Inqilab Logo

শনিবার ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ০১অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সিন্ডিকেট ভাঙতে কাঁচা চামড়া রফতানির পরামর্শ

অর্থনৈতিক রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ২৯ আগস্ট, ২০১৮, ১২:০৩ এএম

মোহাম্মদ নাজিম নামে এক ব্যক্তি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে লিখেছেন- সিদ্ধান্ত নিয়েছি কোরবানির পশুর চামড়া মাটিতে পুঁতে ফেলবো। এতিম-মিসকিনদের ২০০ টাকা দিয়ে দেবো! এই বক্তব্যের পিছনে বিস্তারিত ব্যখ্যা দিয়ে তিনি আরও লিখেছেন-আর এটাই হোক আমাদের প্রতিবাদের ভাষা।
দেশে সবকিছুর দাম বাড়লেও প্রতি বর্গফুটে চামড়ার দাম বছর বছর কমানো হচ্ছে। তারপরও সঠিক দামে মাঠ পর্যায়ে চামড়া কিনছে না ব্যবসায়ীরা। এ বছর কোরবানিতে লাখ টাকার গরুর চামড়া ৩০০-৫০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। অনেকে চামড়া বিক্রি করতে না পেরে ফেলে দেয়ার নজিরও স্থাপন করেছেন। চট্টগ্রাম মহানগরীর ডাস্টবিনে এমন অনেক চামড়া পাওয়া গেছে বলেও খরব বের হয়েছে গণ-মাধ্যমে। যদিও বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের চামড়ার চাহিদা এখনও রয়েছে। কিন্তু নানা অজুহাতে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে চামড়া ব্যবসয়ীরা গরিবের হকের ওপর হাত দিয়েছে। দাম কমাতে কমাতে পানির দমে নামিয়ে এনেছে চামড়ার দাম।
ফারুক হোসেন নামে একজন ব্যবসায়ী বলেছেন, আমি ৬৮ হাজার টাকা দামের গরু কোরবানি করেছি। চামড়া ব্যবসায়ীরা এই চামড়ার দাম করেছে মাত্র ২০০ টাকা। বিক্রি করলাম না, সন্ধ্যা নাগাদ বহু গরিবরা এসেছে আমার কাছে চামড়ার টাকা চাইতে। কিন্ত দিতে পারিনি। রাগ করে বলেছি, ‘চামড়াটাই নিয়ে যাও।
দেশজুড়ে এই চিত্র এবার অহরহ ঘটেছে। যেন সবাই জিম্মি, কারও কিছু বলার নাই। কিছু করার নাই। সরকারের নির্ধারিত দামেই চামড়া কিনবে ব্যবসায়ীরা জানিয়ে বাংলাদেশ ট্যানার্স এসোসিয়েশন (বিটিএ) সভাপতি শাহিন আহমেদ বলেছেন, ট্যানারির মালিকরা নির্ধারিত মূল্যে লবণযুক্ত চামড়া কিনবে। তবে কেউ যদি চামড়ায় সঠিকভাবে লবণ না মেশায় তাহলে সেই চামড়ার দাম পাবে না।
কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে ট্যানারি মালিকদের অনিহার কারণে পানির দামে চামড়া কিনেও বিক্রি করতে পারছে না আড়তদাররা।
গত ৯ আগস্ট কোরবানির পশুর চামড়া সংগ্রহের জন্য গত বছরের চেয়ে কম দাম নির্ধারণ করে দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। ঢাকায় প্রতি বর্গফুট লবণযুক্ত গরুর চামড়ার দাম পাঁচ টাকা কমিয়ে ধরা হয়েছে ৪৫-৫০ টাকা, ঢাকার বাইরে ৩৫-৪০ টাকা। গত বছর এ দাম ছিল ঢাকায় প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়া ৫০-৫৫ টাকা, ঢাকার বাইরে ৪০-৪৫ টাকা।
অপরদিকে প্রতি বর্গফুট খাসির চামড়ার দাম সারাদেশে ১৮-২০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। যা গত বছর ছিল ২০-২২ টাকা। আর বকরির চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ১৩-১৫ টাকা। যা গত বছর ছিল ১৫-১৭ টাকা।
এই অবস্থা চলতে থাকলে দেশের চামড়া শিল্প বড় ধরনের হুমকির মধ্যে পড়তে পারে। সামাজিকভাবেও নেতিবচক প্রভাব পড়ার ঝুকি রয়েছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
জাতীয় পার্টির নেতা জিএম কাদের বাণিজ্য মন্ত্রী থাকাকালীন চামড়া ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট ভাঙার চেষ্টা করেছিলেন। ওই সময় তিনি কাঁচা চামড়া রফতানির কথা ঘোষণা দেন। এরপরই রফতানি বন্ধে ট্যানারি মালিকরা ঘোষণা দিয়ে কাঁচা চামড়ার দাম বাড়িয়ে দেন। কিন্তু এরপর থেকেই টালবাহানা শুরু করে ব্যবসায়ীরা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চামড়া রফতানির এ সিদ্ধান্ত কার্যকর করা উচিত। কেননা গত কয়েক বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে বিভিন্ন অজুহাতে কাঁচা চামড়ার দাম কমানো হচ্ছে। এই সিন্ডিকেট ভাঙতে হলে এর কোনো বিকল্প নেই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অর্থনীতিবীদ এম এম আকাশ বলেছেন, এটা আমাদের দেশের জন্য একটি দুর্ভাগ্যের বিষয়। সম্ভবনাময় একটি শিল্প ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটের জন্য নষ্ট হতে বসেছে। এবার চামড়া নিয়ে যা করা হলো-সামাজিকভাবেই একটা নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়ে যাচ্ছে এ খাতের ব্যবসায়ীদের নিয়ে। বিভিন্ন মাধ্যমে এর প্রতিক্রিয়া দেখলে সেটা বুঝা যায়। এই অবস্থা থেকে উত্তরণে সরকারকে অবশ্যই বাস্তব সম্মত ব্যবস্থা নিতে হবে।
১৯৯০ সাল পর্যন্ত দেশে থেকে কাঁচা চামড়া রফতানি হতো। দেশীয় জুতো শিল্পের বিকাশে সরকার কাঁচা চামড়া রফতানির অনুমতি বন্ধ করে দেয়া হয়। আর এখন বেশি রফতানি হয় ফিনিশড লেদার। এখন সময় এসেছে আবার সেই চামড়া রফতানি অবারিত করা।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) সিনিয়র গবেষক ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, বাংলাদেশের চামড়ার মান বিশ্বের অন্যান্য দেশের চেয়ে অনেকগুন ভাল। লবণযুক্ত চামড়া দেশে প্রক্রিয়াজাত করে রফতানি করতে পারলে অনেক বেশি লাভবান হবে দেশ। এমনকি চামড়াজাত বিভিন্ন পণ্য তৈরি করে রফতানি করতে পারলে আরও ভাল। কিন্তু ব্যবসায়ীরা অসাধু পন্থা অবলম্বন করার কারণে এই সম্ভবনাটুকু নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এ বছর চামড়া নিয়ে যথেচ্ছাই অবস্থা তৈরি করা হলো।
তিনি বলেন, সিন্ডিকেশন ভাঙতে হলেও দু-এক বছরের জন্য কাঁচা চামড়া রফতানি করা উচিত। এতে একদিক চামড়ার পাচার বন্ধ হবে। অন্যদিকে ব্যবসায়ীদের একটা শিক্ষা দেয়া যাবে। এরপর না হয় আবার বন্ধ করে দেবে সরকার। কিন্তু বর্তমান অবস্থা থেকে উত্তরণে রফতানি করা উচিত।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্র জানা গেছে, ব্যাংকিং খাতে গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত সামগ্রিক চামড়া খাতে বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ দুই হাজার ৮০০ কোটি টাকা। যার ঋণের খেলাপির পরিমাণ এক হাজার ২০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে প্রায় ৮০০ কোটি টাকা আদায় করতে না পেরে ব্যাংক অবলোপন করেছে। নিয়মিত হিসাবে যে এক হাজার ৬০০ কোটি টাকা রয়েছে সেগুলোর বিপরীতে ব্যাংকের হাতে পর্যাপ্ত জামানত নেই। এগুলোর একটি বড় অংশ মাঝে মধ্যে খেলাপি হলেও বারবার নবায়ন করে নিয়মিত হিসাবে রাখা হচ্ছে। এত কিছু সুবিধা পাওয়ার পরও ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করেই যাচ্ছে।
বিটিএ এর সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান মাজাকাত হারুন বলেন, চামড়া শিল্পের ওপর আমাদের বিশাল বিনিয়োগ হয়েছে। আমরা পরিবেশ সম্মতভাবে চামড়া প্রত্রিয়াজাত করতে ট্যানারি শিল্পকে ধীরে ধীরে স্থানান্তর করে সাভারে নিয়ে যাচ্ছি। বর্তমানে চামড়া কেনার জন্য যে পরিমাণ পুঁজি দরকার সেটা নিয়ে আমরা সঙ্কটে আছি। এছাড়া গত বছরের চামড়া এখনও রয়ে গেছে। বিশ্ববাজারেও চামড়ার দাম কমেছে। তবে ভবিষ্যতে এমন সমস্যা আর নাও হতে পারে।
এই সিন্ডিকেট আগামী নির্বাচনের আগে ভাঙছে না বলে ধরে নিচ্ছেন বিশেজ্ঞরা। বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহাম্মেদ গত রবিবার সচিবালয়ে সাংবাদিকদের যা বলেছেন, সেটা ব্যসায়ীদের কথার সঙ্গে মিলে যায়। এ সময় চামড়া রফতানি নিয়ে আপাতত সরকারের পরিকল্পনা নেই বলে জানান তিনি। তার মতে, এতে এই খাত ধ্বংস হয়ে যাবে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: চামড়া

১৩ ডিসেম্বর, ২০২১

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ