দেশে দেশে রোজার উৎসব
মাহে রমজান আরবী নবম মাসের নাম। চাঁদের আবর্তন দ্বারা যে এক বৎসর গণনা করা হয়,
মক্কা মুকাররমা’-এর কবরস্থান হলো, জান্নাতুল মুআল্লা। আর মদিনা মুনাওয়ারা’-এর কবরস্থান হলো-জান্নাতুল বাকি। এর মূল নাম হলো- ‘বাকিউল গারকাদ’। হুজুরে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদিনায় থাকাবস্থায় হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম’র দুধভাই হযরত উসমান ইবনে মযঊন রাযি.-এর মৃর্ত্যু হয়। সাহাবায়ে কেরাম তখন হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞেস করেন, তাকে কোথায় দাফন করা হবে? হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করলেন, আমাকে আদেশ দেয়া হয়েছে, তাকে ‘বাকিউল গারকাদ’য় দাফন করা হবে। (মুসতাদরাকে হাকিম, খ.১১ পৃ.১৯৩)। এভাবেই এ জায়গা কবরস্থানের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্বাচিত হয়ে যায়। এবং এখানে সর্বপ্রথম (হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম’র দুধভাই) হযরত উসমান ইবনে মযঊন রাযি. কে দাফন করা হয়। তারপর কবরস্থান তিনদিকেই প্রশস্ত হতে থাকে। আর আজ তো তা বিশাল জায়গা জুড়ে বিস্তৃত। জান্নাতুল বাকি মসজিদে নববি’র পূর্বদিকে অবস্থিত। প্রথমদিকে মদজিদে নববি আর বাকি মাঝখানে ‘হারতুত দাগওয়াত’ নামে একটি মহল্লা আবাদ ছিলো। যেখনে মদজিদে নববির খাদেমরা তাদের বংশধর নিয়ে বসবাস করতেন। ১৪০৫ হিজরীতে মসজিদে নববি সংস্কারের সময় এই মহল্লাকে অন্য এক জায়গায় স্থানান্তরিত করা হয়। এখন এই জায়গা মসজিদে নববির বারান্দা হিসেবেই ব্যবহার হয়। এবং এটার শেষ প্রান্তেই মসজিদে নববির চার দেয়াল। তারপর ‘আবু যর’ নামে একটা সড়ক। তারপর যথেষ্ট উচ্চতার পর জান্নাতুল বাকি। কবরস্থান’র চতুর্দিকে একটি উঁচু বাউন্ডারি। পশ্চিম দিকে একটি বড় গেইট। কবরস্থানে যাওয়ার জন্য একটি প্রশস্ত সিঁড়ি। ফজরের পরে এবং আসরের পরে কবরস্থান সবার যিয়ারতের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। বাহিরে পুলিশের লোকজন অবস্থান করে। এবং ভেতরেও শক্তভাবে নজরদারি করা হয়, কোনোপ্রকার বেদাতি কাজ শুরু করলে, তা শক্তহাতে দমন করা হয়। জান্নাতুল বাকি’র ফযিলত-এর জন্য এতুটুকুই যথেষ্ট যে, মৃতদের দাফন করার জন্য এটাকে নির্বাচন করে স্বয়ং আল্লাহ পাক রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আদেশ দিচ্ছেন। সর্বপ্রথম হুজুর সাল্লাল্লাহু আলালাইহি ওয়া সাল্লাম তার দুধ ভাইকে দাফন করেন। তারপর তাঁর চাচি- হযরত ফাতেমা বিনতে আসাদ (হযরত আলী রাযি.-এর আম্মা) তারপর হুজুর সাল্লাল্লাহু আলালাইহি ওয়া সাল্লাম’র ছেলে হযরত ইবরাহিম রাযি. কে এখানে দাফন করা হয়। তাছাড়াও হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম’র তিন মেয়ে- হযরত রুকাইয়া রাযি. হযরত যয়নাব রাযি. এবং হযরত উম্মে কলসুম রাযি.-এর মাকবারা। এই তিন মেয়েই হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জীবিত থাকাবস্থায় ইন্তেকাল করেন। এর সামান্য সামনে উম্মুল মুমিনিন হযরত খাদিজাতুল কুবরা রাযি. এবং উম্মুল মুমিনিন হযরত মায়মূনা রাযি. ছাড়া বাকি সকল উম্মুল মুমিনিন’র কবর মোবারক। হযরত খাদিজাতুল কুবরা রাযি. -এর ইন্তেকাল হয় মক্কায়। তাই তাকে জান্নাতুল মুআল্লায় দাফন করা হয়। উম্মুল মুমিনিন হযরত মায়মূনা রাযি.-এর ইন্তেকাল মক্কা থেকে দশ মাইল দূরে “মাকামে সরফে’ হয়। সারাফ মদিনা দিকে আসতে যে সড়ক পাওয়া যায়, এর পাশেই। এটা আশ্চর্যজনক যে, হযরত মায়মূনা রাযি.-এর বিবাহও এই জায়গায় হয়। এবং মৃত্যুও এই জায়গায়। এবং এখনেই তার মাকবারা। উম্মাহাতুল মুমিনিন’র মধ্য হতে স্রেফ উম্মুল মুমিনিন হযরত যয়নাব বিনিতে খুযাইমা রা.-এর মৃর্ত্যু হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম’এ জীবিত থাকাবস্থায় হয়। এবং হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজ হাতে তাকে দাফন করেন। বাকি উম্মাহাতুল মুমিনিনরা হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম’র বিদায়ের পর মৃর্ত্যুবরণ করেন। এবং তাদের সকলকে জান্নাতুল বাকিতে দাফন করা হয়। যদি সামান্য বামদিকে যান, তাহলে ছোট একটি অংশ নজরে আসবে, এখানে হযরত আলী রাযি.-এর ভাই হযরত আকিল এবং তার ভাতিজে আবদুল্লাহ ইবনে জাফর তৈয়্যার রাযি.-এর কবর। এর বরাবর একটি শারী। এবং শুরতেই হযরত নাফে রাযি. এবং হযরত ইমাম মালিক রহ.-এর কবর। এর সোজা বরাবর সামনে বেড়ে আরো কিছু কদম পরে, হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম’র সাহেবজাদা হযরত ইবিরাহিম রাযি.-এর কবর। এবং এর কিছুটা দূরে হযরত ওসমান রাযি.-এর কবর। এবং এর বিপরীত দিকে হযরত হালিমা সা’দিয়া রাযি.-এর কবর। এর মধ্যখানে আরেকটি বেড়া এমন, যেখানে শুহাদাদের দাফন করা হয়েছে। দরোজা দিয়ে প্রবেশ করে ডান দিকে দেয়ালের বিলকুল নিচে ইসমাঈল ইবনে জাফরের মাযার। এবং বামদিকে হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম’র ফুফুর কবর। এই পুরো কবরস্থানেই বড় বড় হাস্তিদের কবর মোবারক। এখন আর সেখানে দাফন হয় না। হ্যা অবশ্যই সৌদি সরকার এখন এটাকে উত্তর-পশ্চিম দিকে যথেষ্ট প্রশস্ত করছে। এখনে সাধারণ সব মুসলমানদের দাফন করা হয়। এর বেশিরভাগই হাজি। মুলত তারাই তো সৌভাগ্যবান, যারা মদিনায় মৃত্যুবরণ করেন। সৌদি সরকার দু’বার বাকিকে সংস্কার করেছে। প্রথম সংস্কার করে শাহ ফয়সাল ইবনে আবদুল আজিজের আমলে। এসময় ‘বাকিউল গামাত’ এবং এর সঙ্গে সংযুক্ত একটি সড়ককে বাকির সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়। উত্তর দিক থেকেও এক অংশকে বাকির সঙ্গে প্রশস্ততায় যুক্ত করা হয়। সর্বমোট ছয় হাজার মিটার সংযোগ করা হয়। তাছাড়া বাকির ভেতরে পাকা রাস্তা বানানো হয়। যাতেকরে বৃষ্টির মৌসুমে দর্শনার্থী এবং দাফন করতে আসা লোকদের কোনধরনের কষ্ট না হয়। দ্বিতীয় দফা সংস্কার হয়, শাহ ফাহাদ’র আমলে। এবং সময় আশপাশের সকল মহল্লা, বাজার, সড়ক উচ্ছেদ করে জান্নাতুল বাকিতে সংযুক্ত করে জান্নাতুল বাকিকে প্রশস্ত করা হয়। এখন জান্নাতুল বাকির চতুর্দিকে সতেরশো চব্বিশ মিটার লম্বা দেয়াল নির্মাণ করা হয়েছে। এবং এতে মরমর পাথর লাগানো হয়েছে। এবং দেয়ালে কালো রঙ্গের লোহার জালি লাগানো হয়েছে। জান্নাতুল বাকির একপাশে মৃতের গোসল দেয়া এবং কাফন পরানোরও ব্যবস্থাপনা করা হয়েছে।
জান্নাতুল বাকি’র ফযিলত সম্পর্কীয় হাদিস অনেক। এই কবরস্থান’র সবচেয়ে বড় ফযিলত হলো- হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রাত্রিবেলা সবসময় ঘুম থেকে উঠে এখানে চলে আসতেন। এবং এই কবরস্থান’য় শায়িত লোকদের মাগফিরাত’র জন্য দোআ করতেন। হযরত আয়েশা রাযি. থেকে বর্ণিত লম্বা একটি হাদিসে একটি ঘটনা হলো-
‘একদিন রাসুল সা. (বন্টনানুযায়ী আমার নির্ধারিত দিনে) পাশে ছিলেন। কিছুক্ষণ থাকার পর, যখন দেখলেন আমার চোখের পাতা বুজে গেছে। তিনি আস্তে আস্তে উঠলেন এবং সাবধানতার সঙ্গে দরোজা খুলে বাইরে বের হয়ে গেলেন। তারপর আবার শান্তশিষ্টভাবে দরোজা বন্ধ করে দিলেন। আমি উঠে কাপড় পরিবর্তন করলাম। এবং চাদর গায়ে দিয়ে তার পিছু পিছু চলতে শুরু করলাম। তিনি জান্নাতুল বাকিতে প্রবেশ করে একটি জায়গায় দাঁড়ালেন। প্রায় অনেক্ষণ যাবত তিনি সেখানে দাঁড়িয়েই থাকলেন। তিনবার হাত উঠিয়ে দোআ করলেন। তারপর মুখ ঘুরালেন। আমিও মুখ ফিরালাম এবং খুব দ্রুত গতিতে বরং বলা যায়, দৌড়ে দৌড়ে এসে ঘরে প্রবেশ করলাম। তারপর ঠিকঠাকভাবে আগের মতো আস্তে করে শুয়ে পড়লাম। আমি ঘরে পৌঁছুতে না পৌঁছতে দেখি, তিনিও ঘরে পৌঁছে গেছেন। এসে বলতে লাগলেন, আয়েশা! তোমার কি হলো? তোমার স্বাস যে ফুপে উঠছে। বললাম, না কিছুই না। বললেন, নিজে বলে দাও, নয়তো আমার সুক্ষ্ম সংবাদদাতা (আল্লাহ) আমায় সব বলে দেবেন। বললাম, হে আল্লাহর রাসুল! আমার পিতা-মাতা আপনার উপর উৎসর্গ হোক! ঘটনা হলো, এই...। বললেন, আচ্ছা! ওই ছাঁয়া তাহলে তোমার ছিলো? যেটা আমি ওখানে দেখছিলাম। বললাম, জি হ্যা! বললেন, তোমার সংশয় ছিলো, আল্লাহ এবং তার রাসুল তোমার উপর জুলুম করবেন। বললাম, লোক যতোই লুকোচুরি করুক না ক্যান। আল্লাহ তো জেনেই ফেলেন। তারপর তিনি আমাকে বললেন, কথা হলো, হযরত জিবরাইল আলাইহিস সালাম আমার কাছে আসছিলেন। তিনি আমাকে আস্তে আস্তে ডাকছিলেন, যাতে তোমি বুঝতে না পারো। তিনি ভেতরে আসতে পারছিলেন না, কেননা, তখন তোমার কাপড় এলোমেলো ছিলো। আমিও ভাবলাম তুমি শুয়ে আছো। এজন্য আমি তোমাকে আর জাগানোও সমিচিন মনে করিনি। আমার এটাও ভয় ছিলো, তুমি একা এখানে ভয় পাবে। জিবরাইল আলাইহিস সালাম, আমাকে বলতে লাগলেন, আপনার রব আপনাকে হুকুম করছেন, আপনি (জান্নাতুল) বাকিবাসীদের কাছে যাবেন। এবং তাদের জন্য মাগফিরাত’র দোয়া করবেন। (সহিহ মুসলিম, হাদিস নং-৯৭৩)
হযরত আয়েশা রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমার বন্টিত নির্ধারিত দিন আমার কাছে থাকাবস্থায় রাতের প্রায় শেষাংশে উঠে বাকিতে চলে যেতেন। এবং বলতেন-
‘হে মুমিন শহরবাসীরা! তোমাদের ওপর সালাম বর্ষিত হোক। কালই তোমরা তোমাদের প্রতিশ্রুত বস্তু পাচ্ছো। তোমরা (কিয়ামতের জন্য) বিলম্ব করছো। ইনশাআল্লাহ! আমরাও অচিরেই তোমাদেত সঙ্গে মিলিত হচ্ছি। হে আল্লাহ! কাকিবাসীকে মাফ করে দাও।’
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রাযি. থেকে বর্ণিত, হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন- ‘কিয়ামতের দিন সর্বপ্রথম যে ব্যক্তির যমিন চিড় ধরবে, সে ব্যক্তি আমি। তারপর আবু বকর রাযি.; তারপর ওমর রাযি.; তারপর আহলে বাকি। আমি আহলে বাকি’র পাশে আসবো। তারা আমার সঙ্গে একত্র হবে। তারপর আমি মক্কানাসীর অপেক্ষা করবো। তারা মক্কা ও মদিনার মাঝামাঝি জায়গায় এসে আমার সঙ্গে মিলিত হবে। (সুনানে তিরিমযি, হাদিস নং-৩৬২৫; মুসতাদরাকে হাকিম, হাদিস নং-৩৬৯১)
হযরত উম্মে কায়েস বিনতে মুহসিন, হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম’র এই বর্ণনা নকল করেন- ‘ কিয়ামতের দিন সত্তরহাজার লোক কবর থেকে এমনভাবে উঠবে যে, তাদের চেহারা চতুর্দশ রাত্রির পূর্ণিমার চাঁদের ন্যায় চমকাতে থাকবে। এবং এই সকল লোক কোনো হিসাব ছাড়াই জান্নাতে প্রবেশ করবে।’ (মুসতাদরাকে হাকিম, হাদিস নং-৭০৩৫)
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।