চরিত্র মানুষের শ্রেষ্ঠতম অলঙ্কার
সৃষ্টির সেরা জীব আশরাফুল মাখলুকাত- মানবজাতি। এ শ্রেষ্ঠত্ব মানুষ তার চরিত্র দিয়ে অর্জন করে নেয়।
ইতিহাস ও জীবনীমূলক কিতাবাদি থেকে জানা যায় যে, পৃথিবীতে এমন কোনো জাতি ছিল না যারা স্বীয় মাযহাব অনুসারে কুরবানি করেনি। বর্তমানে সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে হযরত আদম (আ.)-এর সন্তান হাবিল ও কাবিলের মাঝে তাদের বোন আকলিমার বিবাহ নিয়ে দ্ব›দ্ব দেখা দিলে হযরত আদম (আ.) তাদেরকে এখলাসের সাথে কুরবানি করার নির্দেশ দিয়ে বলেন, তোমাদের মধ্যে যার কুরবানি কবুল হবে তার সঙ্গেই এ মেয়েকে বিবাহ দেওয়া হবে। তখনকার যুগে কুরবানি কবুল হওয়ার আলামত ছিল, যে কুরবানিটি কবুল হতো তাকে আসমান থেকে আগুনের মত একটি অদৃশ্য বস্তু এসে নিয়ে যেতো। অতপর হাবিল ও কাবিল আদম (আ.)-এর নির্দেশে কুরবানি করলো। তবে হাবিল পশু পালনের কাজ করতো সে তার পশুগুলো থেকে বেছে নিয়ে সবচেয়ে সুন্দর একটি ভেড়া আল্লাহর রাস্তায় কুরবানি করলো, আর কাবিল অন্যায়ভাবে বিবাহ করতে চায় ও শরিয়ত বিরোধী কাজ করতে চায়। সে কৃষি কাজ করতো। সে তার কৃষি পণ্য থেকে কুরবানি দিলো এবং সেগুলোকে একটি পাহাড়ের চ‚ড়ায় রেখে আসা হলো। অতপর হঠাৎ করে আসমান থেকে একটি অগ্নি প্রবাহ এসে হাবিলের জন্তুকে জ্বালিয়ে দিলো, অর্থাৎ তার কুরবানি আল্লাহ কবুল করে নিল। কাবিলের কুরবানি আল্লাহ কবুল করলেন না। সেই ঘটনাকে লক্ষ করে আল্লাহ তায়ালা কুরআনে কারিমে ইরশাদ করেন-
হে হাবিব (সা.)! আপনি তাদেরকে পাঠ করে শুনিয়ে দিন আদমের পুত্রদ্বয়ের ঘটনাকে যথার্থরূপে, যখন তারা উভয়ে নৈকট্য লাভের জন্য কুরবানি দিয়েছিল। (সূরা মায়েদা, আয়াত: ২৮)
অতপর তাদের একজনের কুরবানি কবুল হলো এবং অপরের কুরবানি কবুল করা হয়নি। হযরত আদম (আ.) নিজ মেয়েকে বিবাহ দেওয়ার জন্য যে মাপকাঠি নির্ধারণ করেছেন সে মাপকাঠি অনুযায়ী হাবিল তাকে বিয়ে করার জন্য অনুমতি প্রাপ্ত হলো, আর কাবিল বিয়ে করতে ব্যর্থ হলো। এতে কাবিলের মাথার জিদ আরো বৃদ্ধি হয়ে গেল। সে বলল- হে হাবিল আমি তোমার কারণে সুন্দরী (আকলিমা) কে বিয়ে করতে ব্যর্থ হলাম এজন্য আমি তোমাকে হত্যা করবো। হাবিল ছিল নিরীহ। আল্লাহ তাআলা বলেন, আমি শরীরের শক্তি বা দাপট দেখে কুরবানি কবুল করি না। তিনি নিজেই এই ঘটনা প্রসঙ্গে বলেন- আল্লাহ মুত্তাকিনদের কুরবানি ছাড়া কবুল করেন না।
আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে আরো ইরশাদ করেন- অতঃপর অন্তর তাহাকে স্বীয় ভ্রাতা হত্যার জন্য সম্মত করল এবং কাবিল তাকে হত্যা করলো। ভ্রাতা হত্যার কারণে কাবিল ইহকাল ও পরকাল তথা উভয় জাহানে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভূক্ত হয়ে গেল। (কাসাসুল আম্বিয়া, পৃ. ৪৬)
পিতা ইব্রাহিম (আ.)-এর বয়স যখন ৮৬ বছর তখন বিবি হাজেরার গর্ভে পুত্র
সন্তান জন্ম গ্রহণ করলো। তার নাম রাখা হয় ইসমাঈল। এই পুত্রকে নিয়ে কিছুদিন পর কঠিন পরীক্ষায় উপনীত হলেন পিতা হযরত ইব্রাহিম (আ.)। কুরআনের ভাষায়-
অতপর পুত্রের যখন পিতার সাথে চলাফেরা করার মত বয়স হলো তখন তিনি স্বপ্নে দেখলেন এবং ছেলেকে বললেন, হে বৎস আমি স্বপ্ন দেখেছি যে আমি তোমাকে জবেহ করছি। কোন কোন রেওয়ায়েত থেকে জানা যায় যে, এই স্বপ্ন হযরত ইব্রাহিম (আ.)-কে ওপর্যুপরি তিন দিন দেখানো হয়, তবে এ কথা সত্য যে, পয়গাম্বরের স্বপ্নও ওহি।
আল্লাহ তায়ালা বলেন- ইবরাহিম! তুমি কুরবানি কর। সকালে ওঠে তিনি হৃষ্টচিত্তে একশত উট কুরবানি করলেন, কিন্তু পরবর্তী রাতেও তিনি একই নির্দেশ প্রাপ্ত হলেন, আবার তিনি পরের দিন সকালে একশত উট কুরবানি করলেন। তৃতীয় রাত্রে আবার স্বপ্ন দেখলেন, আল্লাহ তায়ালা বলেন, ইবরাহিম! তুমি কুরবানি কর। তিনি আরজ করলেন, মা’বুদ! আমি কি কুরবানি করবো? ইরশাদ হলো- তোমার সর্বাপেক্ষা প্রিয় জিনিসটি আমার রাস্তায় উৎসর্গ কর। অন্য রেওয়ায়েতে নামসহ বলা হয়েছে, এটি জিলহজ মাসের দশ তারিখ রাতের কথা। আগামী দিনই হচ্ছে কুরবানির দিন। সুতরাং তার নিকট পরিষ্কার হয়ে গেল যে, আজ আদরের ছেলে ইসমাঈলকে কুরবানি দিতে হবে। অতপর তিনি কুরবানির সংকল্প হাজেরা (আ.) কে অবহিত করলেন এবং বললেন, তাকে নতুন কাপড়-চোপড় পরিয়ে দাও। বিবি হাজেরা (আ.) তার কলিজার টুকরা পুত্রকে গোসল করিয়ে উত্তম পরিচ্ছেদে আচ্ছাদিত করলেন এবং প্রাণ ভরে চির জীবনের মত বুকে জড়িয়ে আদর সোহাগ করে বললেন, যাও আমার পুত্র! আল্লাহর জন্য নিজেকে উৎসর্গ কর। সে দিনটি ছিল কুরবানির দিন। যে সময়ে কিরণ হেজাজের উপত্যকাগুলোতে প্রতিফলিত হয়ে চিকচিক করছে। এমতাবস্থায় ইবরাাহিম (আ.) বললেন, ইসমাইল! ছুরি ও রশি নিয়ে জঙ্গলে আস। রান্না-বান্নার জন্য কাঠ কেটে নিয়ে আসি, ইসমাইল (আ.) আব্বার আদেশ পেয়ে দৌঁড়ে লম্বা রশি ও তীক্ষ ছুরি নিয়ে জঙ্গল অভিমুখে চললেন।
প্রথমেই ইবরাাহিম (আ.) ইসমাঈলকে স্বপ্নের কথা অবগত করে তার থেকে জবেহের পরামর্শ চাইলেন। যা আয়াতে এসেছে অতএব তুুমি ভেবে দেখ তোমার অভিমত কি? কিন্তু সে পুত্র ছিলেন খলিলুল্লারই পুত্র। ইসমাঈল বলে ওঠলেন, আল্লাহ আপনাকে যে হুকুম করেছেন, তা পালন করুন। এ মহান কাজে মতামতের কি প্রয়োজন? আব্বাজান! আমার থেকে বড় সৌভাগ্যবান কে আছে যে, আপন পিতার জবেহের মাধ্যমে আমি মহান আল্লাহর সাথে মিলিত হতে পারবো। আর বিলম্ব নয়, এখনই বিসমিল্লাহ বলে আমার গলায় ছুরি চালিয়ে দেন, যাতে ইবলিস আমাদের এই খালেস নিয়তকে নষ্ট করার সুযোগ না পায়। তবে আব্বাজান! ইহ জগৎ থেকে চিরবিদায় নেওয়ার পূর্ব মুহূর্তে আপনি আমার এই প্রার্থনাগুলো মনজুর করুন।
১. আপনি ছুরি খুব ধারালো করে নিন। আর আমার হাত পা শক্ত করে বেঁধে ফেলুন। যেন আমার অনিচ্ছাকৃত লাফা-লাফিতে আমার রক্তের ছিটা আপনার কাপড়কে নাপাক না করে।
২. আমাকে মাটির দিকে মুখ করিয়ে শোয়ায়ে দিন, যেন জবেহ করার সময় আমার চেহারা আপনি না দেখেন, যা জবেহ থেকে বাধা দিবে।
৩. আমার রক্ত মিশ্রিত জামা কাপড় নিয়ে আম্মাজানকে দিবেন। তাহলে আমার আম্মা পুত্রের বিচ্ছেদের যন্ত্রনা লাঘব করতে পারবেন। এক রেওয়ায়েতে আছে যে, ইসমাঈল (আ.) জবেহ করার খবর তার আম্মাকে না দিতে বলেছিলেন। হযরত ইবরাাহিম (আ.) স্বীয় সন্তানের মুখে একথা শুনে আনন্দে অধীর হয়ে ওঠেন এবং আদরের টুকরা সন্তানকে ঐ পাথরের নিকট নিয়ে গেলেন, যেখানে হজের মৌসুমে কুরবানির পশুগুলো মিনা নামক স্থানে নিয়ে জবেহ করা হয়। অতপর হযরত ইসমাঈল (আ.) বললেন, ইনশাআল্লাহ আপনি আমাকে ধৈর্যশীলদের মধ্যে পাবেন। হযরত ইবরাাহিম (আ.) ছুরিতে পাথরের শান দিতে লাগলেন। এদিকে উর্ধ্ব জগতের ফেরেশতাকুলের মাঝে পড়ে গেল হাহাকার। এমন একটি দৃশ্যের অবতারনা হচ্ছে, যার দ্বিতীয় কোন উপমা নেই, ছুরি ধার দেওয়া হয়ে গেছে। ইবরাহিম (আ.) কুরবানির জন্তুর মত নিজের পুত্রকে উপুড় করে শোয়ায়ে দিলেন। অদৃশ্য জগতে পড়ে গেল ক্রন্দনের রোল, কিন্তু কারো জানার ক্ষমতা নেই, মহান আল্লাহ কোন উদ্দেশ্যে আপন খলিলের মাধ্যমে এরূপ হৃদয় বিদায়ক ঘটনা ঘটাচ্ছেন। আল্লাহই তো ভালো জানেন। তারপর তড়িৎ-গতিতে বিসমিল্লাহ বলে তীক্ষè ছুরি বের করে নিলেন এবং পুত্রের গলায় ছুরি চালিয়ে দিলেন, আর ঐ দিকে আল্লাহর হুকুমে জিবরাাঈল (আ.) নিজের অজান্তেই চিৎকার করে আল্লাহু আকবর বলে ওঠলেন, হঠাৎ মধ্যভ‚মিতে ইসমাঈল (আ.) তার জবাবে লাই ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবর বলে ওঠলেন এরই সাথে ইবরাাহিম (আ.) আল্লাহু ওয়া লিল্লাহিল হামদ বললেন, যার সমষ্টি আজও ঈদুল আযহার মৌসুমে বার বার পড়া হয়। এই ঘটনাকে আল্লাহ তায়ালা কুরআনে কারীমের সুরা সাফফাতে উল্লেখ করেছেন।
যখন তারা আত্মসমর্পন করলেন এবং পুত্রকে উপুড় করে শোয়ালেন তখন আমি ডাকলাম হে ইবরাহিম! নিশ্চয়ই আপনি স্বপ্নকে সত্যে পরিণত করেছেন, আমি বিশিষ্ট বান্দাদেরকে এরূপ পুরস্কার প্রদান করে থাকি। প্রকৃতপক্ষে ইহা এক বড় পরীক্ষা। এ মর্মান্তিক দৃশ্যে উর্ধ্ব জগতের ফেরেশতাজগত, সুবিশাল মহাশূন্য, ধরণীর নদ-নদী, পাহাড়-পর্বত, পশু পাখি, তরুলতা সবকিছুর মধ্যে প্রকম্পন আরম্ভ হয়েছিল। সৃষ্টি জগৎ রুদ্ধশ্বাসে প্রত্যক্ষ করেছিল আত্মোৎসর্গের এ বিরল ঘটনাটি। ফেরেশতারা প্রার্থনা করেছিল- হে প্রভু কেন তুমি এ হুকুম প্রদান করেছ? মহাপ্রতাপশালী আল্লাহ উত্তরে বলেন, আমার কিছু সংখ্যক ফেরেশতারা উক্তি করেছিলো, হে প্রভু আপনি ইবরাহিম (আ.)-কে কেন খলিলরূপে আখ্যায়িত করলেন? আমি বলেছিলাম! তিনি আমার প্রকৃত খলিল এবং আমার জন্য তার বন্ধুত্ব কতটুকু তা পরীক্ষা করে নিলাম। দৃঢ়চিত্তে ইবরাহিম (আ.) সন্তানের গলায় ছুরি চালালেন, এদিকে আল্লাহ তাআলার রহমতের জোশ এসে গেল। তিনি ছুরিকে লক্ষ্য করে হুকুম করলেন? খবরদার ইসমাইলের একটি পশমও যেন না কাটে। আল্লাহর হুকুমে ছুরির কাজে পর্দা পড়ে গেল। এতে ইবরাহিম (আ.) রাগান্বিত হয়ে ছুুরি দূরে নিক্ষেপ করলেন। ছুরি একটি পাথরে পড়ে পাথর দুই টুকরা হয়ে গেল। সুবহানাল্লাহ! অতপর মহান আল্লাহ জিবরাাঈল (আ.)-কে হুকুম দিলেন, হে জিবরাঈল! তুমি বেহেশত থেকে একটি দুম্বা নিয়ে যাও এবং আমার খলিলকে সালাম দিয়ে ইসমাঈলের পরিবর্তে এটাকে কুরবানি করতে বল। আমি তার কুরবানি কবুল করেছি। ইসমাঈলের গলা কাটা আমার উদ্দেশ্য নয়; বরং তোমাকে পরীক্ষা করা আমার উদ্দেশ্য ছিল। আল্লাহ পাক বলেন- আমি ইবরাহিমকে যে ফিদিয়া দিয়েছি তা এক শ্রেষ্ঠ কুরবানি। মুফাসসিরগণ লিখেছেন- ইহা সেই দুম্বা যা আদম (আ.)-এর ছেলে হাবিলের কুরবানির দুম্বা ছিল এবং ইহা জান্নাতে সংরক্ষিত ছিল। (তাফসীরে মাআরেফুল কুরআন)
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।