Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লড়াই সফল হবে কবে?

মোহাম্মদ আবদুল গফুর | প্রকাশের সময় : ১২ জুলাই, ২০১৮, ১২:০২ এএম

এক সময় দেশে একটি শ্লোগান প্রায়ই শোনা যেতো : লড়াই লড়াই লড়াই চাই-লড়াই করে বাঁচতে চাই। এখন মনে হয় সারা দুনিয়া-ভরই চলছে এ লড়াই। বিশ্বকাপ লড়াইকে এক হিসাবে দুনিয়াভর একটা লড়াই বলা যায়। এলড়াইয়ে যে উত্তেজনা ছড়িয়ে ছিল তা থেকে মুক্ত ছিল না এমন কি বাংলাদেশও। তবে দু:খের বিষয় এই যে, সারা বিশ্ব জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছিল যে লড়াইয়ের উত্তেজনা, তার ইতি হতে যাচ্ছে অল্প দিনের মধ্যে।
অবশ্য বাংলাদেশে বিশ্বকাপ লড়াইয়ের উত্তেজনা অল্পদিনের মধ্যে শেষ হতে চললেও আরেকটি লড়াইয়ের উত্তেজনা শেষ হচ্ছে না সহজে। এ বছর বাংলাদেশে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবার কথা। সে নির্বাচনে ঠিক হবে আগামীতে কারা বাংলাদেশ শাসন করবে। এ নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই সারা দেশের জনগণের মধ্যে চলছে উত্তেজনা।
বাংলাদেশ কাগজে-কলমে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসাবে জনগণের স্বাধীন মতামতের ভিত্তিতে দেশ শাসিত হওয়ার কথা। জনগণের স্বাধীন মতামত ব্যক্ত হতে পারে নিরপেক্ষ কর্র্তৃপক্ষের অধীনে অনুষ্ঠিত অবাধ সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে। দু:খের বিষয় বাংলাদেশ কাগজে কলমে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র রূপে পরিচিত হলেও এ দেশে গণতান্ত্রিক আদর্শ খুব কমই গুরুত্ব পেয়ে থাকে। আরও দু:খের কথা, এ অবস্থার শুরু হয় স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকারের আমল থেকেই, যখন দেশের সকল রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ ঘোষণা করে একটি মাত্র সরকারী দল রেখে দেশে এক দলীয় বাকশালী শাসনব্যবস্থা কায়েম করা হয়েছিল।
পরবর্তীকালে কিছু দু:খজনক ঘটনার মধ্যে দিয়ে একদলীয় বাকশালী শাসনব্যবস্থার অবসান ঘটিয়ে দেশে বহু দলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পুন:প্রবর্তিত হলেও পরবর্তীতে এক পর্যায়ে একটি নির্বাচিত সরকারকে সামরিক ক্যুর মাধ্যমে উৎখাত করে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করে বসেন তদানীন্তন সেনা প্রধান জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। সে সময় সারা দুনিয়াকে অবাক করে দিয়ে এই সামরিক ক্যুর প্রতি সমর্থন দিয়ে বসেন দেশের প্রাচীনতম রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা। এই অকল্পনীয় পদক্ষেপের কারণ সম্ভবত এই যে, উৎখাত হওয়া ঐ নির্বাচিত সরকারের নেতৃত্বে ছিল নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপি
সংবাদপত্র পাঠকমহল জানেন, এরপর শুরু হয় জেনারেল এরশাদের সুদীর্ঘ স্বৈরশাসনের পালা। পাশাপাশি চলতে থাকে বিএনপি অন্যান্য রাজনৈতিক দলের এরশাদ বিরোধী আন্দোলন। আওয়ামী লীগ প্রথম দিকে অনেক দিন এসব আন্দোলন থেকে দূরে থেকে অবশেষে এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে যোগ দেয়। কিন্তু ততদিনে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে একটানা নেতৃত্ব দিয়ে রাজনীতিতে অপেক্ষাকৃত নবাগতা বেগম খালেদা জিয়া আপোষহীন নেত্রী হিসাবে অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন, যার বাস্তব প্রমাণ পাওয়া যায় যথা সময়ে। এরশাদ-বিরোধী আন্দোলনে আওয়ামী লীগের যোগ দেওয়ার পর দেশের দুই প্রধান দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দেশে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে একটি সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রশ্নে একমত হয়। প্রধান দুই দল এ বিষয়েও একমত হয় যে সাধারণ নির্বাচন যাতে অবাধ ও নিরপেক্ষ হয় সে লক্ষ্যে সুপ্রীম কোর্টের তদানীন্তন প্রধান বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে গঠিত নির্দলীয় তত্ত¡াবধায়ক সরকারের অধীনে এ সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। যেমনটা আশা করা গিয়েছিল, নির্বাচন অত্যন্ত সুষ্ঠু ও অবাধ হয়। নির্বাচন চলাকালে সাংবাদিকদের সাথে আলাপচারিতাকালে এক পর্যায়ে শেখ হাসিনা বলেন, আমি সকল জেলার খবর নিয়েছি। নির্বাচন অত্যন্ত সুষ্ঠু ও অবাধ হয়েছে। আপনারা লক্ষ্য রাখবেন, ভোটে হেরে গিয়ে কেউ যেন এর মধ্যে আবার কারচুপি আবিষ্কার না করে। শেখ হাসিনা বিশ্বাস ছিলো, দেশে সব চাইতে প্রাচীন ও সুসংগঠিত দল হিসাবে আওয়ামী লীগই জয়লাভ করবে।
কিন্তু ভোট গণনা শেষে যখন দেখা গেল আওয়ামী লীগ নয়, জয়ী হয়েছে বিএনপি, শেখ হাসিনা অবলীলাক্রমে বলে ফেললেন, নির্বাচনে সু² কারচুপি হয়েছে। সংশ্লিষ্ট কেউ তাঁর এ কথার গুরুত্ব না দেয়ায় স্বাভাবিক নিয়মে বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া নতুন সরকার গঠন করলেন এবং শেখ হাসিনা হলেন সংসদে বিরোধী দলীয় নেত্রী। বেগম জিয়ার প্রধান মন্ত্রীত্বের মেয়াদ শেষে যখন নতুন নির্বাচনের প্রশ্ন উঠলো, প্রধানত : বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার দাবীর মুখেই নির্দলীয় তত্ত¡াবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনের ব্যবস্থা রেখে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
বাংলাদেশের বিশেষ রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এই ব্যবস্থা গণতন্ত্রের নিরিখে খুবই বাস্তব প্রমাণিত হয়। এই ব্যবস্থাধীনে দেশের দুই প্রধান দল পালাক্রমে নির্বাচিত হয়ে দেশ পরিচালনার সুযোগ লাভ করে। কিন্তু কিছু রাজনীতিকের অতিরিক্ত ক্ষমতা-ক্ষুধা এই সুন্দর ব্যবস্থাটিকে শেষ পর্যন্ত পচিয়ে ফেলে এবং এক পর্যায়ে শেখ হাসিনার শাসন আমলে সংবিধান সংশোধন করে নির্দলীয় তত্ত¡াবধায়ক সরকারের বদলে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দেয়া হয়।
এই ঘোষণা প্রধান দুই দলের মধ্যকার অতীতের সমঝোতার সুস্পষ্ট লংঘন এ অভিযোগ এনে বিএনপি এই নির্বাচন বয়কট করে। দেশের দুই প্রধান দলের অন্যতম (বিএনপি) নির্বাচন বয়কটের ঘোষণা দিলে কার্যত এ নির্বাচন পরিণত হয়ে পড়ে একটি নির্বাচনী প্রহসনে। বিরোধী দলের নেতা কর্মীরা তো দূরের থাক, সরকারী দলের অনেক নেতাকর্মীও ভোট কেন্দ্রে ভোট দিতে যাবার গরজ অনুভব করেননি। কারণ তারা জানতেন, তারা না গেলেও তাদের ভোটদানের ব্যবস্থা ঠিকই করা হবে দলের পক্ষ থেকে।
বাস্তবে হয়ও সেটাই। বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের অনুপস্থিতির সুযোগে সরকারী দলের অল্প-সংখ্যক নেতা কর্মীই সরকার দলীয় প্রার্থীদের অধিকসংখ্যক ব্যালটপত্রে সীলমেরে সরকারী প্রার্থীদের পক্ষে অস্বাভাবিকভাবে বেশী ভোট প্রদত্ত হওয়ার ‘প্রমাণ’ জন্ম দেন। এর ফলে সরকারী দলের প্রার্থীদের পক্ষে অকল্পনীয়ভাবে বেশী ভোট প্রদত্ত দেখানোর সুযোগ হয়, যদিও ভোট প্রদানের জন্য নির্দিষ্ট সময়কালে অধিকাংশ ভোটকেন্দ্র ছিল ফাঁকা, প্রায় শূণ্য। পরবর্তী দিন পত্র-পত্রিকায় বিভিন্ন ভোট কেন্দ্রের সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে দেশের জনগণের কাছে আসল তথ্য ফাঁস হয়ে পড়ে।
এও তো গেল জাতীয় সংসদের মোট ৩০০ আসনের ১৫৩ আসনের কথা। বাকী আসনগুলোতে এতটা নির্বাচনী প্রহসনেরও প্রয়োজন হয়নি। সেসব আসনে সরকারী প্রার্থীদের কোন প্রতিদ্ব›দ্বী না থাকায় তারা বিনা প্রতিদ্ব›িদ্বতায় নির্বাচিত হয়ে বাংলাদেশে নির্বাচনের ইতিহাসে এক কলংকজনক অধ্যায় সংযোজন করেন। এ কারণে জনগণ গত ৫ জানুয়ারীর এ নির্বাচনের নাম দিয়েছে ‘ভোটারবিহীন নির্বাচন’। বর্তমানে দেশে চালাচ্ছে যে সরকার, সে সরকার এই ভোটারবিহীন নির্বাচনেরই ফসল।
এভাবে ভোটারবিহীন নির্বাচনে সরকারের নেতৃত্ব লাভ করায় সরকারের নেতৃত্ব দানকারীরা যে এজন্য লজ্জাবোধ করছেন, তাও নয়। প্রধান মন্ত্রী বরং জাতীয় সংসদে বক্তৃতা দান করতে যেয়ে বলেছেন, বিএনপি নির্বাচন বয়কট করায় এক হিসাবে ভালই হয়েছে, সংসদে তাদের আবোল-তাবোল সমালোচনা শুনতে হচ্ছে না। সংসদে বিরোধী দলের জনপ্রতিনিধিদের সমালোচনাকে যারা আবোল-তাবোল সমালোচনা বলে মনে করেন তারা যে বাস্তবে গণতন্ত্রে আদৌ বিশ্বাস করেন না, তা বলাই বাহুল্য।
সেই নিরিখে প্রশ্ন রাখতে হয় তা হলে সরকার বিরোধী কোন বক্তব্য প্রকাশের সুযোগ না রাখাই কি ছিল সরকারের কাম্য? অথচ-কাগজে-কলমে বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসাবে পরিচিত। সেই সাথে আরও প্রশ্ন রাখতে হয় তিন তিন বার অবাধ নির্বাচনে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে ঠুনকো অজুহাতে দীর্ঘদিন কারারুদ্ধ করে রেখে প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশে গণতন্ত্রের মর্যাদা কতটা বজায় রাখতে পারছেন? বেগম খালেদা জিয়াকে কি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এতই ভয় পান যে তাঁকে মুক্ত রেখে ভবিষ্যতে নিয়মতান্ত্রিক পথে ক্ষমতায় যাবার কোন ভরসাই তিনি পান না?



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ