Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার, ০৪ জুলাই ২০২৪, ২০ আষাঢ় ১৪৩১, ২৭ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

এলএনজিতে চোরের চোখ

শফিউল আলম | প্রকাশের সময় : ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৮, ১২:০২ এএম

প্রাণ ফিরেছে শিল্প-কারখানা বিদ্যুৎকেন্দ্রে
শিল্পখাতে পৃথক সরবরাহ হবে
অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্নের
অভিযানে কর্ণফুলী গ্যাস কোম্পানি


দামি এলএনজিতে পড়েছে চোরের চোখ। গ্যাস চুরিতে জড়িত পুরনো সিন্ডিকেট এবার ফায়দা লুটতে চায় এলএনজির (ভাসমান তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস)। বাইপাস, চোরা লাইন, গোঁজামিল, মিটার টেম্পারিং, রাইজার বাণিজ্যসহ হরেক পথে কারচুপি ও অপকৌশলে দীর্ঘদিন যারা অবৈধ লাইনে ব্যাপক হারে গ্যাস লোপাটে অভ্যস্ত সেই ধূর্ত চক্রটি নেপথ্যে সক্রিয়।
এলএনজি সরবরাহে কারিগরি সমস্যা অনেকাংশে কেটে গেছে। আমদানি চালান নিয়ে কক্সবাজারের মহেশখালী মাতারবাড়ীর কাছে সমুদ্রে এলএনজি টার্মিনালে আসছে জাহাজের পর জাহাজ। দেশে ভারী শিল্প কল-কারখানার প্রধান অঞ্চল চট্টগ্রামে অনেক বছর ধরে বিরাজমান গ্যাসের খরা ও উৎপাদনে অচলদশা কাটতে শুরু করেছে। প্রাণ ফিরেছে শিল্প-কারখানায় ও বিদ্যুৎ উৎপাদনে। আবাসিক গ্রাহকদের গ্যাস সঙ্কটের দুর্ভোগ নিরসনের পথে।
তবে দেশের গ্যাস ক্ষেত্রসমূহ থেকে উত্তোলিত জাতীয় গ্রিডলাইনের মাধ্যমে সরাসরি সরবরাহ করা প্রাকৃতিক গ্যাসের তুলনায় আমদানিকৃত এলএনজির দাম দ্বিগুণ বেশি। গ্রাহকদের পকেট থেকেই গ্যাসের বর্ধিত মূল্য আদায় হবে। অথচ উচ্চমূল্যের এলএনজির সাশ্রয়ী ব্যবহার নিশ্চিতের বিষয়সহ সঠিক ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা হয়নি। যথেচ্ছ চুরি, লোপাট, অপচয়, অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে মূল্যবান গ্যাসের বেহিসাবী ব্যবহারের পথগুলো বন্ধ হয়নি।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, পাইপলাইনের সক্ষমতা এবং ব্যাপক আমদানি না হওয়া পর্যন্ত আপাতত এলএনজির উৎস থেকে গ্যাসের সরবরাহ পাচ্ছে কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিঃ (কেজিডিসিএল)। চট্টগ্রাম অঞ্চলে আবাসিক, বাণিজ্যিক, ক্যাপটিভ পাওয়ার ও শিল্প গ্রাহকের সংখ্যা প্রায় ৬ লাখ। আবাসিক গ্রাহক ৫ লাখ ৯৭ হাজার। গ্যাসের ২০ দশমিক ৪০ শতাংশ আবাসিকে এবং বাকি সিংহভাগই শিল্প-কারখানা ও বাণিজ্যিক প্রায় ৩ হাজার গ্রাহক জোগান পাচ্ছে। চট্টগ্রামে গ্যাসের চাহিদা ৪৫ থেকে ৫০ কোটি ঘনফুট। গত ১৪ আগস্ট থেকে এলএনজি সরবরাহের শুরুতে ১০ কোটি এবং গত ১০ সেপ্টেম্বর থেকে ৩০ কোটি ঘনফুট গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে। সেই সঙ্গে জাতীয় গ্রিডের আংশিক ৫ কোটি যোগ হয়ে এখন ৩৫ কোটি ঘনফুট গ্যাস মিলছে। এর আগে গ্যাসের সঙ্কটকালে জোগান ছিল মাত্র ১৮ থেকে সর্বোচ্চ ২৩ কোটি ঘনফুট।
পেট্রোবাংলা ও কেজিডিসিএল আশাবাদী, জাতীয় গ্রিডের গ্যাস ছাড়াই এলএনজি থেকে চট্টগ্রামে চাহিদার সর্বোচ্চ পরিমাণ ৪৫ থেকে ৫০ কোটি ঘনফুট গ্যাস পর্যায়ক্রমে সরবরাহ করা যাবে। এলএনজির উৎস থেকে গ্যাসের সরবরাহ বেড়ে যাওয়ার ফলে গত সপ্তাহে চট্টগ্রামের শিকলবাহা ও রাউজান তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র পুরোদমে সচল হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার থেকে চিটাগাং ইউরিয়া সার কারখানা (সিইউএফএল) দীর্ঘ ৯ মাস পর চালু হয়েছে। চট্টগ্রামের গার্মেন্টসহ বিভিন্ন শিল্প-কারখানা হয়ে উঠছে কর্মচঞ্চল।
অন্যদিকে কেজিডিসিএলের সংঘবদ্ধ অসৎ কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং কতিপয় শিল্প-বাণিজ্য, আবাসিক গ্রাহকের যোগসাজশে গ্যাস চুরির মহোৎসব চলে আসছে এমন অভিযোগ দীর্ঘদিনের। এখন দ্বিগুণ মূল্যের এলএনজির উৎস থেকে পাওয়া গ্যাস সরবরাহ বৃদ্ধির সাথে অসৎ চক্রটি মরিয়া হয়ে উঠেছে গ্যাস চুরির মাধ্যমে আঙুল ফুলে কলা গাছ হওয়ার ‘মহাসুযোগ’ হাতিয়ে নিতে। এরজন্য নানামুখী অপকৌশলের ফন্দি আঁটছে। শুধু তাই নয় গ্যাস চোরাপথে অবৈধ সংযোগে যারা আগে থেকেই কেজিডিসিএলের গ্যাস লোপাট করছে তারা এখনো এলএনজির ‘সুফল’ খেয়ে ফেলছে। কেননা চোরা ও অবৈধ সংযোগগুলো শনাক্ত করে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্নকরণ ও আইনত শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিশ্চিত হওয়ার আগেই উচ্চমূল্যের এলএনজির সুবিধা ঢালাওভাবে ছেড়ে দেয়া হয়েছে।
এ অবস্থায় কারা বৈধ আর কারা অবৈধ গ্যাস খেকো তা আলাদা করা কঠিন। অন্যদিকে গ্যাস চুরির খেসারত দিতে গিয়ে শিল্প-বাণিজ্য-আবাসিক খাতের প্রকৃত সাধারণ গ্রাহকরা বর্ধিত মূল্য গুনতে বাধ্য হচ্ছেন। এলএনজির উৎস থেকে গ্যাস সরবরাহের পরও কর্ণফুলী গ্যাস চোরা, অবৈধ সংযোগ শনাক্ত ও বিচ্ছিন্ন করতে গিয়ে এখন হিমশিম খাচ্ছে। কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুসারে সর্বশেষ গত ১৩ সেপ্টেম্বর (বৃহস্পতিবার) কেজিডিসিএল ২২টি অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে। যদিও বাস্তব অবস্থার নিরিখে তা কিঞ্চিৎ।
এ প্রসঙ্গে কেজিডিসিএল-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী খায়েজ আহমদ মজুমদার গতকাল (শনিবার) দৈনিক ইনকিলাবকে বলেছেন, তার জানা মতে এ ধরনের গ্যাস চুরি নেই। অবৈধ গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্নকরণ যে কোনো কোম্পানির একটি চলমান প্রক্রিয়া। বর্তমানে ১৮টি টিম নিবিড় কার্যক্রম পরিচালনা করছে। চুরি, বিলখেলাপীসহ অবৈধ সংযোগ পাওয়া মাত্রই বিচ্ছিন্ন করা হচ্ছে। এ ব্যাপারে কোনো আপস নেই। তিনি জানান, প্রতিমাসে গড়ে ৫শ’ থেকে ৭শ’ অবৈধ সংযোগ কেটে দেয়া হচ্ছে। এক প্রশ্নের জবাবে এমডি বলেছেন, অবৈধ উপায়ে গ্যাস ব্যবহারকারীর সম্ভাব্য সংখ্যা সম্পর্কে কোনো সার্ভে নেই।
কেজিডিসিএল-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক আরো জানান, কর্ণফুলীর ওপাড়ে আনোয়ারায় বাল্ক কাস্টমারদের জন্য আলাদা ফিডার লাইনে গ্যাস সরবরাহ করা হবে। ফলে কাফকো, সিইউএফএলসহ ভারী শিল্প-কারখানা ও বিদ্যুৎ খাতের বড় গ্রাহকদের ১৮ কোটি ঘনফুট এবং অবশিষ্ট ২৭ থেকে ৩২ কোটি (মোট ৪৫ থেকে ৫০ কোটি) ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হবে অবশিষ্ট শিল্প-বাণিজ্য ও আবাসিক গ্রাহকদের। আগামী অক্টোবর ও নভেম্বর দু’মাসের মধ্যে আলাদা সরবরাহের কাজ সম্পন্ন হবে।
বিগত ২৪ এপ্রিল এলএনজিবাহী দেশে প্রথম জাহাজ ‘এক্সিলেন্স’ মাতারবাড়ীর কাছে সমুদ্রে ভিড়ে। এক লাখ ৩৬ হাজার ৯শ’ ঘনমিটার এলএনজি বহনকারী টার্মিনালযুক্ত জাহাজটি আসে কাতার থেকে। কিন্তু প্রাকৃতিক গ্যাস রূপান্তর এবং সরবরাহ শুরু করতে গিয়ে বিপাকে পড়ে আমেরিকান এক্সিলারেট এনার্জি। সাগরের তলদেশে পাইপলাইনে ফুটো, চট্টগ্রামে গ্রিড লাইনের ত্রু টি মেরামত শেষে ৪ মাস পর রূপান্তরিত গ্যাস গত ১৪ আগস্ট মহেশখালী-চট্টগ্রামের আনোয়ারা পাইপলাইন হয়ে গ্রিডে সরবরাহ শুরু হয়। এরপর গত সপ্তাহে ২ লাখ ৪৮ হাজার ঘনমিটার এলএনজির চালান নিয়ে আরো দুটি জাহাজ সমুদ্রে আসে। পেট্রোবাংলার পরবর্তী এলএনজি আমদানি চালান নিয়ে কাতার থেকে আসছে আরো তিনটি জাহাজ। তাছাড়া আমিরাত, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া থেকেও এলএনজি আমদানি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
এর ফলে চট্টগ্রামে গ্যাসের ঘাটতি পূরণ হয়ে পরবর্তী সময়ে জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করা হবে। এলএনজি উৎস থেকে গ্যাসের জোগান পেয়ে গত প্রায় দশ পনেরো বছরে হাজার কোটি টাকা পুঁজি বিনিয়োগ করেও চালু করতে না পারা শিল্প-কারখানাগুলোর উদ্যোক্তাগণ এখন আশার আলো দেখছেন। বাণিজ্যিক রাজধানী খ্যাত চট্টগ্রামে শিল্পায়ন, দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ খুলে গেছে। ইতোমধ্যে প্রায় ৭শ’ শিল্পখাতের গ্রাহকের আবেদন থেকে পৌনে ৭শ’ অনুমোদন পেয়েছে। জামানত নিয়ে তাদের নামে ডিমান্ড ইস্যু করা হচ্ছে। আবাসিকের অন্তত ২০ হাজার আবেদন সুরাহার অপেক্ষায় রয়েছে। শিল্প-বাণিজ্য ও আবাসিক খাতের বিভিন্ন গ্রাহক এ ক্ষেত্রে হয়রানি, জটিলতার অভিযোগ করেছেন। তবে কেজিডিসিএলের দাবি, নীতিমালার মাধ্যমেই গ্রাহকদের আবেদন বিবেচনা করা হচ্ছে।



 

Show all comments
  • আরমানুল হক সাদী ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৮, ১:২৭ এএম says : 0
    কেজিডিসিএল এর সংঘবদ্ধ চোর সিন্ডিকেটের কবল থেকে মূল্যবান এলএনজিকে রক্ষা করতে হবে।
    Total Reply(0) Reply
  • Istiaqe Khan ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৮, ৯:১৪ এএম says : 0
    গ্যাস চুরি ও লুটপাট বন্ধ করতে হবে। মূল্যবান এলএনজি গ্যাস নিয়ে যাতে কোন চুরি অনিয়ম দুর্নীতি না হয় সেদিকে সরকারের কঠোরপদক্ষেপ নিতেহবে
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: এলএনজি

২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২২
২৯ নভেম্বর, ২০১৮
১৬ নভেম্বর, ২০১৮
১৩ নভেম্বর, ২০১৮
১৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৮

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ