মাত্র ৪৮ ঘণ্টায় দেউলিয়া হলো যুক্তরাষ্ট্রের ২য় বৃহত্তম ব্যাংক
চলতি সপ্তাহের বুধবারও আর দশটি সাধারণ ব্যাংকের মতো বাণিজ্যিক ও আর্থিক লেনদেন সম্পন্ন করেছে যুক্তরাষ্ট্রের সিলিকন ভ্যালি ব্যাংক (এসভিপি), যা দেশটির দ্বিতীয় বৃহত্তম বাণিজ্যিক ব্যাংক
বিশ্ব অর্থনীতির না বলা গল্প হচ্ছে প্রসারমান বাণিজ্য যুদ্ধ ও ঝুলে থাকা বিশ্ব ঋণের মধ্যকার সম্ভাব্য বিস্ফোরক মিথস্ক্রিয়া যার আনুমানিক পরিমাণ বিস্ময়কর-২৪৭ ট্রিলিয়ন ডলার। এ ট্রিলিয়নের শুরু ‘টি’ দিয়ে। এ সংখ্যা এত বিরাট যে তা সম্পূর্ণ ধারণাতীত।
পরিবার, ব্যবসা ও সরকারের ঋণ গ্রহণ ঘটে এ ধারণা থেকে যে তারা হয় মূল অর্থ ও সুদ পরিশোধ করবে অথবা ঋণ নবায়নের মাধ্যমে বিষয়টি সামাল দেবে। তবে তা সম্ভব হয় যদি ঋণ পরিশোধের জন্য বা নতুন ঋণের যৌক্তিকতা প্রদর্শনে আয় যথেষ্ট হয়। এ সব উপাদান যখন হারিয়ে যায় তখন বিচ্যুতি, ঋণখেলাপি ও আতংক সৃষ্টি হয়।
এটাই হচ্ছে সে জায়গা যেখানে বাণিজ্য যুদ্ধ ও ঋণ বিপজ্জনক ভাবে বিভক্ত হয়। ২০০৯ সাল থেকে বিশ্ব ঋণ বেড়েছে। বিশ্ব অর্থনীতির (জিডিপি) অংশ হিসেবে এ ঋণ বৃদ্ধি জিডিপির ২৪৮ শতাংশ থেকে ৩১৮ শতাংশে পৌঁছেছে। ২০১৮-র প্রথম চতুর্থাংশে বিশ্ব ঋণ বিশাল পরিমাণ অংক ৮ ট্রিলিয়ন বৃদ্ধি পেয়েছে। এই ঋণগ্রহীতার মধ্যে সকল প্রধান দেশ এবং অধিকাংশ ধরনের ঋণঃ ভোক্তা, বাণিজ্য ও সরকার অন্তর্ভুক্ত।
এ সব ঋণ সার্ভিসের জন্য প্রয়োজন বর্ধিত আয়, অথচ সম্প্রসারিত বাণিজ্য যুদ্ধ আয় সংকোচসের হুমকি সৃষ্টি করেছে। অধিক পরিমাণ শুল্ক আরোপ ও বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা ঋণগ্রহীতাদের ঋণ পরিশোধ আরো কঠিন করে তুলবে। এঋণ বোমা বিশেষ করে এটা বিশ্ব অর্থনীতিকে মন্থর করে দিতে পারে। আরো খারাপ হিসেবে এটা আরেকটি অর্থনৈতিক সংকট সৃষ্টি করতে পারে।
উল্লেখ্য, এ বিপদ বিশ্বব্যাপী। এটি শুধু যুক্তরাষ্ট্রের জন্য নির্দিষ্ট নয়। শিল্প গবেষণা ও অ্যাডভোকেসি গ্রুপ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল ফিন্যান্স (আইআইএফ) এক নতুন রিপোর্টে বলেছে যে কিছু উদীয়মান ‘বাজার দেশ’ (তুরস্ক, দক্ষিণ আফ্রিকা, ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা) এ ঝুঁকির সামনে দুর্বল , তারা মেয়াদ পার হতে চলা ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ। ২০১৮ ও ২০১৯ সালে প্রায় ১ ট্রিলিয়ন ডলার-আখ্যাত উদীয়মান বাজার ঋণ পরিশোধের সময় হয়ে আসছে।
ঋণ অর্থনৈতিক প্রবাহকে গতিশীল করতে বা ব্যাহত করতে পারে। তা নির্ভর করে পরিস্থিতির উপর। আইআইএফ-র নির্বাহী ব্যবস্থাপনা পরিচালক হুং ট্রানের মতে , আমরা এখন এক ক্রান্তিকালের দিকে অগ্রসর হচ্ছি। ট্রানের বিশ্বাস যে ঋণ প্রবৃদ্ধি যদি টেকসই না হয় নতুন ঋণ প্রদান ধীর বা বন্ধ হবে। দেনাদারদের তাদের নগদ অর্থের অধিকাংশই বিদ্যমান ঋণ সার্ভিসিং-এ ব্যয় করতে হবে।
এক ব্রিফিং-এ ট্রান এভাবে পরিবর্তনের কথা জানান। তিনি বলেন, চমৎকার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিসহ আমাদের একটি স্বর্ণসদৃশ অর্থনীতি ছিল। কোথাও মুদ্রাস্ফীতি দেখা যাচ্ছিল না। কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো (দি ফেডারেল রিজার্ভ, ইউরোপিয়ান সেন্ট্রাল ব্যাংক) অধিকতর ঋণপ্রদানক্ষম (সুদের হার কম রেখে) হয়ে উঠেছিল। আপনি সব সময় ঋণ পরিশোধ মেয়াদ বৃদ্ধি করতে পারেন। যাহোক, এটা অব্যাহত রাখার সম্ভাব্যতা এখন অনেক কম। বাণিজ্য উদ্বেগ বাড়ছে এবং তা ইতিমধ্যে বিনিয়োগের আস্থা ও আগ্রহের উপর প্রভাব ফেলেছে।
মুদ্রাস্ফীতিও বাড়ছে। তা ঠেকাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদের হার বাড়াচ্ছে। বাণিজ্য সুরক্ষাবাদ সমস্যাকে আরো ঘনীভূত করছে, কারণ বহু অ-মার্কিন প্রতিষ্ঠান ডলারে ঋণ নিচ্ছে (ডলার বাণিজ্যে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত যদিও তার আমদানিকারক ও রফতানিকারকের কেউই আমেরিকান নাও হয়)। তবে এসব ঋণ অবশ্যই ডলারে পরিশোধ করতে হবে। যদি পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে সুরক্ষাবাদ বাণিজ্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করে তখন এ ডলার পাওয়া কঠিন হবে। ঋণ পরিশোধে বিলম্ব ও ঋণখেলাপি বাড়তে পারে।
ট্রান ২০০৮-২০০৯ সালের আর্থিক সংকটের মত পুরোমাত্রার কোনো আতংকের পূর্বাভাস দিচ্ছেন না। বরং আশাবাদের কিছু কারণ আছে। এ সংকটের আগে থেকেই ব্যাংকগুলো অনেক ভালো মূলধন সমৃদ্ধ। (ব্যাংক মূলধন - শেয়ার হোল্ডারদের তহবিল বা ঋণ - লসের বিরুদ্ধে সুরক্ষা)। লোকজন এখন দশ বছর আগের চেয়ে বিপদ সম্পর্কে অনেক বেশি সচেতন।
ফেডারেল ব্যাংক কর্তৃক ৩৫টি বৃহৎ ব্যংকের উপর পরিচালিত সাম্প্রতিক ‘স্ট্রেস টেস্ট’ থেকে এ প্রমাণ পাওয়া যায়। এক গভীর মন্দা ঘনীভূত হচ্ছে, বেকারত্বের হার ১০ শতাংশ বেড়েছে। ব্যাপক লস সত্ত্বও কোনো ব্যাংক ফেল করেনি। ২০০৯ সাল থেকে এ সব ব্যাংক ইক্যুইটি মূলধন হিসেবে ৮শ’ বিলিয়ন ডলার যোগ করেছে।
ট্রান যা বলছেন তা হচ্ছে ঋণ-অর্থায়নকৃত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি থেকে বৈশ্বিক স্থানান্তর। ২৪৭ ট্রিলিয়ন ডলার ঋণ ঝুলে থাকার অর্থ হচ্ছে যে বহু দেশই (চীন, ভারত ও অন্য উদীয়মান বাজার দেশসহ) উচ্চ অথবা অ-টেকসই ঋণের পরিণতি মোকাবেলা করবে- তা সে ভোক্তা, ব্যবসায়ী অথবা সরকার বাহিত হোক। বিশ্ব অর্থনীতির উপর সম্মিলিত টান পড়বে।
ট্রান ব্রিফিং-এ বলেন, আপনি যদি উচ্চ ঋণ পরিস্থিতিতে থাকেন, আপনার ঋণ পরিমাণ হ্রাস করা প্রয়োজন তা সে সম্পূর্ণভাবেই হোক আর জিডিপি শেয়ার হিসেবেই হোক। এর পরিণতি হবে মন্থর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি। শক্তিশাী বিনিয়োগ ও ভোক্তা ব্যয় বজায় রাখার জন্য আপনার ঋণগ্রহণ প্রয়োজন নেই।
এটা আর্থিক সংকটের চূড়ান্ত অধ্যায়ের প্রতিনিধিত্ব করে। বিশ্বব্যাপী মন্দা পরিহারের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো কর্তৃক নিম্ন সুদ হার গ্রহণ প্রয়োজন। সমালোচকরা উদ্বিগ্ন যে সস্তা ঋণ ঝুঁকিপূর্ণ ঋণদানকে যৌক্তিক করবে যা উচ্চ হার টিকিয়ে রাখতে পারবে না। আমরা শিগগিরই দেখতে পাব কে সঠিক।
*নিবন্ধকার রবার্ট জে. স্যামুয়েলসন ওয়াশিংটন পোস্ট-এর কলামিস্ট।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।