Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

প্রকৃতির বৈরী আচরণ

উত্তরাঞ্চলে ভরা মৌসুমে বৃষ্টি নেই, খরা ভাব, বিঘিত চাষাবাদ

রেজাউল করিম রাজু : | প্রকাশের সময় : ২২ জুলাই, ২০১৮, ১২:০১ এএম

ভর মওসুমেও উত্তরাঞ্চলজুড়ে চলছে খরা ভাব। বৃষ্টি নেই। খরা ও তাপাদাহের মাত্রাও বেড়েছে। শ্রাবনেও প্রকৃতি যেন গ্রীস্মের রূপ নিয়েছে। প্রচন্ড ভ্যাপসা গরমে হাঁসফাঁস করছে মানুষ পশুপাখি। জনজীবন বিপর্যস্ত। বিলম্বিত হচ্ছে রোপা আমনের আবাদ। আষাঢ়ে বাদল নামে নদী ভর ভর এমনটি হবার কথা থাকলেও এবার বৃষ্টি বাদলই নামেনি। ভরেনি খাল বিল নদী নালা। প্রকৃতির আচরণও হয়ে উঠেছে বৈরী। সকালের সূর্য উঠছে যেন আগুনের হল্কা নিয়ে। বেলা বাড়ার সাথে পরিবেশ হয়ে উঠছে অসহনীয়। তাপমাত্রা চল্লিশ ডিগ্রী ছুই ছুই।
আবহাওয়াবিদরা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে বলছেন উত্তরাঞ্চলে স্বাভাবিকের তুলনায় বৃষ্টি পাতের হার ও পরিমাণ কমছে। আবহাওয়া হয়ে উঠেছে রুক্ষ। এতে করে কৃষি প্রধান উত্তরাঞ্চলের চাষাবাদে বিরূপ প্রভাব পড়ছে। সেচ ব্যবস্থপনায় বাড়ছে খরচ। আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরিসংখ্যানে দেখা যায় গত জৈষ্ঠ-আষাঢ় মাসে দেশে স্বাভাবিকের চেয়ে তিন দশমিক ছয় শতাংশ বেশী বৃষ্টিপাত হয়েছে। কিন্তু রাজশাহী বিভাগে ৩৭ দশমিক তিন শতাংশ বৃষ্টিপাত কম হয়েছে।
গত জুন মাসে রাজশাহী বিভাগে স্বাভাবিক বৃষ্টি পাতের পরিমান ধরা হয় ৩০৫ মিলিমিটার। অথচ বৃষ্টিপাত হয়েছে ১৯১ দশমিক দুই মিলিমিটার। আবার রংপুর বিভাগে গত জুন মাসে বৃষ্টিপাত হয়েছে ১৩ দশমিক এক শতাংশ বেশী। গত চৈত্র থেকে বৈশাখ পর্যন্ত সারাদেশে এমনকি অতি বর্ষণের পরও উত্তরাঞ্চলে স্বাভাবিকের চেয়ে কুড়ি শতাংশ বৃষ্টিপাত কম হয়েছে।
এখন চলছে রোপা আমনের ভরা মওসুম। আমন ধান সাধারণত বৃষ্টিনির্ভর ফসল। বৃষ্টির পানিকে আল্লাহর রহমত হিসাবে গন্য করা হয়। এবার সময়মত বৃষ্টি না হওয়ায় গভীর নলকুপের পানি দিয়ে চাষাবাদ করতে হচ্ছে। এতে উৎপাদন খরচ যেমন বাড়ছে। তেমনি চাপ বাড়ছে ভূগর্ভস্থ পানির উপর।
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারন বিভাগের উপ-পরিচালক দেব দুলাল ঢালী বলেন, আবহাওয়ার মতিগতি ভালনা। বর্ষণ না হওয়ায় এবার রোপা আমন আবাদ বিলম্বিত হবে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক প্রো-ভিসি ও ভূতত্ত্ব খনি বিদ্যা বিভাগের প্রফেসর ড.সারওয়ার জাহান সজল এটি জলবায়ুর পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব না বলে বলছেন আবহাওয়া বৈরী আচরণ করছে। যার প্রভাব পড়ছে সর্বত্র।
ফারাক্কা গজল ডোবার কারণে এ অঞ্চলের নদ নদীগুলো বছরে আট নয় মাস মৃত অবস্থায় থাকে। বর্ষা মওসুমে বৃষ্টির পানি উজানের ঢলে প্রাণ ফিরে পায়। খাল বিলও জেগে ওঠে। এবারের পরিস্থিতি ভিন্ন। আষাঢ় গেল শ্রাবণের সপ্তাহ পার। এখনো পদ্মায় বিশাল বালুচর। তবে ফারাক্কার দু’একটা গেট খোলা পেয়ে কিছু ঘোলা পানি দেখা গেলেও নেই ঘূর্ণীশ্রোত।
বগুড়া ব্যুরো থেকে বিশেষ সংবাদদাতা মহসিন আলী রাজু জানান, আষাঢ় ও শ্রাবণকে নিয়ে যে বর্ষা মওশুম সেই বর্ষাতেও বগুড়ায় দেখানেই একফোঁটা বৃষ্টির ! চারিদিকে বৃষ্টির জন্য হাহাকার । খাল বিল নদী নালা সব শুকিয়ে চৈত্র-বৈশাখের রুপ নিয়েছে । চাষীরা চাষাবাদ বাদ দিয়ে অপেক্ষায় আছে, কখন বৃষ্টি হবে, নামবে শ্রাবণ ধারা। জমিতে জো’ আসলে শুরু হবে আমন রোপনের ধুম।
স্থানীয় আবহাওয়া অফিসের রেকর্ড মোতাবেক গত জুন মাসে আষাঢ়ের প্রথম প্রান্তিকে ২৫১ মিমি বৃষ্টি হয়েছে। আষাঢ়ের ২য় ও শ্রাবনের প্রথম প্রান্তিকে ২১ জুলাই পর্যন্ত বৃষ্টির পরিমান মাত্র ১২৬ মিমি, যা অস্বাভাবিক । আবহাওয়া কর্মকর্তাদের মতে চলতি সপ্তাহে যদি কাঙ্খিত মাত্রায় বৃষ্টি না হয় তাহলে রীতিমত প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণ হয়ে দাঁড়াবে।
দিনাজপুর অফিস থেকে মাহফুজুল হক আনার জানান, আষাঢ গেছে শুকনো-শ্রাবণেও নেই কাঙ্খিত বৃষ্টি। দাবদাহের সর্বকালের রেকর্ড ভঙ্গ হওয়ার পথে। গত শুক্রবার পর্যন্ত দিনাজপুরে সর্বোচ্চ ৩৮ দশমিক ৯ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। তাপদাহে জনজীবনে ওষ্ঠাগত অবস্থা।
দিনাজপুর আবহাওয়া অফিস সুত্র বলছে, গত ৯ জুলাই থেকে ২০ জুলাই পর্যন্ত বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে মাত্র ৩১ দশমিক ১ মিলি মিটার। বৃষ্টি না থাকায় প্রচন্ড তাপদাহের তীব্র গরম অনূভুত হচ্ছে। এ সময়ে নদী উত্তাল থাকার কথা থাকলেও পানির কোন প্রবাহ নেই। খাল-বিল ডোবা পানি শুন্য।
কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের মতে, এ বছর প্রায় আড়াই ল্খ হেক্টরের বেশী জমিতে রোপা আমন আবাদের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। কিন্তু পানি অভাবে জমিতে হাল দিতে না পারায় এখনো অনেক জমি পতিত রয়েছে। এদিকে বিদ্যুতের ভেলকিবাজীতে সেচ দিয়েও জমি রোপন করা সম্ভব হচ্ছে না। অপরদিকে প্রচন্ড তাপদাহে বৃদ্ধ ও শিশুদের ত্রাহি অবস্থা। প্রচন্ড গরমে ডাইরিয়া আমাশয় রোগের প্রাদুভাব দেখা দিয়েছে।
পাবনা থেকে ষ্টাফ রিপোর্টার মুরশাদ সুবহানী জানান, আষাঢ় পেরিয়ে শ্রাবণের প্রথম সপ্তাহ চলছে । উত্তরের জেলাগুলোতে দেখা নেই বৃষ্টির। তাপমাত্রার পারদ বাড়ছে। প্রচন্ড গরমে জনজীবন যেমন অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে। তেমনি ফসলের মাঠ পুড়ে যাচ্ছে। পাবনা সদর এলাকার বয়স্ক কৃষক মোতালেব মিয়া জানালেন, তাঁর জীবনে আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে বৃষ্টিহীন এই রকম অবস্থা দেখেননি, অনুভব করেননি চৈত্রের চেয়েও অধিক গরম। পানির অভাবে পাট জাগ দেওয়া কষ্টকর হয়ে পড়েছে।পাট নিয়ে কৃষক পড়েছেন বিপাকে । যদি কয়েক দিনের মধ্যে বৃষ্টি না হয়, তবে পাটের আঁশ ছাড়ানো সম্ভব হবে না। পাবনার অদূরে মালঞ্চি এলাকার কৃষক রমজান মিয়া জানালেন, অতীতে চৈত্র-বৈশাখের খর-তাপ থেকে মুক্তি পেতে আল্লাহ পাকের কাছে প্রার্থণা করা হত ‘ আল্লাহ মেঘ দে, পানি দে, ছায়া দে’। এখন শ্রাবণ মাসে এই প্রার্থণা করতে হবে। তিনি বললেন, বাপরে, ‘এই রকম আবহাওয়া আগে দেখেনি। এখন ঢল হওয়ার কথা। সুজানগরের গাজনার বিলেও তেমন পানি নেই। চাটমোহরের চলনবিল এলাকা পানিতে প্লাবিত হয়নি। ঈশ্বরদী পাকশী হার্ডিঞ্জ ব্রিজ এলাকার নিচে অধিকাংশ এলাকা বালু-মাটি চর।কোন কোন স্থানে চাষা আবাদ করা হচ্ছে।
উত্তরের কৃষি প্রধান এলাকার মধ্যে পাবনার ঈশ্বরদী, আটঘরিয়া, এবং নাটোরের বড়াইগ্রাম ও গুরুদাসপুর এবং রাজশাহী বিভাগের প্রায় সকল জেলায় একই অবস্থা বিরাজ করছে। জমিতে বিভিন্ন সবজীর চাষাবাদ হয়েছে।কৃষি দপ্তর বলছেন, এখন অনেক ফসল বারো-মাসি ফসল হয়েছে। ঝিঙা, পটল, উসি, লাউ, গ্রীষ্মকালের করলা আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে পাওয়া যায়। বিভিন্ন শাক -সবজী বৃষ্টি না হওয়ার কারনে স্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে না, ডাটার শাক বড় হতে পারছে না।
রংপুর থেকে ষ্টাফ রিপোর্টার হালিম আনছারী জানান, প্রচন্ড তাপদাহ আর তীব্র রোদে পুড়ছে রংপুর অঞ্চলের মাঠ-ঘাট। স্মরণ কালের তীব্র রোদ আর প্রচন্ড তাপদাহে এ অঞ্চলের মানুষ দিনের বেলা ঠিকমত কাজে যেতে পারছে না। কৃষকসহ দিনমজুররা ক্ষেতে-খামারে কাজ করতে পারছে না। তীব্র রোদের কারণে গায়ে ফোসকা পড়ে যাচ্ছে। আর বৃষ্টি না হওয়ায় রোপা আমনের চারা শুকিয়ে মরে যাচ্ছে। চলতি মৌসুমে রংপুর জেলায় প্রায় দেড় লাখ হেক্টর জমিতে রোপা আমন চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে বৃষ্টি না হওয়ায় এ লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে মারাত্মক সংশয় দেখা দিয়েছে।
কৃষকরা জানিয়েছেন, সাধারণত আষাঢ়-শ্রাবণ মাসের এ সময় নদী-নালা, খাল-বিল নিচু জলাশয়গুলো পানিতে থৈ থৈ করে।আর এখন সেখানে মাঠঘাট ফেটে গেছে। আষাঢ-শ্রাবণ মাসে এ রকম খরা ইতিপূর্বে দেখিনি । তিস্তা সেচখালেও পানি নেই। মুল তিস্তায় পানি না থাকায় খালে পানি দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। ফলে সেচ খালের উপর নির্ভরশীল জমিগুলোও শুকিয়ে ফেটে যাচ্ছে। বিদ্যুতের অব্যাহত লোডশেডিংয়ের কারনে বিদ্যুৎ নির্ভর সেচ যন্ত্রগুলোও ঠিকমত চালাতে পারছে না। রংপুর পাউবোর সূত্র মতে, তিস্তায় পর্যাপ্ত পানি না থাকায় তিনটি মূল ক্যানেলের মধ্যে রংপুর ও বগুড়া সেচখালের আওতায় চাষিরা পানি পাচ্ছে না। শুধু দিনাজপুর খালে একটু পানি দেয়া সম্ভব হচ্ছে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: বৃষ্টি

৫ অক্টোবর, ২০২২
১৪ সেপ্টেম্বর, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ