Inqilab Logo

মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

অভিজ্ঞতাই ছিল আমার লড়াইয়ের অস্ত্র -নাদিয়া মুরাদ

ইনকিলাব ডেস্ক | প্রকাশের সময় : ৬ অক্টোবর, ২০১৮, ৯:২৬ পিএম

এ বছর কঙ্গোর গাইনি বিশেষজ্ঞ ডেনিস মুকওয়েগের সঙ্গে যৌথভাবে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন ইসলামি স্টেট (আইএস) জঙ্গিদের হাতে যৌনদাসী হিসেবে নির্যাতিতা ইরাকের ইয়াজিদি সম্প্রদায়ের মেয়ে নাদিয়া মুরাদ। নাদিয়ার আত্মজীবনী ‘দ্য লাস্ট গার্ল: মাই স্টোরি অব ক্যাপ্টিভিটি অ্যান্ড মাই ফাইট অ্যাগেইন্সট দ্য ইসলামিক স্টেট’ থেকে একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ান। সেখার থেকে দেয়া হলো কিছু অংশ-

‘দাস বাজার শুরু হতো রাতে। জঙ্গিরা যেখানে নাম লেখে ও সবকিছু দেখাশোনা করে তার উপরে ছিলাম আমরা। নিচ থেকে আসা বিভিন্ন শব্দ আমরা শুনতে পেতাম। কক্ষে প্রথম ব্যক্তি প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে সব মেয়ে চিৎকার শুরু করে। মনে হচ্ছিল এটা কোনও বিস্ফোরণস্থল। আমরা গোঙাচ্ছিলাম, আহত হলে মানুষ যেভাবে গোঙায় সেভাবে। একে অপরের উপর গড়াগড়ি খাচ্ছিলাম, বমিতে ভেসে যাচ্ছিল ঘরের মেঝে। কিন্তু এসবের কিছুই জঙ্গিদের থামাতে পারেনি। তারা দ্রুত ঘরে প্রবেশ করে, তাকায় আমাদের দিকে। আমরা তখন চিৎকার ও দয়া ভিক্ষা করছিলাম। প্রথমে তারা সবচেয়ে সুন্দর মেয়ের দিকে এগিয়ে যায়, জিজ্ঞেস করে, তোমার বয়স কত? একই সঙ্গে তারা মেয়েটির চুল ও মুখ খুটিয়ে দেখছিল। কাছে থাকা প্রহরীর কাছে তারা জানতে চায়, এরা তো কুমারি, ঠিক? প্রশ্নের জবাবে মাথায় নাড়ায় রক্ষী। কোনও দোকানদার যেমন নিজের পণ্য নিয়ে গর্বিত ভঙ্গি প্রকাশ করে, প্রহীরও সেই ভঙ্গিতে বলে, অবশ্যই। তারপর জঙ্গিরা আমাদের শরীরের যেখানে ইচ্ছে হাত দেয়, আমাদের বুকে ও পায়ে হাত বুলায়, যেন আমরা একেবারে পশু।

জঙ্গিরা যখন ঘরে প্রবেশ করে মেয়েদের বাছাই এবং আরবি ও তুর্কি ভাষায় প্রশ্ন করছিল তখন হট্টগোল শুরু হয়। জঙ্গিরা আমাদের থামাতে চুপ থাকতে বলে। তারা চিৎকার করে বলে, চুপ করো। কিন্তু তাদের এই নির্দেশ আমাদের আরও জোরে চিৎকারে বাধ্য করে। জঙ্গিরা যদি আমাকে নিয়েই যায় তাহলে আমি তাদের জন্য বিষয়টি সহজ হোক তা চাই না। আমি গর্জন করে চিৎকার করতে লাগলাম, যে আমাকে ধরতে আসছে তাকে হাত দিয়ে চড় মেরে দূরে রাখার চেষ্টা করি। অন্য মেয়েরাও একই কাজ করছিল। নিজেদের শরীরকে দলা পাকিয়ে মেঝেতে শুয়েছিল অথবা বোন বা বন্ধু; যারা তাদেরকে রক্ষার চেষ্টা করছিল তাদের দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ছিল।

আমি যখন সেখানে শুয়েছিলাম, অপর এক জঙ্গি তখন আমাদের সামনে আসে। সে ছিল উচ্চপদের কর্মকর্তা, নাম ছিল সালওয়ান। হার্ডানের আরেকটি ইয়াজিদি তরুণীকে নিয়ে আসে ওই জঙ্গি। সে ওই মেয়েকে এখানে রেখে যেতে এসেছে। কারণ সে আরেকটি মেয়েকে কিনে নিয়েছে। ‘দাঁড়াও’- সে বলে। আমি যখন তা করিনি সে আমাকে লাথি মারে। “তুমি! গোলাপী জ্যাকেট পরা মেয়ে! আমি বলছি, উঠে দাঁড়াও!”

বড় মুখে তার চোখগুলো মাংসের ভেতর প্রায় লুকিয়ে পড়েছে, মনে হচ্ছিল পুরো চোখ চুলে ঢেকে গেছে। তাকে দেখে পুরুষ মনে হচ্ছিল না, তাকে একেবারে দৈত্যের মতো লাগছিল।

সিনজারে হামলা এবং মেয়েদের যৌনদাসী হিসেবে নেওয়ার সিদ্ধান্ততে যুদ্ধক্ষেত্রের কোনও সেনার স্বতঃস্ফুর্ততা ছিল না। সব পরিকল্পনা ছিল আইএসের। তারা কিভাবে আমাদের বাড়ি আসবে, কিসের ভিত্তিতে মেয়েদের গুরুত্ব কমবে বা বাড়বে, কোন জঙ্গিকে উদ্দীপ্ত করতে সাবায়া (যৌনদাসী) প্রয়োজন এবং কে বিনিময় মূল্য দেবে সব তারা ঠিক করতো। নতুন জঙ্গী সংগ্রহের জন্য তারা নিজেদের প্রোপাগান্ডা সাময়িকী দাবিক-এ যৌনদাসী নিয়ে আলোচনা করেছে। কিন্তু নিজেদের সদস্যরা যেমনটা মনে করে বাস্তবে আইএস তেমন না। ইতিহাসে বিভিন্ন সময় ধর্ষণকে যুদ্ধের অস্ত্র বানানো হয়েছে। এসব কিছুর আগে কখনওই আমি ভাবিনি যে, রুয়ান্ডার নারীদের মতো আমাকেও এমন পরিস্থিতির মুখে পড়তে হবে। আমি জানতামই না রুয়ান্ডা নামে একটি দেশ আছে। এখন আমি তাদের সঙ্গে সবচেয়ে খারাপভাবে সম্পর্কিত হয়ে পড়েছি। আমি সম্পর্কিত হয়েছি যুদ্ধাপরাধের শিকার হিসেবে। সিনজারে আইএস আসার ১৬ বছর আগে যে অপরাধে বিশ্বের কারও শাস্তি হয়নি।

নিচের তলায় এক জঙ্গি কেনাবেচা একটি খাতায় টুকে রাখছে, আমাদের নাম ও যে জঙ্গি আমাদের কিনে নিচ্ছে তা লেখা হচ্ছে। সালওয়ান আমাকে কিনবে বলে মনে হচ্ছিল। আমি ভাবছিলাম, সে যেমন শক্তিশালী ও আকারে বড় তাতে খালি হাতেই আমাকে শেষ করে ফেলবে। যাই করুক না কেন এবং আমি যতই প্রতিরোধ করি না কেন কোনোমতেই তার সঙ্গে কুলিয়ে উঠতে পারব না। তার শরীর থেকে পচে যাওয়া ডিমের গন্ধ আসছিল।

আমি মেঝের দিকে তাকাচ্ছিলাম, পায়ের দিকে এবং জঙ্গি ও সঙ্গে হাটা মেয়েদের গোড়ালি দেখছিলাম। ভিড়ের মধ্যে স্যান্ডাল পরা চিকন ও প্রায় নারীদের মতো একজোড়া পা দেখলাম। কী করছিলাম তা ভাবার আগেই ওই পায়ের দিকে আমার চোখ যায়। আমি ওই পায়ে পড়ে অনুনয় করতে থাকি। বলি, দয়া করে তুমি আমাকে নাও। তোমার যা ইচ্ছা করো, আমি শুধু ওই দৈত্যের সঙ্গে যেতে চাই না। আমি জানি না কেন ওই ব্যক্তি রাজি হলো। সে একবার আমার দিকে তাকিয়ে সালওয়ানের দিকে ফিরে বললো, এই মেয়ে আমার। সালওয়ান তর্ক করলো না। শীর্ণকায় ওই লোকটি মসুলের একজন বিচারক। কেউ তার কথা অমান্য করে না।

শীর্ণকায় লোকটিকে অনুসরণ করে আমি ডেস্কের দিকে এগিয়ে যাই। লোকটি আমাকে জিজ্ঞেস করে, তোমার নাম কী? তার কথা নরম হলেও নির্দয়ের মতো ছিল। আমি বলি, নাদিয়া। সে তখন নিবন্ধকের দিকে ঘুরে। লোকটি জঙ্গিকে চিনতে পারে। জঙ্গি খাতায় আমাদের নাম লিখেছিল ‘নাদিয়া, হাজি সালমান’ হিসেবে। জঙ্গিটি যখন আমার বন্দিকারীর সঙ্গে কথা বলছিল তখন কিছুটা কাঁপছিল বলে আমার মনে হয়েছে। মনে হচ্ছিল ভয় পেয়েছে। আমি ভাবছিলাম, হয়ত আমি কোনও বড় ভুল করে ফেলেছি।

কোচোতে আইএসের হাতে বন্দি হওয়ার প্রায় এক বছর তিন মাস পর ২০১৫ সালের নভেম্বরে আমি জার্মানি থেকে সুইটজারল্যান্ড যাই। সেখানে জাতিসংঘের সংখ্যালঘুদের একটি ফোরামে কথা বলি। সেবারই প্রথমবারের মতো আমি অনেক বেশি দর্শকের সামনে নিজের কথা বলতে পারি। আমি সবকিছু নিয়ে কথা বলতে চাইছিলাম- আইএসের কাছ থেকে পালাতে গিয়ে পানিশূন্যতায় মারা যাওয়া শিশু, পাহাড়ে আটকে পড়া পরিবার, বন্দি অবস্থায় থাকা হাজারো শিশু ও নারী এবং হত্যাযজ্ঞের স্থানে আমার ভাইয়েরা যা দেখেছে; সবকিছুই বলতে চাইছিলাম। নিপীড়নের শিকার লাখো ইয়াজিদিদের মধ্যে আমি ছিলাম মাত্র একজন। আমাদের সম্প্রদায় বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। ইরাক ও ইরাকের বাইরে তারা শরণার্থী হিসেবে বাস করছে এবং কোচো তখনও আইএসের দখলে। ইয়াজিদিদের যা ঘটছে তা বিশ্বকে জানানো খুব প্রয়োজন ছিল।

আমি বলতে চেয়েছিলাম, এখনও অনেক কিছু করার আছে। ইরাকে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের জন্য সেফ জোন গড়ে তুলতে হবে। নেতা থেকে শুরু করে জনগণ যারাই আইএসের নৃশংসতাকে সমর্থন করেছে, গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে তাদের বিচার করতে হবে। সিনজারকে মুক্ত করতে হবে। আমাকে দর্শকদের উদ্দেশে হাজি সালমান সম্পর্কে বলতে হতো। সে আমাকে  কয়বার ধর্ষণ করেছে এবং  আমাকে যে অপমান সইতে হয়েছে তা বলতে হতো। জীবনে আমি যেসব সিদ্ধান্ত নিয়েছি সেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কঠিন ও গুরুত্বপূর্ণ ছিল তা হচ্ছে সৎ থাকা।

আমি যখন ভাষণ পড়ছিলাম তখন কাঁপছিলাম। যতোটা শান্ত হয়ে সম্ভব আমি কোচোতে যা ঘটেছে সেটার বিবরণ দিতে লাগলাম। বলতে লাগলাম কিভাবে আমার মতো মেয়েদের যৌনদাসী বানানো হয়। আমি তাদের বলি কিভাবে আমাকে ধর্ষণ ও যখন-তখন মারধর করা হয় এবং কিভাবে আমি পালাই। নিজের কথা অন্যের সামনে তুলে ধরা কখনওই সহজ ছিল না। যখনই এই বিষয়ে কেউ কথা বলে সেটা তার মধ্যে ভর করে। আমি যখন কাউকে বলি চেকপয়েন্টের কথা যেখানে আমাকে ধর্ষণ করা হয় অথবা হাজি সালমান সম্পর্কে আমার অনুভূতির কথা অথবা মসুলের কালো আকাশের নিচে একটু সাহায্যের জন্য প্রতিবেশীদের খুঁজে বেড়ানোর কথা, আমি সেই সময়ের সব আতঙ্কের মধ্যে ফিরে যাই। আইএসের হাত থেকে পালিয়ে আসা সব ইয়াজিদিরও কাহিনী একইরকম।

সততা ও বস্তুনিষ্ঠতার সঙ্গে আমার কাহিনী তুলে ধরাই সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে আমার সবচেয়ে ভালো অস্ত্র। ওই সন্ত্রাসীদের বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করানোর আগ পর্যন্ত আমি এই অস্ত্র ব্যবহার করতে চাই। এখনও অনেক কিছুই করার বাকি। বিশ্বনেতা ও বিশেষ মুসলিম ধর্মীয় নেতাদের রুখে দাঁড়াতে হবে এবং নিপীড়নের প্রতিবাদ জানাতে হবে।

আমি খুব সংক্ষিপ্ত ভাষণ দেই। যখন আমি নিজের কাহিনী বলা শেষ করি, তখনও কথা বলে চলি। আমি দর্শকদের বলি যে, ভাষণ দেওয়ার জন্য আমি বড় হই নাই। আমি তাদের বলি সব ইয়াজিদি চায় গণহত্যার দায়ে আইএসের বিচার হোক। বিশ্বের দুর্বল মানুষদের রক্ষা করার দায়িত্ব তাদের হাতেই। আমি তাদের বলি, যে আমাকে ধর্ষণ করেছে আমি তার চোখে চোখ রেখে তাকাতে এবং বিচারের মুখোমুখি করতে চাই। আমি তাদের বলি, সবকিছুর চেয়ে যেটা বেশি চাই তা হলো এমন পরিস্থিতির মধ্যে পড়া মেয়েদের মধ্যে আমি যেন শেষ মেয়ে হই।

 

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: নাদিয়া মুরাদ
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ