দেশে দেশে রোজার উৎসব
মাহে রমজান আরবী নবম মাসের নাম। চাঁদের আবর্তন দ্বারা যে এক বৎসর গণনা করা হয়,
(পূর্বে প্রকাশিতের পর) কবি রবীন্দ্রনাথ তার বেশ কিছু কবিতা বা গানে আলো চেয়েছেন ঃ যেমন; ‘আরো আলো আরে আলো এই নয়নে প্রভু ঢালো।’ কবি গ্যেটে, মৃত্যুর সময় চিৎকার করেছিলেন, ‘আলো আরো আলো’- বলে। বারো শরীফের মহান ইমাম (রঃ) বলতেন, “আমাদের এ মাটির দেহে আলোর সংযোগ ঘটলে পথ চলা সহজ হয়”। এ মাটির দেহের ভিতরটা তো অন্ধকার। তাই এনডস কপি করার সময় নলের অগ্রভাগে বাল্ব জ্বালায়ে নিতে হয়। ভিতরের ফটো উঠাবার জন্য। তাহলে সে অন্ধকার ঘরে আপনি কি করে আপনার প্রভু আল্লাহকে দেখবেন? বারো শরীফের ইমাম এর কথার প্রতিধ্বনি করে বলি; আমাদের জীবনে; সংসারে; সমাজে; রাষ্ট্রে আলোটা কিসের হবে? যদি মনে করি সেটা সময়ের আলো; ইতিহাসের আলো। এই আলোয় আমরা অতীতকে দেখি। বর্তমানে পথ চলি। সেই আলোয় বুঝতে পারি কোনটা সত্য সুন্দরপথ। সময়ের এই আলো, আর আল্লাহর আলোর মধ্যে কোন পার্থক্য আছে কিনা এটা জ্ঞান দিয়ে বুঝার বিষয়। রাসূল বলেছেন, “তোমরা সময়কে গাল মন্দ করো না, আল্লাহ নিজেই সময়।” আজ আমরা যে যার ব্যক্তিজীবনে; সমাজ জীবনে; রাষ্ট্রীয় জীবনে যে কাজ করে চলেছি এ কাজ সুসম্পন্ন করতে প্রয়োজন আলোর।
পৃথিবীতে আলোর গতিবেগ সেকেন্ডে এক লক্ষ ছিয়াশি হাজার মাইল। এত প্রচন্ড গতিবেগ আর কোন পদার্থ বা শক্তির নেই। বিদ্যুতের গতি ও আলোর গতি একই। তাই এই দুই প্রধান শক্তির দ্বারা মানুষ অসম্ভবকে সম্ভব করছে। উপকৃত হচ্ছে। আলোর একটা গুণ হলো, যে বস্তুকে ভেদ করে চলে যায় সে বস্তুকে আলোকিত করে। আর ভেদ করতে না পারলে সেখান থেকে প্রতিফলিত হয়। আলোর নিজস্ব কোন আকার নেই। যে বস্তুতে প্রবেশ করে সে বস্তুর গুণ ও আকারের উপরেই আলোর রূপ বা আকার নির্ভর করে। একই আলো রড লাইটে এক রকম, টিভিতেও ফ্রিজে আর এক রকম রূপ বা আকার নেয়। যে হৃদয় কঠিন তারা আলো গ্রহণ করতে পারে না। সেখান থেকে প্রতিফলিত হয়ে ফিরে আসে। দুঃখ-কষ্ট এসব হৃদয়ে জন্য। তাই, আল্লাহ বলেন, “কখনও না বরং তারা যা অর্জন করেছে তার জন্য হৃদয় বা অন্তর সমূহে মরিচা ধরেছে।” (সুরা তৎফিক)
আল্লাহ বলেন, “আমি আসমান ও জমিনের আলো।” (সূরা নূর) আর রাসূল (সাঃ) বলেন, “আল্লাহ সর্বপ্রথম যা সৃষ্টি করেন যা আমারই নূর।” (হাদীসে কুদসী) তাহলে মহাজাগতিক আলোর উৎস-আল্লাহ ও রাসূল। রাসূল (সাঃ) আরও বলেছেন, “আমার নূর (আলো) থেকেই এ বিশ্বলোক সৃষ্টি।” হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেছেনঃ “একদা অন্ধকার গৃহে রাসল (সাঃ) মুচকি হাসলে, আমি তাঁর দাঁতের আলোতে সূচের ছিদ্র দিয়ে সূতা পরিয়েছিলাম।” তাই সূফী সাধকগণ নিজ মুর্শিদ এর মাধ্যমে আল্লাহ ও রাসূল হতে বিলায়েত প্রাপ্ত হয়ে আলোক সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করেন। আর বিজ্ঞানীরা আলোক সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করেন বস্তু বা পদার্থের মাধ্যমে। তারা পদার্থ হতে-বৈদ্যুতিক আলো; রঙ্গণ রশ্মি; মহাজাগতিক রশ্মি; ইলেকট্রন; প্রটন; নিউরণ ইত্যাদি আবিস্কার করে আলোর বিভিন্ন স্তরের গুণ, ক্রিয়া ও শক্তি সম্বন্ধে জ্ঞান অর্জন করেছেন। তাই, তারা আলোর তথ্যে এখন পর্যন্ত প্রকৃত সত্যে উপনীত হতে পারেন নাই।
সূফী সাধকগণ কঠোর সাধনা ও তাসাউওফের গবেষণার মাধ্যমে আলোক সম্পর্কিত সঠিক জ্ঞান অর্জন করেন। কারণ, তারা ইহলৌকিক (Negative Direction); ; পারলৌকিক (Creative Direction) ও তাওহীদ (Positive Direction) সমন্বয় জ্ঞানে আলোক সম্পর্কে গবেষণা করেছেন। তাদের গবেষণার প্রথম উৎস রাসূল ও আল্লাহ। তারপর এ বিশ্ব প্রকৃতি। আধুনিক বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে দেখলেও এর সত্যতা বুঝা যায়। ‘নেগেটিভ’ - অর্থাৎ না-মূলক আর পজেটিভ অর্থাৎ হ্যাঁ মূলক সমন্বয়ে বিদ্যুৎ সৃষ্টি হয়। আর আল্লাহর প্রেমের নিজস্ব ইচ্ছা শক্তি হতে-‘নূরে মোহাম্মদ’ বা ‘মোহাম্মদ (সাঃ) এর আলো’ সৃষ্টি। আর নূরে মোহাম্মদ হতে বস্তু জগত সৃষ্টি। বই কিতাব পড়ে এ জ্ঞান পরিপূর্ণরূপে পাওয়া যাবে না। এ জন্য প্রয়োজন সেই শিক্ষক যিনি আলো প্রাপ্ত হয়ে পরিপূর্ণ (কামেলে) হয়েছেন তার সহবৎ আর মোরাকেবা ও মুশাহিদা অর্থাৎ ঐ কামেলের সাথে যোগাযোগ রাখা কৃচ্ছ সাধন ও ধ্যান। বারো শরীফের ইমাম (রাঃ) ছিলেন এমনই একজন সূফী সাধক। আধ্যাত্মিক কথা প্রসঙ্গে বলেছিলেন-মনসুর হেল্লাজ যে স্তর পর্যন্ত পৌঁছান তার পরবর্তি স্তর হচ্ছে - ‘জিল্লিয়াত’। এখানে এসে সাধক আল্লাহর সিংহাসন পর্যন্ত দেখতে পায়, কিন্তু আল্লাহকে দেখতে পায় না।” সাধক- মোজাদ্দিদ-ই- আলেফেসানী (রঃ) বলেন; ‘জিল্লয়াত’ স্তরে দেখা যাবে সমগ্র সৃষ্টি আল্লাহর নূরে (আলোর-তরঙ্গে) দোল খেয়ে ফিরছে।” কোরআনে বলা হয়েছে-আল্লাহ আস্মান ও জমিনের নূর (আলো)।
আল্লাহ বলেন, “নিশ্চয়ই আল্লাহর নিকট হতে তোমাদের কাছে এসেছে নূর এবং সুস্পষ্ট কিতাব।” (সূরা ঃ মায়েদা) তাফসীরে জালালাইন-এ বলা হয়েছে যে; উক্ত আয়াতের নূর দ্বারা নূরে মোহাম্মদ (সাঃ) কে বুঝানো হয়েছে। তাফ্সীরে সা’বীতে বলা হয়েছে যে, অত্র আয়াতে আল্লাহ’তায়ালা হুজুর (সাঃ) কে এ কারণেই নূর বলেছেন যে; তিনি দৃষ্টি শক্তিকে আলোকিত করেন আর তিনি ইন্দ্রিয় গ্রাহ্য (দৃশ্য আলো) ও ইন্দ্রিয় অগ্রাহ্য (অদৃশ্য আলো) আলো উভয় প্রকার আলোর মূল। কবি নজরুল ইসলাম ঠিকই বলেছে; “নূরের দরিয়ায় সিনান করিয়া কে এল মক্কায় মা-আমেনার কোলে।”
আল্লাহ তার নূর সম্পর্কে বলেন;“আল্লাহ হচ্ছে আসমান ও জমিনের নূর। তার নূরের তুলনা এই যে, যেমন একটা তাক, তার মাঝে একটা প্রদীপ, প্রদীপটি কাঁচে পরিবেষ্টিত; আর ঐ কাঁচ যেন একটা উজ্জ্বল নক্ষত্র, যা উজ্জ্বল করা হয়েছে বরকতময় জয়তুন তেল দ্বারা, তা না পূর্বের না পশ্চিম দেশের। তার তেল এমনি উজ্জ্বল যে, আগুন স্পর্শ করার পূর্বেই জ্বলে উঠে। ‘নূরের উপর নূর’; আল্লাহ পাক যাকে ইচ্ছা তাকে নিজের নূরের দিকে পথ দেখিয়ে থাকে এবং আল্লাহ মানুষের জন্য এ সকল উপমা উপস্থিত করেন, আর আল্লাহ পাক সর্ব বিষয়ে পরিজ্ঞাত।” (আল-কোরআন)
‘নূর’ শব্দের আভিধানিক অর্থ ‘আলো’। নূর-তিন প্রকার (১) ইন্দ্রিয গ্রাহ্র বা দৃশ্যমান আলো (২) ইন্দ্রিয় অগ্রাহ্য বা অদৃশ্য আলো (৩) আধ্যাত্মিক আলো। দৃশ্য আলো চোখে দেখা যায়। যেমন-সূর্যের কিরণ, চাঁদের আলো, প্রদীপ এর আলো, বিদ্যুৎ এর আলো ইত্যাদি। আদৃশ্য আলো চোখে দেখা যায় না - যেমন ঃ X-Ray, Gama Ray, Farultra-violet, Cosmic Rays ইত্যাদি। কোরাণ ও ইসলাম কে নূর বলা হয়েছে। এসবগুলো চক্ষু অনুভব করে না, কিন্তু বিবেক, জ্ঞান বলে এরা আলো। আধ্যাত্মিক নূর বা আলো যেমন ঃ আল্লাহ ও রাসূলের নূর।
নূর স্বয়ংসম্পূর্ণ ও দীপ্তিমান। কোন কিছুই নূরের প্রতিবন্ধক হতে পারে না। নূর আপন হতেই জ্বলে। নূর ছিল, আছে, থাকবে। বিলুপ্ত হবে না। নূর আর নারের (আগুন) পার্থক্য অনেক। আগুন নিজে নিজেই জ্বলতে পারে না। আল্লাহ যখন একটা বড় জয়তুন বৃক্ষে তুর পাহাড়ের পাদদেশে তার নূর প্রকাশ করেন তখন মূসা (আঃ) ও প্রথমে এটাকে আগুন মনে করেছিলেন। পরক্ষনেই তিনি তার কাশ্ফ এর সাহায্যে বুঝতে পারেন। এটা আল্লাহর পবিত্র নূর।
যদি সাধনার দ্বারা আল্লাহর দয়ায় কারো দিব্য দৃষ্টি শক্তি খুলে যায়-তাহলে সে অনেক অদৃশ্য আলো দেখতে পায়। তা না হলে-অসীম জ্যোতিরাশির মধ্যে আমরা অন্ধের মতো ঘুরছি। এটাই আমাদের (মানুষের) অপূর্ণতা।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।