান্ডার। ধরাছোঁয়ার বাইরে কালো অস্ত্রের পাচারকারি সিন্ডিকেটের সদস্যরাও।
র‌্যাবের কাছে খবর আসে কক্সবাজার থেকে মাইক্রোবাসে করে ইয়াবার চালান যাচ্ছে ঢাকায়। এমন তথ্যের ভিত্তিতে গতকাল (রোববার) বিকেলে নগরীর লালখান বাজার ইস্পাহানি মোড়ে ফ্লাইওভারের গোড়ায় চেকপোস্ট বসানো হয়। সন্দেহভাজন মাইক্রোবাসটি চেকপোস্টের কাছাকাছি আসতেই থমকে যান অভিযান পরিচালনাকারী র‌্যাব কর্মকর্তা। কারণ মাইক্রোবাসে পররাষ্ট্র ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে স্টিকার লাগানো। শুরুতে কিছুটা দ্বিধাদ্ব›দ্ব থাকলেও একই গাড়িতে দুই মন্ত্রণালয়ের স্টিকার দেখে গাড়িটি থামান তারা। এরপর গাড়িটিতে তল্লাশি চালালে ২০ হাজার পিস ইয়াবার সাথে পাওয়া যায় চারটি ওয়ান শ্যুটার গান ও চারটি একনলা বন্দুক।
গ্রেফতার করা হয় আলমগীর হোসেন (৩০) ও আল শাহরিয়ার (২৫) নামে দু’জনকে। তাদের বাড়ি নোয়াখালী জেলায়। র‌্যাব-৭ চট্টগ্রামের উপ-অধিনায়ক স্কোয়াড্রন লিডার শাফায়েত জামিল ফাহিম বলেন, গোপন তথ্য ছিল দু’জন টেকনাফ থেকে ইয়াবা নিয়ে ঢাকার দিকে যাচ্ছে। সেই সংবাদের ভিত্তিতে আমরা ফ্লাইওভারের প্রবেশমুখে চেকপোস্ট বসাই। পররাষ্ট্র ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের স্টিকার লাগানো গাড়ি দেখে প্রথমে কনফিউজড হয়ে যাই। কনফার্ম হয়ে সেটিতে তল্লাশি চালিয়ে ইয়াবা ও অস্ত্র জব্দ করি।
র‌্যাবের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতার দুইজন ইয়াবা বহনে কোন ঝামেলা হলে এসব অস্ত্র ব্যবহারের জন্য রাখা হয়েছে দাবি করলেও র‌্যাব বলছে ভিন্ন কথা। র‌্যাব কর্মকর্তাদের ধারণা, তারা নিজেদের নিরাপত্তার পাশাপাশি ইয়াবার সাথে এসব অস্ত্রও পাচার করছিল। স্টিকার লাগানো হলেও গাড়িটি কোনো মন্ত্রণালয়ের নয় বলে নিশ্চিত হয়েছে র‌্যাব। র‌্যাব কর্মকর্তারা বলছেন, অস্ত্র ও ইয়াবা পাচারকারীদের এটা একটা কৌশল। আগেও বিভিন্ন মন্ত্রণালয় এবং সরকারি স্টিকার লাগানো গাড়িতে মাদকের চালান ধরা পড়েছে। গ্রেফতার শাহরিয়ার মাইক্রোবাসটির চালক এবং আলমগীর হোসেন চালকের সহকারী বলে দাবি করেছেন। অস্ত্র চালানের মালিক কে এবং এর গন্তব্য কোথায় তা নিশ্চিত হতে ওই দুজনকে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে বলে জানান র‌্যাবের কর্মকর্তারা।
শনিবার চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া সরফভাটা থেকে গ্রেফতার করা হয় শীর্ষ সন্ত্রাসী মোঃ সাইফুল ইসলামকে। পরে তার দেখানো মতে, ১০টি আগ্নেয়াস্ত্র ও ২৭ রাউন্ড গুলি উদ্ধার করে পুলিশ। পুলিশ জানায়, হত্যা, ডাকাতিসহ বেশ কয়েকটি মামলার এ আসামি রাঙ্গুনিয়ার পাহাড়ে অস্ত্র ব্যবসা করে আসছে। পার্বত্য জেলা পাহাড়ি সন্ত্রাসী গ্রুপের সাথে তার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে। তাদের কাছ থেকে অস্ত্র সংগ্রহ করে চট্টগ্রাম এবং ঢাকায় বিভিন্ন সন্ত্রাসী গ্রুপের কাছে অস্ত্র বিক্রি করতো সাইফুল ইসলাম। জেলা পুলিশের কর্মকর্তারা জানান, তার কাছ থেকে অস্ত্র ব্যবসায়ী ও ক্রেতাদের বেশকিছু তথ্য পাওয়া গেছে।
শুক্রবার মীরসরাইয়ের ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশে জোরারগঞ্জের উত্তর সোনাপাহাড় এলাকায় ‘চৌধুরী ম্যানসনে’ র‌্যাবের অভিযানের পর দুইজনের লাশ পাওয়া যায়। পরে ওই বাসা থেকে তিনটি পিস্তল, একটি একে-২২ রাইফেল ও বোমা ও বোমা তৈরির সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়। এর আগেও চট্টগ্রামের সীতাকুন্ড, হাটহাজারী, কর্ণফুলী, বাঁশখালীসহ বিভিন্ন এলাকায় জঙ্গি আস্তানা থেকে একে-২২ রাইফেলের মতো ভয়ঙ্কর যুদ্ধাস্ত্র উদ্ধার হয়েছে। নগরীর সদরঘাটে ছিনতাই করে পালানোর সময় নিজেদের ছোঁড়া বোমায় নিহত জেএমবি জঙ্গিদের কাছ থেকে দুটি একে-২২ রাইফেল উদ্ধার হয় কয়েক বছর আগে।
জঙ্গিদের পাশাপাশি চট্টগ্রামে সন্ত্রাসীদের হাতেও ভারী অস্ত্র দেখা যাচ্ছে। গত বছর নগরীর আইস ফ্যাক্টরী রোডে মাদক ব্যবসায়ীদের আস্তানা থেকেও উদ্ধার হয় একে-২২ রাইফেল। স›দ্বীপ, সীতাকুন্ড, বোয়ালখালীসহ বিভিন্ন উপজেলায় সরকারি দলের ক্যাডার, মাস্তানদের কাছ থেকেও এ ধরনের ভারী অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনা ঘটেছে। গতকাল পর্যন্ত ২১ মাসে র‌্যাব-৭ চট্টগ্রামের অভিযানে ১৯৬টি বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র উদ্ধার হয়। একই সময়ে গুলি ও কার্তুজ উদ্ধার হয়েছে দুই হাজার ৪৪৭ রাউন্ড। মহানগর এবং জেলা পুলিশের অভিযানেও প্রায় সমান সংখ্যক অস্ত্র গোলাবারুদ উদ্ধার হয়। তবে যে পরিমাণ উদ্ধার হয়েছে তার কয়েকগুণ নিরাপদে সন্ত্রাসীদের গোপন আস্তানায় পৌঁছে গেছে বলে ধারণা সংশ্লিষ্টদের।
সীমান্ত পথে দীর্ঘদিন থেকে এ অঞ্চলে ভারী অস্ত্র আসছে। কক্সবাজার, বান্দরবান, রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও ফেনী সীমান্ত দিয়ে আসছে অস্ত্র। কক্সবাজারের মহেশখালী, চকরিয়া, পেকুয়া এবং চট্টগ্রামের বাঁশখালীর জঙ্গলে গড়ে উঠেছে অস্ত্র তৈরির কারখানা। এসব কারখানায় তৈরি দেশি অস্ত্র চট্টগ্রাম হয়ে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার সন্ত্রাসীদের হাতে চলে যাচ্ছে। র‌্যাব-পুলিশের অভিযানে মাঝে মধ্যে অবৈধ অস্ত্রের কারখানা গুড়িয়ে দেয়া হলেও নতুন নতুন জায়গায় কারখানায় গড়ে উঠছে। কারাগার থেকে বের হয়ে ফের অস্ত্র কারখানায় কাজ করছে এমন নজিরও পেয়েছে র‌্যাব-পুলিশ। অস্ত্র কারখানার মূল মালিক আর বিদেশ থেকে অস্ত্র পাচারকারি দলের সিন্ডিকেট লিডাররা ধরা না পড়ায় অবৈধ অস্ত্রের কারবার বন্ধ করা যাচ্ছে না।
অবৈধ অস্ত্রের আনাগোনার পাশাপাশি ব্যবহারও বাড়ছে। মাদক ব্যবসা, ছিনতাই, ডাকাতিসহ বিভিন্ন অপরাধে ভারী অস্ত্রের ব্যবহার হচ্ছে। র‌্যাব-পুলিশের অভিযানে অপরাধীরা ধরাও পড়ছে। আবার সরকারি দলের দুই পক্ষের সহিংসতায় অস্ত্রের ব্যবহার হচ্ছে। সম্প্রতি চট্টগ্রাম কলেজে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘাতে একাধিক ভারী অস্ত্র ব্যবহার করতে দেখা গেছে। তবে এসব অস্ত্র উদ্ধার করেনি পুলিশ।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: জঙ্গি


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ