Inqilab Logo

বুধবার ০৬ নভেম্বর ২০২৪, ২১ কার্তিক ১৪৩১, ০৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

পাল্টেছে কৌশল কমেনি মাদকের কারবার

রফিকুল ইসলাম সেলিম : | প্রকাশের সময় : ২৮ জুলাই, ২০১৮, ১২:০১ এএম

ইয়াবার প্যাকেট চুম্বকে বেঁধে সেটা লাগিয়ে দেওয়া হয় বাসের নিচে। বেগুনের বিচি ফেলে দিয়ে তাতে ভরে দেয়া হয় ইয়াবার প্যাকেট। মোটর সাইকেলের তেলের ট্যাঙ্কে, পিক-আপ ও ট্রাকের চালকের সিটের নীচে বিশেষ কায়দায় রাখা হচ্ছে ইয়াবা। ল্যাপটপের ব্যাগের ভেতরে থাকা ফোমের ভেতরেও মিলছে এ নেশার বড়ি। মাদক বিরোধী চলমান অভিযানে শুধু কৌশল বদল করেছে কারবারিরা, এখনও বন্ধ হয়নি মাদকের কারবার। আগে বড় বড় চালান পাচার হতো, এখন ছোট আকারে পাচার হচ্ছে। কৌশলের সাথে বদল হয়েছে বহনকারিও। আগে বিক্রেতারা নিজেরাই পাচার করতেন, এখন তারা আড়ালে। যাদের সন্দেহ হবে না এমন লোকদের দিয়ে মাদক পাচার করা হচ্ছে।
বাসের স্টাফ, স্বামী-স্ত্রী, ভাই-বোন, পিতা-পুত্রও ধরা পড়ছেন ইয়াবাসহ। ইয়াবা পাচারকালে ধরা পড়েছেন নৌবাহিনীর সাবেক কর্মকর্তা ও জাতীয় পর্যায়ের বক্সিং চ্যাম্পিয়নও। চট্টগ্রাম মহানগরীসহ বৃহত্তর চট্টগ্রামে প্রতিদিনই ইয়াবাসহ মাদকের চালান ধরা পড়ছে। আর তাতে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারি বাহিনীর কর্মকর্তারা নিশ্চিত-মাদক চোরাকারবারীদের নেটওয়ার্ক এখনও অক্ষত আছে। অভিযান আর বন্দুক যুদ্ধের মধ্যে তারা আড়ালে চলে গেলেও বন্ধ হয়নি তাদের মাদকব্যবসা। নেপথ্যে থেকেই তারা সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছেন। কারণ চলমান অভিযানে এই পর্যন্ত চট্টগ্রাম অঞ্চলে যে কয়জন মারা গেছেন এবং গ্রেফতার হয়েছেন তাদের মধ্যে গডফাদার একজনও নেই। তারা সবাই খুচরা মাদক বিক্রেতা। মিয়ানমার থেকে সরাসরি ইয়াবার বড় বড় চালান এনে যারা ঢাকা, চট্টগ্রামসহ সারা দেশে ছড়িয়ে দেন তাদের কেউ এই অভিযানে ধরা পড়েননি।
মধ্য মে থেকে শুরু হওয়া মাদক বিরোধী বিশেষ অভিযানে গেল প্রায় তিন মাসে চট্টগ্রামে ১০ জনসহ সারা দেশে প্রায় পৌনে তিনশ জন মারা গেছেন। গ্রেফতার হয়েছেন কয়েক হাজার। এরপরও মাদকের ভয়াবহতা কমেনি। মাদকের রাজা ইয়াবার মূল ট্রানজিট রুট চট্টগ্রামে প্রতিদিনই ধরা পড়ছে ইয়াবার চালান। ইয়াবার সাথে পাচারকালে ধরা পড়ছে ভারতীয় ফেনসিডিল, মদ, গাঁজাসহ হরেক মাদক। র‌্যাব ও পুলিশের কর্মকর্তারা বলছেন, মাদকের উৎস বন্ধ না হওয়ায় মাদক পাচার বন্ধ হচ্ছে না। তাদের যে শক্তিশালী নেটওয়ার্ক তাও এখনও অক্ষত থেকে গেছে। এই খাতে শত শত কোটি টাকার বিনিয়োগ রয়েছে, এতে জড়িত আছে বিপুলসংখ্যক মানুষ। বিপুল সংখ্যক মাদকাসক্তের কারণে দেশে মাদকের চাহিদাও আছে। আবার উৎসও এখনও উন্মুক্ত। ফলে মাদক আসছে, তবে অভিযানের মুখে পাচার কিছুটা কমেছে।
দেশে যে দু’টি মাদকের বিস্তার সবচেয়ে বেশি তা হলো ইয়াবা ও ফেনসিডিল। আর এই দুটোই আসে প্রতিবেশি দেশ থেকে। সরকারি তরফে বলা হচ্ছে ভারতকে ফেনসিডিল কারখানার তালিকা দেওয়ার পর তারা ব্যবস্থা নিয়েছে। সেদেশ থেকে ফেনসিডিল আসা কমে গেছে। তবে মিয়ানমার এই ব্যাপারে কোন সহযোগিতা করছে না। বাংলাদেশকে টার্গেট করে গড়ে উঠা কোন ইয়াবার কারখানা বন্ধ হয়নি। ওইসব কারখানায় উৎপাদিত ইয়াবার পুরোটাই ঠেলে দেওয়া হচ্ছে এদেশে। র‌্যাব-পুলিশের অভিযানে কিছু চালান ধরাও পড়ছে। বৃহস্পতিবার রাতে র‌্যাব-৭ চট্টগ্রামের অভিযানে কক্সবাজার জেলার টেকনাফ থানার পূর্ব গোদার বিল এলাকায় ১৮ হাজার ৮৬০ পিস ইয়াবাসহ এক মাদক ব্যবসায়ী গ্রেফতার হন। গ্রেফতার শব্বির আহমদের বাড়ি ওই এলাকায়। কক্সবাজার ছাড়াও বৃহত্তর চট্টগ্রামে ইয়াবা পাচারের সময় যারা গ্রেফতার হচ্ছেন তাদের বেশিরভাগের বাড়ি কক্সবাজার জেলায়।
আবার কক্সবাজারে যাদের আসা যাওয়া আছে তারাও জড়িয়ে পড়ছেন এই ব্যবসায়। পুলিশ বলছে ইয়াবা ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েছেন শ্যামলী ও হানিফ পরিবহনের কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারি। বাসে করে ইয়াবা পরিবহনের কৌশলটিও চমৎকার। বুধবার শ্যামলী পরিবহনে কর্মরত তিনজনকে আটকের পর এসব তথ্য পেয়েছে নগর গোয়েন্দা পুলিশ।
নগর গোয়েন্দা পুলিশের উপ-কমিশনার (বন্দর) মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ জানান, কক্সবাজারে যেসব বাস আসা-যাওয়া করে এর মধ্যে হানিফ ও শ্যামলী পরিবহনের কিছু স্টাফ ইয়াবা ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েছেন বলে আমরা তথ্য পেয়েছি। ইয়াবাসহ হাতেনাতে কয়েকজনকে গ্রেফতার করেছি। তারা জানিয়েছে, বাস কক্সবাজারে পৌঁছার পর গ্যারেজে ঢোকানো হয়। সেখানে ইয়াবার প্যাকেট চুম্বকের সঙ্গে মুড়িয়ে বাসের পাটাতনের নিচে লাগানো হয়। বাসটি চট্টগ্রাম অথবা ঢাকায় পৌঁছানোর পর আবারও গ্যারেজে নেওয়া হয়। সেখানে ইয়াবার প্যাকেট খুলে নেওয়া হয়। সংঘবদ্ধ চক্র না থাকলে এত সূ² কৌশলে ইয়াবা পরিবহন সম্ভব নয় বলেও জানান তিনি। এর আগে গত ১১ জুলাই হানিফ পরিবহনের একটি বাস থেকে ৫ হাজার ইয়াবাসহ চালক-হেলপারকে আটক করেছিল নগর গোয়েন্দা পুলিশ।
ইয়াবা পাচারকারিরা তাদের কৌশলেও নতুনত্ব আনছে। গত সোমবার রাতে নগরীর ফিরিঙ্গিবাজার ব্রিজঘাট এলাকা থেকে তিনজনকে ৫হাজার ৪শ’ পিস ইয়াবাসহ গ্রেফতার করা হয়। পুলিশ জানায়, তাদের মধ্যে নৌবাহিনীর সাবেক কর্মকর্তা ও জাতীয় পর্যায়ের বক্সিং চ্যাম্পিয়ন আফতাব মিয়া (৫৯) কৌশলে চার হাজার ইয়াবা ল্যাপটপের ব্যাগে ফোমের ভেতরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রেখেছিলেন। তার এই কৌশল ধরতে পুলিশের দুই ঘণ্টারও বেশি সময় লেগেছে। ইয়াবা বিক্রিও হচ্ছে ভিন্ন কৌশলে। মোবাইলে অর্ডার দেয়ার পর পৌঁছে দেয়া হচ্ছে ক্রেতার ঘরে। সম্প্রতি নগরীর আসকার দিঘীর পাড় থেকে ইয়াবা বিক্রিকালে এক মাদক বিক্রেতাকে আটক করে পুলিশ। এ সময় ওই বিক্রেতার মোবাইলে একের পর এক ক্রেতাদের ফোনে অর্ডার আসতে থাকে। কয়েক মিনিটের মধ্যে এমন চারজন ক্রেতাকে আটক করতে সক্ষম হয় পুলিশ। ওই মোবাইলে আরও ৪০ জন ক্রেতার নাম্বার পাওয়া যায়।
নানা কৌশলে ইয়াবা ও ফেনসিডিল পাচার হয়ে আসছে। শুধুমাত্র সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতেই আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা অভিযান চালিয়ে মাদক উদ্ধার করতে পারছে। তথ্য না থাকায় বেশিরভাগ চালান গোপনে পাচার হয়ে যাচ্ছে। গত ২০ মাসে র‌্যাব-৭ চট্টগ্রামের অভিযানে ৮৯ লাখ ৭৪ হাজার পিস ইয়াবা ট্যাবলেট, ৪৯ হাজার বোতল ফেনসিডিল উদ্ধার করেছে। চট্টগ্রামে র‌্যাব ও পুলিশের কর্মকর্তারা বলছেন, মাদকের আগ্রাসন বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত অভিযান চলবে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: মাদক

২৭ সেপ্টেম্বর, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ